বিবিসি বাংলা:

“যদি দেখেন যে একটি উত্তরাঞ্চলীয় ‘স্নেকহেড’ মাছ আপনার জালে ধরা পড়েছে, এটিকে ছাড়বেন না। পাওয়ামাত্রই এটিকে হত্যা করুন। মনে রাখবেন, এটি ডাঙাতেও বেঁচে থাকতে পারে।”

ঠিক এরকম নির্দেশনাই দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের ন্যাচারাল রিসোর্স ডিপার্টমেন্ট বা প্রাকৃতিক সম্পদ বিভাগ।

উত্তরাঞ্চলীয় ‘স্নেকহেড’ মাছ দেখতে লম্বাটে ও চিকন। এর মাথা দেখতে অদ্ভূত রকম চ্যাপ্টা।

এটি উচুঁ মানের শিকারী প্রাণী এবং এর ক্ষুধা অফুরন্ত।

প্রতি বছর দশ হাজার ডিম

এই মাছ অন্যান্য জাতের মাছ থেকে শুরু করে ব্যাঙ, কাঁকড়া সবই সাবাড় করে ফেলে।

স্নেকহেড ৮০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত দীর্ঘস্নেকহেড ৮০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে

এটি দেখতে ৮০ সেন্টিমিটারের মতন লম্বা হতে পারে। এমনকি পানি ছাড়াও এই মাছ নিশ্বাস নিতে পারে এবং চলাফেরা করতে পারে।

আর এ কারণেই এই প্রাণী এক জলাশয় থেকে আরেক জলাশয়ে চলে যেতে পারে।

এই মাছ যদি একবার অন্য আরেক জায়গায় পৌঁছাতে পারে তাহলে এর বিস্তার ঠেকানো মুশকিল। স্নেকহেড মাছের নারী সদস্যরা বছরে দশ হাজার পর্যন্ত ডিম দেয়।

দূর্ঘটনাবশত বিস্তার?

স্নেকহেড মূলত চীন, রাশিয়া ও কোরিয়া অঞ্চলের মাছ। কিন্তু প্রায় এক দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত চার জাতের স্নেকহেডকে অ্যামেরিকায় সনাক্ত করা গেছে।

তবে, শুরুতে মূলত পালনের উদ্দেশ্যেই এই মাছকে যুক্তরাষ্ট্রের জলাশয়ে ছাড়া হয়েছিল বলে জানিয়েছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ।

অনেকে স্নেকহেড কিনেছিলেন সখ করে পোষার জন্য। কিন্তু এসব মাছ পানিতে ছেড়ে দেয়ার পর এর ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে।অনেকে স্নেকহেড কিনেছিলেন সখ করে পোষার জন্য। কিন্তু এসব মাছ পানিতে ছেড়ে দেয়ার পর এর ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে।

জর্জিয়া ছাড়াও ফ্লোরিডা, নিউ ইয়র্ক, ভার্জিনিয়া, ক্যালিফোর্নিয়া, ম্যাসাচুসেট্স ও মেরিল্যান্ডে এই মাছ পাওয়া গেছে।

মেরিল্যান্ডেই ২০০২ সালে প্রথমে এই মাছকে সনাক্ত করা হয়।

জনগণের সহায়তা

জর্জিয়াতে স্নেকহেড মাছকে সনাক্ত করার পর অক্টোবরের ৮ তারিখেই সেখানে জনসচেতনতা মূলক একটি সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

পানি ছাড়াও যে এই মাছ বেঁচে থাকতে পারে সেই কথা উল্লেখ করে ডিপার্টমেন্ট অফ ন্যাচারাল রিসোর্স (ডিএনপি) জনগণের উদ্দেশে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। মৃত স্নেকহেড দেখলেও সেটির ছবি তুলতে এবং সেটিকে ঠিক কোথায় পাওয়া গিয়েছে সেই বিষয়ে নোট নিতে তাগিদ দেয়া হয়েছে সেই নির্দেশনায়।

স্নেকহেড দমনের জন্য মার্কিন কর্তৃপক্ষ জনগণের সহযোগিতা চাইছেন। ফ্লোরিডায় স্নেকহেড মারার চেষ্টা করছেন দুজন জেলে।স্নেকহেড দমনের জন্য মার্কিন কর্তৃপক্ষ জনগণের সহযোগিতা চাইছেন। ফ্লোরিডায় স্নেকহেড মারার চেষ্টা করছেন দুজন জেলে।

জর্জিয়া ডিএনপির ফিশিং অপারেশন্স ম্যানেজার স্কট রবিনসন বলেছেন, “এটি একটি দুরূহ কাজ হলেও এদের সবগুলোকেই খুঁজে বের করা হবে। এখানে এরা প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাবে না।”

পানি ছাড়া এই মাছ বাঁচে কী করে?

ডাঙ্গাতেও কী করে এই মাছ বেঁচে থাকতে পারে সেই বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের এভলিউশনারি ইকোলজি এন্ড একোয়াটিক বাইয়োলোজি বিভাগের অধ্যাপক মার্টিন জেনার।

“এশিয়াতে, তাদের নিজস্ব প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলে এই মাছটি সাধারণত কম অক্সিজেনপূর্ণ পরিবেশে যেমন ধানক্ষেতে বা পানিতে অর্ধেক ডুবে থাকা বনাঞ্চলে থাকে”, ব্যাখ্যা করছিলেন মি. জেনার।

 

স্নেকহেডের শরীরে অক্সিজেন জমিয়ে রাখার ব্যবস্থা আছে। এ কারণে এটি পানির বাইরেও তিনদিন পর্যন্ত বাঁচতে পারে।স্নেকহেডের শরীরে অক্সিজেন জমিয়ে রাখার ব্যবস্থা আছে। এ কারণে এটি পানির বাইরেও তিনদিন পর্যন্ত বাঁচতে পারে।

