মুনীরউদ্দিন আহমদ

বর্তমান বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আমাদের যান্ত্রিক ও অতি প্রাকৃতিক করে তুলেছে। প্রাকৃতিক জীবনযাত্রা থেকে মানুষকে কৃত্রিম, অসুস্থ ও ক্ষতিকর জীবন যাপনের প্রতি ঠেলে দিচ্ছে এই তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া। প্রাকৃতিক জীবনযাত্রা থেকে সরে আসার কারণে বিশ্বজুড়ে মানুষের শরীর-মন-আত্মার ওপর প্রবল বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এর ফলে আমরা অতিমাত্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ছি। সুস্থ ও সুন্দর জীবনের জন্য আমাদের নিজেদের বদলাতে হবে। পরিবেশ, ওষুধ ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে, অন্যকে বদলানোর জন্য গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের জানতে হবে কোনটি স্বাস্থ্যকর নিরাপদ খাবার আর কোনটি অস্বাস্থ্যকর খাবার, কোনটি নিরাপদ ওষুধ আর কোনটি ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধ। আমরা হয়তো জানি না, লাইফস্টাইল পরিবর্তন করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা ওষুধ ছাড়াই সুস্থ ও সুন্দর জীবন যাপন করতে পারি। স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, সঠিক ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা, ধূমপান বর্জন করা, লবণ, চর্বি, ট্রান্সফ্যাট ও বিপুল ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবার পরিহার, মদপান না করা, পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি পান করা, পর্যাপ্ত নিরুপদ্রব ঘুম এবং দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন আমাদের অনেক রোগের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। সুস্থ জীবন যাপনের জন্য স্বাস্থ্য পরিচর্যা, রোগ, রোগের উৎপত্তি, প্রতিরোধ ও প্রতিকার এবং ওষুধ কম্পানি ও চিকিৎসকদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সবারই কিছু সাধারণ জ্ঞান অর্জন অবশ্যই দরকার। কারণ শরীর ও রোগ সম্পর্কে জ্ঞান ও সচেতনতা মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এবং রোগকে সুষ্ঠু ও দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করার মতো শক্তি জোগায়। এই শক্তিতে বলীয়ান হয়ে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে রোগ প্রতিহত ও প্রতিরোধ করতে পারলে ওষুধের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা কমে যাবে।

চিকিৎসাশাস্ত্রের সংজ্ঞা অনুযায়ী, কোনো ওষুধই নিরাপদ নয়। ওষুধ শরীরের জন্য বহিরাগত একটি রাসায়নিক পদার্থ এবং প্রতিটি বহিরাগত রাসায়নিক পদার্থেরই শরীরে কমবেশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, বিষক্রিয়া ও মিথস্ক্রিয়া থাকে। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, বিষক্রিয়া ও মিথস্ক্রিয়ার কথা ধর্তব্যের মধ্যে না নিয়ে অনিরাপদ, অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর ও ব্যবহারের অনুপযোগী ওষুধ খাইয়ে ওষুধ কম্পানি, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী এবং চিকিৎসকদের অনেকেই বিশ্বের অসহায় দরিদ্র মানুষকে ঠকিয়ে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করছে এবং এসব ওষুধ কিনে ও সেবন করে মানুষ শারীরিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও সর্বস্বান্ত হচ্ছে।

ওষুধের যুক্তিসংগত প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো যথাসম্ভব ন্যূনতম রেখে রোগীকে সর্বোচ্চ মাত্রায় সুফল প্রদানের প্রচেষ্টাই চিকিৎসাবিজ্ঞানের আসল লক্ষ্য। রোগ প্রতিরোধ-প্রতিকারে আমরা ওষুধ ব্যবহার করি। ওষুধের রোগ সারানোর অপূর্ব ক্ষমতাকেই শুধু আমরা ধর্তব্যের মধ্যে নিয়ে থাকি। কিন্তু রোগ সারানোর পাশাপাশি ওষুধ আমাদের শরীরে কত মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে তা আমরা প্রায়ই বুঝে উঠতে পারি না বা মনে রাখি না। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা বিষক্রিয়ার কারণে বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। ওষুধের অযৌক্তিক ও নির্বিচার ব্যবহার, বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই প্রাণঘাতী পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।

অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বা নির্বিচার ব্যবহার আমাদের প্রতিনিয়তই অন্য এক ধরনের ভয়ংকর বিপদ ও ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সাত দশক ধরে অ্যান্টিবায়োটিককে সংক্রামক রোগের প্রতিকারে ম্যাজিক বুলেট হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পর থেকে একদিকে যেমন লাখো-কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করা গেছে, তেমনি এসব ওষুধের বিষক্রিয়া, বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও অপপ্রয়োগের ফলে ভোগান্তি ছাড়াও বিশ্বের লাখ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। যুক্তিহীন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে অনেক জীবাণু এরই মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা রোধ করে বা ধ্বংস করে সফল চ্যালেঞ্জার হিসেবে টিকে থাকার দক্ষতা ও ক্ষমতা অর্জন করেছে। জীবাণুর প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন এই শতাব্দীর চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। পর্যাপ্তসংখ্যক নতুন নতুন কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত না হলে এবং অ্যান্টিবায়োটিকের যুক্তিসংগত প্রয়োগ নিশ্চিত করা না গেলে ভবিষ্যতে মানবসভ্যতাকে সমূহ বিপদের সম্মুখীন হতে হবে—এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

রোগ শরীরের স্বাভাবিক সুস্থ অবস্থার পরিবর্তন বা ক্ষতিসাধন করে অনেক সময় অপূরণীয় বিপর্যয় ডেকে আনে। এ অবস্থায় রোগ প্রতিকারের উদ্দেশ্যে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না। রোগ ও চিকিৎসকের কাছে যাওয়া যেমন সুখকর কোনো ব্যাপার নয়, ওষুধও তেমনি সম্পূর্ণ নিরাপদ কোনো বস্তু নয়। প্রশ্ন আসতে পারে, ওষুধের ক্ষতিকর প্রভাব থাকা সত্ত্বেও আমরা ওষুধ খাই কেন? ওষুধ জীবন রক্ষাকারী বস্তু। অনেক রোগের ক্ষেত্রে ওষুধ না খেলে রোগ জটিল আকার ধারণ করতে পারে। এর ফলে রোগীর শরীরের ক্ষতিসাধন ছাড়াও মৃত্যু হতে পারে। তাই গ্রহণযোগ্য মাত্রায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা ওষুধের অপরাপর ক্ষতিকর দিক বিবেচনার মধ্যে নিয়ে ওষুধ গ্রহণ করতে বা দিতে হয়। আমরা প্রায়ই একটি ভ্রান্ত ধারণায় ভুগি। অনেকেই মনে করেন, সব রোগের প্রতিকারে ওষুধ আবশ্যক বা সব রোগের ওষুধ রয়েছে। ধারণাটি সত্য নয়। সব রোগের জন্য ওষুধ দরকার হয় না বা বহু রোগের ওষুধ এখনো আবিষ্কৃৃত হয়নি। ঠাণ্ডা লাগা বা ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য কোনো ওষুধ নেই বা দরকারও হয় না। সতর্কতা অবলম্বন করলে এই রোগ এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। ক্যান্সার বা এইডস রোগের শতভাগ ফলপ্রসূ কোনো চিকিৎসা এখনো আমাদের হাতে নেই। বিশ্বজুড়ে রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোকে এখনো লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। এসব রোগের আধুনিক চিকিৎসা থাকা সত্ত্বেও এই জটিল ও মারাত্মক রোগগুলোকে এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। মাদকদ্রব্য গ্রহণে যারা অভ্যস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের সুস্থ করে সামাজিক জীবনে পুনর্বাসন বর্তমান যুগের অন্য এক ভিন্ন চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রেও প্রতিকার যেমন জটিল, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের মাধ্যমে প্রতিরোধের উপায় খুঁজে বের করা তেমন জটিল নয়। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষা, কুসংস্কার বর্জন, বাস্তবসম্মত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং সঠিক সময়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ।

