মো. নুরুল করিম আরমান, লামা:
পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি সরই ইউনিয়ন। আর এতেই বসবাস নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর। এদের বেশির ভাগেরই অবস্থান দারিদ্র সীমার নিচে। আর সেসব মানুষের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এলাকার সচেতন অধিবাসীরা নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেন সরই নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে আসছে একমাত্র বিদ্যালয়টি। কিন্তু ১৯ বছরেও এমপিও ভুক্তি না হওয়ায় বিনা বেতনেই শির্ক্ষার্থীদের পাঠদান করে আসছেন এ বিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মচারীরা। সর্বশেষ এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকায় নিজেদের বিদ্যালয়ের নাম দেখবেন এমনটাই আশা ছিল এ বিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারীগণের। কিন্তু তালিকায় বিদ্যালয়ের নাম না থাকায় এখন হতাশ হয়ে পাঠদানে আগ্রহ হারাতে বসেছে শিক্ষকরা। শিক্ষক-কর্মচারী, শিক্ষার্থী, অভিভাবক মহল ও ইউনিয়নের সুধীমহলের একটাই দাবি, অচিরেই যেন এই বিদ্যালয়টিকে এমপিওভুক্ত করা হয়। এমপিও ভুক্তি হলে ঝড়ে পরা শিক্ষার্থীর হার কমে, বাড়বে শিক্ষার হার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলা সদর থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে জনবহুল সরই ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী ক্যয়াজুপাড়া এলাকায় অবস্থিত বিদ্যালয়টি। এটি ছাড়া আশপাশ এলাকায় আর কোন মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। কোমলমতি শিশুদের কথা বিবেচনা করেই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী ও স্থানীয় আবদুল আজিজ লিড়ার ১৯৯১ সালের ১ জানুয়ারী প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষানুরাগী আবদুল আজিজ লিড়ার বিদ্যালয়ের জন্য দেড় একর জমিও দান করেন। পরবর্তীতে বিদ্যালয়টি প্রথম পাঠ দান অনুমতি পায় ২০১২ সালের ১ জানুয়ারী এবং স্বীকৃতি পায় ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারী। প্রতিষ্ঠানটির ইআইআইএন নম্বর ১০৩১১২। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি ও বাঙ্গালী মিলে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪১২জন। এর মধ্যে চলতি শিক্ষা বর্ষে এসএসসিতে পরীক্ষার্থী রয়েছেন ৬২জন। বিদ্যালয়টিতে শিক্ষক, কর্মচারী ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সবই আছে। নেই শুধু শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন। প্রতি বছর পাঠ্য বই ছাড়া আর কোন সরকারী সুযোগ সুবিধা পায় না এ বিদ্যালয়টি। পিছিয়ে পড়া দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় স্থাপিত হলেও পড়ালেখা ও খেলাধুলায় বিদ্যালয়টি এগিয়ে আছে।

বিদ্যালয়ের ১০ শ্রেনীর শিক্ষার্থী নাহিদা সুলতানা, জুবাইদা ইয়াছমিন, মো. মহি উদ্দিন ও তৌহিদুল ইসলাম বলেন, শিক্ষকরা বিনা বেতনে আমাদেরকে পাঠদান করছেন। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে তারা চাকরি করেন কিন্তু বেতন পান না। অভিভাবক মেনরুং মুরুং ও আবদুল কাদের বলেন, সরকার এবার অনেক প্রতিষ্ঠান এমপিও ভুক্ত করেছেন। কিন্তু আমাদের প্রত্যন্ত এলাকার অবহেলিত এ বিদ্যালয়টি এমপিও না করায় আমরা পিছিয়েই রয়ে গেলাম। না জানি কখন শিক্ষকরা বিদ্যালয়টি বন্ধ ঘোষনা করে অন্যত্র চলে যান; আমেন আশঙ্কায় ভুগছি।

বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক অংমেচিং মার্মা, সহকারী শিক্ষক আবুল হাসেম, মিনহাজুল হক জানায়, দীর্ঘ বছর যাবত বিনা বেতনে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে আসছি। আশা ছিল সর্বশেষ এমপিওভুক্তি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় এই বিদ্যালয়টির নাম থাকবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় অদূর ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হবে কিনা, সে বিষয়ে আশঙ্কা রয়েছে। তারা আরো জানান, সরকার আমাদের প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত এমপিও ভুক্তি করলে মানবেতর জীবনের অবসানের পাশাপাশি পাঠদানে আরোও বেশি মনোযোগী হবো, অধিকতর উপকৃত হবে শিক্ষার্থীরা।

এদিকে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নীতিপূর্ণ বড়ুয়া বলেন, প্রতিষ্ঠানে ১২ জন শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত আছেন। ২০১৮ সালে জেএসসি পরীক্ষার্থী ছিল ৭৯ জন, জিপিএ ৫ প্রাপ্তসহ পাশ করেছে ৪৭জন এবং ২০১৭ সালে পরীক্ষার্থী ছিল ৮১জন, জিপিএ ৫ প্রাপ্তসহ পাশ করেছে ৭৮জন। চলতি শিক্ষা বর্ষে ৬২জন শিক্ষার্থী এসএসসিতে পরীক্ষা দিবেন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন যাবত এমপিও না হওয়ায় শিক্ষকরা চরম হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন, পাঠদানে পূর্ণ মনোযোগী হতে পারছেন না। প্রতিষ্ঠানটি এমপিও হলে, লাঘব হবে দুঃখ-দূর্দশা। এমন প্রত্যাশা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকল শিক্ষক-কর্মচারীদের। চাতক পাঁখির মতো চেয়ে বসেছিলাম শুধু মাত্র এমপিও ভুক্তির আশায়। কিন্তু প্রকাশিত তালিকায় বিদ্যালয়টির নাম না থাকায় সে আশাও ভেস্তে গেল।

প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ ইদ্রিস কোম্পানী বলেন, এলাকায় আর কোন মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয় না থাকায় এটি খুবই দরকার। অনেক চেষ্ঠা করে এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ধরে রেখেছি। শিক্ষকরা বেতন না পাওয়ায় অনেকেই অন্যত্রে চলে গেছেন আবার নতুন শিক্ষক নিয়েছি। তারাও বেতন না পাওয়ায় হতাশার মধ্যে আছেন। শিক্ষক কর্মচারীগণ বিনা বেতনে সকল নীতিমালা অনুসরণ করে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে আসছেন এবং প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছরই সন্তোষজনক ফলাফল করে আসছে বলেও জানান তিনি।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ফরিদ উল আলম বলেন, এমপিও ভুক্তি হলে শিক্ষক-কর্মচারীদের জীবন কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে, এলাকার শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবেন। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের দূরবর্তী প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে এই প্রতিষ্ঠানে পাঠায়ে তাদের ব্যয় সংকুচিত হবে,বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের নিরাপত্তার দুঃশচিন্তা দূর হয়ে অধিকতর বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করতে উদ্বুদ্ধ হবে।

লামা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. গাউছুল আজম বলেন, বিদ্যালয়টির শিক্ষক-কর্মচারীরা দীর্ঘদিন যাবত স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। কোন বেতন ভাতা না পাওয়ায় অত্যন্ত মানবেতরভাবে জীবন যাপন করছেন তারা। সরকার দ্রুত প্রতিষ্ঠানটি এমপিও ভুক্ত করলে একদিকে যেমন শিক্ষক-কর্মচারীদের মানবেতর জীবনের অবসান হয়ে পাঠদানে অধিকতর মনোযোগী হবে, তেমনি এলাকার কোমলমতি শিশুরাও বাড়ীর কাছে থেকে পরীক্ষা পাশ করে সরকারের শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।