সিবিএন ডেস্ক :

কুতুপালং আর বালুখালিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের ১৩ শতাংশের বেশি হেপাটাইটিস সি’তে আক্রান্ত। দেশের কোটি মানুষের ভিড়ে হেপাটাইটিস সি খুঁজে পাওয়া যাবে বড়জোর আট লাখের মত। অথচ উখিয়া-টেকনাফেই আছে প্রায় তিন লক্ষ হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত রোহিঙ্গা।

সম্প্রতি ফোরাম ফর দ্য স্টাডি অব দ্য লিভার বাংলাদেশের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. মামুন আল মাহতাব।

গবেষণায় সহোযোগিতা করেছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের মেডিসিন ক্লাবের ভলানটিয়াররা, কক্সবাজার প্রশাসন, স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা আর ইসলামিক ফাউন্ডেশন। রিসার্চগুরু ‘ন্যাসভ্যাকের’ সহগবেষক ডাক্তার আকবর জাপান হেপাটাইটিস রিসার্চ ফাউন্ডেশন, এবং জাপানের এহিমে বিশ্ববিদ্যালয়।

ডা. মামুন আল মাহতাব বলেন, রোহিঙ্গাদের দলে-দলে এদেশে আসার আগে থেকেই আমাদের লিভার বিশেষজ্ঞদের একটা ধারণা ছিল যে এদের মধ্যে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের প্রার্দুভাবটা একটু বাড়াবাড়ি রকমেরই বেশি। রোহিঙ্গা সংকট শুরুর আগে বাংলাদেশ আর মিয়ানমারের মধ্যে ‘২৪ ঘন্টার ভিসার’ একটা বিষয় ছিল। এক দেশের নাগরিকরা টেকনাফ সীমান্তে পাসপোর্ট দেখিয়ে অন্য দেশে ২৪ ঘন্টার জন্য ঘুরে আসার বিশেষ ভিসা পেতেন। আর এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরেই তাদের চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম আর কক্সবাজারে আসা যাওয়া করতেন। ওই দুই জায়গায় আমাদের যেসব সহকর্মীরা আছেন তাদের কাছেই শোনা যে, এদের মধ্যে অনেকেই হেপাটাইটিস সি ভাইরাস নিয়ে তাদের কাছে আসতেন। আর এবার যখন রোহিঙ্গারা দলে দলে ঢুকে পড়লেন, তার পরপরই এই দুই জায়গার বিশেষজ্ঞ আর হাসপাতালগুলো থেকে আমরা এর সমর্থনে তথ্য পেতে থাকি। আর তখনই মাথায় আসে একটা রিসার্চ প্রজেক্টের কথা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্প। ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত ছবি
হেপাটাইটিস সি লিভারের অন্যতম ঘাতক ব্যাধি। লিভার সিরোসিস এমনকি লিভার ক্যান্সারেরও এটি অন্যতম কারণ। এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলটা ছেড়ে দিলে পৃথিবীজুড়ে বেশিরভাগ মানুষই লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এই হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের কারণেই।

তিনি বলেন, একজন লিভার বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি মনে করি এদেশের মানুষ আর তাদের লিভারের প্রতি আমার একটা দায়বদ্ধতার জায়গা আছে। সেই তাগিদ থেকেই উদ্যোগ নিয়েছিলাম খতিয়ে দেখতে আসলে ব্যাপারটা কি। কারণ সত্যি সত্যি যদি রোহিঙ্গাদের মধ্যে হেপাটাইটিস সি’র প্রাদুর্ভাব খুব বেশি হয় তাহলেতো নিরাপদ নয় আমার দেশের মানুষগুলোও। এটা ঠিক যে এ রোগ ছড়ায় রক্তের মাধ্যমে। কিন্তু তারপরও হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের দূষিত সুইয়ের খোঁচা কিংবা সেভিং ক্ষুরের ছোট্ট কাটাটাওতো নিরাপদ নয়। পাশাপশি তো থাকছেই অনিরাপদ শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে রোগ ছড়ানোর বিষয়টিও।

শুধু মাথায় ঢুকছিলো না ব্যাপারটা কি আসলেই সেরকম ভয়াবহ কিনা, যেমনটা আমরা ভাবছি। কারণ ইন্টারন্যাশনাল জার্নালগুলো ঘেটেঘুটে দেখলাম মিয়ানমারের সাধারণ মানুষের মধ্যে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবটা আমাদের মতই, অর্থাৎ এক শতাংশেরও কম। কিন্তু সহকর্মীদের পর্যবেক্ষণতো উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। হাজার হোক তারাইতো মাঠে আছেন, মাঠে থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি যেসব দেশীয় কোম্পানী সি ভাইরাসের ওষুধ বানান আর বিপণন করেন, তাদের সাথে কথা বলেও একইরকম তথ্য পাচ্ছিলাম।

তিনি আরও বলেন, কাজটা করতে নেমে দেখলাম যতটা সহজ ভেবেছিলাম, আদতে অতটা সহজ ছিল না। চ্যালেঞ্জ ছিল অনেক।

ভাবতেই বুকটা ভরে যায় যে কত লোকের নিঃশর্ত, নিঃস্বার্থ সমর্থনইতো পেয়েছি। সমস্ত রক্তের স্যাম্পলগুলো তাই আমরা পরীক্ষা করিয়ে আনতে পেরেছি পৃথিবীর প্রথম সারির ল্যাবরেটরি থেকে আর আমাদের ডাটাগুলোও তাই অনায়াসে প্রকাশিত হয়েছে ইউরো-এশিয়ান জার্নাল অব হেপাটোগ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির মত প্রথম সারির আন্তর্জাতিক, ইনডেক্সড, বৈজ্ঞানিক জার্নালে।

রোহিঙ্গা সমস্যাটিতো আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া। আমাদের নেত্রী মানবিকতার পরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে তাদের আপন করে নিয়েছেন। এখনও পেলে-পুষে চলেছেন। কিন্তু আর কতদিন?

আপনারা যারা নিজ বাসভূমে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, আমাদের দেশের মানুষ কেন অনিরাপদ? দেশের স্বাস্থ্য আর অর্থনীতির উপর এই যে বাড়তি বোঝা, এর ভার আপনারা কত তাড়াতাড়ি নেবেন? একজন বাংলাদেশী লিভার বিশেষজ্ঞ আর পাশাপাশি মানবতাবাদী একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আপনাদের কাছে এটা বোধকরি খুব বেশি কোনো চাওয়া নয়?