ছবি সংগৃহীত

জিয়াউর রহমান মুকুল

২৫ আগস্ট -২০১৭ সালে বাংলাদেশের প্রতিবেশি দেশ মায়ানমারে মুসলমান ও রাখাইনদের মধ্যে সংগঠিত জাতিগত দাঙ্গার কারণে প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার ৩৪ টি ক্যাম্পে অবস্থান নিয়েছেন।রোহিঙ্গা আগমনের ২ দুই বছর হয়েগেলেও এখনো কোন রোহিঙ্গা তাদের মাতৃভূমি মায়ানমারে ফিরে যায়নি।প্রথম দিকে রোহিঙ্গাদের প্রতি স্থানীয় লোকদের যে মনোভাব ছিল আজ ২ বছর পরে ২০১৯ সালে উভয়ের মনোভাবে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্ত কেন এই পরিবর্তন? স্থানীয়লোকরা মনে করেন রোহিঙ্গা আগমনের ফলে তারা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।পরিবেশ প্রতিবেশ থেকে শুরু করে নিজদেশে স্বাধীনভাবে যাতায়াতেও তার বিভিন্নভাবে হেনস্ত হচ্ছেন। তার কয়েকটি নিন্মে সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হল।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিঃ রোহিঙ্গা আগমনের পর থেকে উখিয়া টেকনাফ এলাকায় চুরি,ডাকাতি,খুন হত্যা বৃদ্ধি পেয়েছে আশংকাজনক হারে ।তার মূল কারণ হিসেবে জনসংখ্যাধিক্য ও রোহিঙ্গা ডাকাতদের দায়ী করা যায়।বর্তমানে উখিয়া টেকনাফ উপজেলার স্থানীয় লোকসংখ্যা সোয়া পাঁচ লক্ষ আর রোহিঙ্গারা তার প্রায় দ্বিগুণ। স্বাভাবিকভাবে একটা ছোট এলাকায় এত লোকসংখ্যা আইনশৃঙ্খলা অবনতির জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই ।২২ আগস্ট -২০১৯ রোহিঙ্গা ডাকাত কর্তৃক টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের স্থানীয় যুবক ওমর ফারুক হত্যা,২০ অক্টোবর -২০১৯ টেকনাফ উপজেলার শাপলাপুর ইউনিয়ের ২ কিশোরী (লাকি ও তসলিমা) অপহরণ অতিসাম্প্রতিক সময়ের দুটি বড় ঘটনা।এই সব ঘটনায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশংসনীয় পদক্ষেপে স্থানীয়রা সন্তুষ্ট হলেও তাদের আতংক দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেবল তা নয় তার পাশাপাশি প্রায় প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গা-রোহিঙ্গা দ্বন্দ্ব ও খুনের ঘটনার কথা হরহামেশাই শোনা যায় স্থানীয় লোকদের মাঝে।
মাদকের বিস্তারঃ কথিত আছে যেসব মাদক ব্যবসায়ীরা মায়ানমারে থেকে ইয়াবা ব্যবসা করত তাদের বড় একটা অংশ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করছে এবং তারা তাদের সেই অবৈধ ব্যবসার বিস্তার ঘটাচ্ছে। ফলে আমাদের দেশের সোনালী ভবিষ্যৎ হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে।
সড়ক বিশৃঙ্খলাঃ  বিগত ২ বছরের উখিয়া টেকনাফ তথা পুরো কক্সবাজারের সড়কে বেশ বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পেয়েছে।যাতায়াত বাড়া বাড়ানো হয়েছে দুই গুণেরও বেশি।যাতায়াতের সময়ও বৃদ্ধি পেয়েছে উদ্বেগজনকহারে।তারা পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে সড়ক দূর্ঘটনা।প্রায় প্রতিদিন কেউ না কেউ অকালে প্রাণ হারাচ্ছে এই সড়ক দূর্ঘটনার কারণে।তার প্রধান কারণ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রাণ ও নির্মাণ সামগ্রী বহনকারী ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের বেপরোয়া চলাচল।আরাকান সড়ক এখন কঙ্কালসার।এই সড়ককে দেশের সবচেয়ে বড় মরণফাঁদ বললেও মনে হয় অত্যুক্তি হবেনা।এই সড়কে যানযট অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