এরকম পরিবেশে থাকার কারণে এই মাছগুলোকে বিভিন্ন ধরনের অভিযোজন কৌশল আয়ত্বে আনতে হয়। মূলত এসব পরিবেশে এই মাছগুলো তাদের অক্সিজেন গ্রহণের পরিমাণকে সর্বোচ্চ বাড়িয়ে নেয়।

বাড়তি বায়ু

জেনার আরো বলছিলেন, এই জাতের মাছের গিল বা ফুলকার পেছনে বাতাসের একটি চেম্বার থাকে। এটিকে বলা হয় সুপ্রাব্রাঞ্চিয়াল চেম্বার।

সাধারণত, মাছেরা তাদের ফুলকার সাহায্যে দম নেয় এবং এর মাধ্যমেই অক্সিজেন আসা-যাওয়া করে।

মাছ পানির উপরিতলে উঠে আসতে এবং যে কোনো দিকে যেতে সক্ষম। তারপর তারা পানির গভীরে চলে যায় এবং অক্সিজেন ব্যবহার করে।

“কিন্তু এই স্নেকহেড মাছগুলো পানির উপরিভাগে উঠে এসে কিছু বায়ু বুকে ভরে নেয় এবং তারা একেবারে জলের গভীর তলানিতে নেমে যেতে পারে। সেখানে প্রয়োজন হলে তারা তাদের চেম্বারের অক্সিজেন ব্যবহার করে,” ব্যাখা করেন মি. জেনার।

ক্রলিং

স্নেকহেড মাছগুলো ডাঙ্গাতেও দম নিতে পারে। যার কারণে তারা আসলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করতে সক্ষম।

যখন নদী শুকিয়ে যায় তখন স্নেকহেড মাটির ওপর দিয়ে অন্য জলাশয়ের দিকে যেতে পারে।যখন নদী শুকিয়ে যায় তখন স্নেকহেড মাটির ওপর দিয়ে অন্য জলাশয়ের দিকে যেতে পারে।

ট্রপিক্যাল বা গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোতে জলাভূমিগুলো প্রায়শই শুকিয়ে যায়। তাই, মাছগুলোকে তখন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হয়।

“স্নেকহেড ডাঙায় চলাফেরা করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। এই কাজটি স্নেকহেড খুব কৌশলে করে। মাছগুলো পাখনা ব্যাবহার করে বুকে ভর দিয়ে এগিয়ে চলে। কিন্তু পানির বাইরেও একটা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তারা বেঁচে থাকতে পারে কারণ তারা ঢোক গেলার মাধ্যমে বায়ু গ্রহণ করে সেটিকে শ্বাসের কাজে লাগাতে পারে।”

তবে, মি জেনার বলছেন, স্নেকহেডই ডাঙ্গাতে বেঁচে থাকা একমাত্র মাছ নয়। ক্যাটফিশের মতন অন্য এমন আরো কিছু প্রজাতির মাছ রয়েছে যারা স্থলেও অক্সিজেন ব্যবহারে সক্ষম।

Catfishক্যাটফিশ হচ্ছে আরেকটি মাছ যেটি ডাঙ্গায় শ্বাস নিতে পারে

এছাড়া লাংফিশ-ও ডাঙাতে দম নিতে পারে। লাংফিশেরও মানুষের মতন ফুসফুস রয়েছে।

তবে, লাংফিশের ফুসফুস মানুষের মতন দম নেয়া ও দম ছাড়ার কাজ করে না। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ফুসফুসের ভেতর হাওয়া ভরে নেয় লাংফিশ এবং পরবর্তীতে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিলে তা ব্যাবহার করে।

গৌরামিস নামে আরেক জাতের মাছেরও ফুসফুসের মতন একটি অঙ্গ রয়েছে। সেটি ফুসফুসের মতই কাজ করে এবং দম নিতে সাহায্য করে। এই মাছগুলোও ডাঙায় স্বল্প দূরত্বে চলাফেরা করতে পারে।

কঠিন প্রতিযোগী

প্রতিকূলতা সহ্য করে টিকে থাকতে পারে স্নেকহেড। তাই, একে মোকাবেলায় তীব্র সতর্ক অবস্থানে জর্জিয়ার কর্তৃপক্ষ। যে সব ব্যক্তি জলাশয়ে ছিল এবং স্নেকহেডের সংস্পর্শে এসেছে তাদের সকল পোশাক-আশাক, যন্ত্রপাতি, নৌকা ও পোষা কুকুরকেও ভালো করে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে শুকিয়ে নেবার তাগিদ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

অন্য মাছের তুলনায় স্নেকহেডের অক্সিজেনের চাহিদা কমঅন্য মাছের তুলনায় স্নেকহেডের অক্সিজেনের চাহিদা কম

খাদক প্রকৃতির মাছ স্নেকহেড থাকলে অন্য প্রজাতির খাদ্য-শৃঙ্খলে ব্যাপক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অতি সামান্য অক্সিজেন হলেই স্নেকহেড জলাশয়ে টিকে থাকতে পারে বিধায় অন্যান্য প্রজাতির মাছ যেমন ট্রাউট ও ব্যাসের চেয়ে স্নেকহেড রয়েছে তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে।

তাই, এই মাছের ভয়ংকর ‘খ্যাতি’ ছড়িয়ে পড়েছে। এটিকে নিয়ে এমকি ইতোমধ্যেই একটি প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক। সেই তথ্যচিত্রের নাম দেয়া হয়েচে ‘ফিশজিলা’।