নকল, ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ গ্রহণের ফলে শরীরে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়ার কারণে অনেক সময় নানা ধরনের বিভ্রান্তি দেখা দেয়। এসব বিভ্রান্তির কারণে মূল কালপ্রিট নকল, ভেজাল বা ক্ষতিকর ওষুধের পরিবর্তে আমরা আমাদের স্বাস্থ্যের অবনতি বা মৃত্যুর জন্য অন্য সব নির্দোষ উপাদানকে দায়ী করে বসি। ওষুধ যখন সেবন করা হয়, তখন বোঝার উপায় থাকে না ওষুধটি নকল না আসল। ওষুধ সেবনের পর কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া না গেলে রোগী ভাবে তার রোগ নির্ণয় ঠিক হয়নি। তখন রোগী অন্য ডাক্তারের কাছে যায়, বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করতে গিয়ে আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত হয়। নকল-ভেজাল ওষুধের কারণে শরীরে কোনো বিষক্রিয়া বা ক্ষতিকর অবস্থার সৃষ্টি হলে তাকে ওষুধের অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করে রোগীকে অন্য ওষুধ দেওয়া হয়। মূল দোষী সেই নকল বা ভেজাল ওষুধটি বরাবরই দৃষ্টির বাইরে থেকে যায়। অনেক ক্ষেত্রে নকল, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধের কারণে কারো স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে বা মৃত্যু হলে দোষ হয় রোগের, নতুবা ডাক্তারের অথবা হাসপাতালের। আমরা খুব কমই ভাবি নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের কারণে বিশ্বের বেশির ভাগ রোগী মারা যায়। তাই এসব নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের করাল গ্রাস থেকে আমাদের বাঁচতে হবে এবং অন্যকেও বাঁচাতে হবে।

বিশ্বের ওষুধ প্রস্তুতকারী কম্পানিগুলো তাদের অপ্রয়োজনীয় ও বাজে ওষুধ বিপণনে প্রতিবছর প্রত্যেক চিকিৎসকের পেছনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে। ওষুধ কম্পানিগুলোর এই বিশাল অবৈধ ও অনৈতিক বিনিয়োগ কোনোমতেই অর্থহীন নয়। কারণ এই বিনিয়োগ ওষুধ কম্পানিগুলোকে শতসহস্র গুণ বেশি মুনাফা অর্জনে সাহায্য করছে। এসব মুনাফার অর্থ যাদের পকেট থেকে আসে, তারা অসহায়-নিরীহ মানুষ। তারা জানে না কী ওষুধ তারা নিচ্ছে, কেন নিচ্ছে; এসব ওষুধের উপকারিতা, উপযোগিতা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী। ওষুধ কম্পানিগুলো তাদের উদ্ভাবিত ও বাজারজাত ওষুধের ট্রায়ালের জন্য আর্থিক, বৈষয়িক ও রোগ প্রতিকারের প্রলোভন দেখিয়ে তথ্য গোপন করে বিশ্বের অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোর অসহায়, দরিদ্র ও অজ্ঞ সাধারণ মানুষকে গিনিপিগের মতো ব্যবহার করে আসছে। এ ধরনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অবৈধ ও অনৈতিক। এ ধরনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে বিশ্বের হাজার হাজার মানুষ বিষক্রিয়া, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা মিথস্ক্রিয়ার কারণে জীবন দিয়েছে, হাজার হাজার মানুষ পঙ্গু হয়ে গেছে বা শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওষুধ কম্পানিগুলোর এসব অবৈধ ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। বহুজাতিক ওষুধ কম্পানিগুলোর এত সব অমানবিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের বিরুদ্ধে সরকারকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে এবং দোষী সাব্যস্ত হলে এসব কম্পানির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেমন করেছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত।

লেখক : প্রফেসর, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়