শিক্ষা অবনতিঃ রোহিঙ্গা আগমনের পর থেকে উখিয়া টেকনাফের শিক্ষা পরিবেশ প্রায় বিপন্ন হয়ে পড়ছে।শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একদিকে শিক্ষক সংকট অন্যদিকে শিক্ষার্থী সংকট। মহাবিদ্যালয়গুলোতে এই উভয় সংকট আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। অসহনীয় যানযট আর অন্যায্য ভাড়ার কারণে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা বিদ্যাবিরাগ হতে চলছেন। উল্লেখিত এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্টানের বিগত বছরের ফলাফল বিপর্যয়ও সেই অবনতির ইঙ্গিত বহন করে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রমে ধীরগতিঃ বিগত ২ বছরে ২ বার আনুষ্টানিক উদ্যোগ নিয়েও একজন রোহিঙ্গাকেও দেশে ফেরত পাঠানো যায়নি। ফলে স্থানীয়দে মাঝে বিরাজ করছে চরম হতাশা।রোহিঙ্গাদের থাকার জায়গা দিতে গিয়ে অনেকে তাদের বসতভিটা হারিয়েছেন দুবছর আগেই।হারিয়েছে তাদের চাষের জমি জমাও।রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দ্রুত না হওয়ায় তারা তাদের সেই আবাদি জমি সহসাই ফেরত পাবেন কিনা সেই সন্দেহ রয়ে যায় সকলের মনে।অন্যদিকে দশ লক্ষাধিক লোকদের বসতবাড়ি নির্মাণে বনভূমি কেটে সাফ করা হয়েছে ফলে পাহাড়ের মাটি প্বার্শবর্তী খাল বিলে পড়ে খাল বিল উভয়ই তাদের উপযুক্ততা হারিয়েছে।তাতেও ক্ষতির ভাগটা কেবল স্থানীয়দেরই।
ছন্ন বেকারঃ রোহিঙ্গা আগমনে তাদের মৌলিক মানবিক সেবা কর্মে কিছু সংখ্যক স্থানীয়দের চাকরি হলেও এলাকার শ্রমিকরা হয়ে পড়ছেন বেকার।রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেমন স্থানীয় শ্রমিকরা কাজের সুযোগ পায়না অন্যদিকে রোহিঙ্গা শ্রমিকরা ক্যাম্প প্বার্শবর্তী এলাকায় তুলনামূলক সস্তায় শ্রম বিক্রি করায় স্থানীয় শ্রমিকরা হয়ে পড়ছেন বেকার।তারা বর্তমানে তাদের দৈনন্দিন খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।কাগজে পড়লাম স্থানীয়দের একতৃতীয়াংশের বেশি লোক নিজেদের নিয়মিত সঞ্চয় ভেঙেছে কেবল সংসার চালানোর জন্য।একদিকে বেকারত্ব অন্যদিকে নিত্যপণ্যের উর্ধ্বগতি।এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা।সবজি মৌসুমেও এই এলাকায় সবজির দাম ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম শহরের তুলনায় ঢের বেশি।মাছ মাংস সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার সীমানা ছাড়িয়েছে সেই ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকেই।
সাংস্কৃতিক আগ্রাসনঃএকদিকে ভিন দেশী রোহিঙ্গা অন্যদিকে তাদের সেবায় নিয়োজিত দেশি বিদেশি অনেক কর্মকর্তা কর্মচারী।একেকজনের কৃষ্টি কালচার একেক রকম।সন্ধ্যা-রাতে উখিয়া কোর্টবাজারে নারী পুরুষ একসাথে বসে চা সিগারেট খেয়ে আড্ডা দেওয়া সত্যিই অত্র এলাকার মুরুব্বি দের নিকট বড়ই অস্বস্তিকর ও বেমানান।অন্যদিকে রোহিঙ্গা সেবায় নিয়োজিত কতিপয় উঠতি বয়সী কিশোর কিশোরী দের বেপরোয়া জীবনাচরণ অত্র এলাকা মানুষের সরল জীবানুভূতিতে কুঠারাঘাত করছে প্রায় প্রতিনিয়ত।
অধিকন্তু গত কয়েকমাস ধরে এই এলাকার মানুষ উচ্চগতির মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবা থেকে বঞ্চিত তাও কেবল এই রোহিঙ্গাদের দোষেই।এ যেন “উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে” ই সব নেতিবাচক আশংকা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় রোহিঙ্গাদের অতিসত্বর তাদের মাতৃভূমি মায়ানমারে ফেরত পাঠানো।অন্যতায় উখিয়া টেকনাফ এলাকার এই ক্ষতির প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে দেশের আনাচে কানাচে।

 

লেখকঃ মানবিক ও উন্নয়ন কর্মী, শেড,কক্সবাজার। ইমেলঃ  ziaur@shedbd.org