মুহাম্মদ আতিকুল ইসলাম 

শিক্ষার অর্থ কেবল ডিগ্রী ও ডিপ্লোমা অর্জন নয়। এর অর্থ হলো এমন জ্ঞান বা কৌশল অর্জন করা যা প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষ এ দুনিয়া এবং আখেরাতে শান্তিতে বাস করতে পারে। কত গুলি ডিগ্রী হাসিল করলেই মানুষকে শিক্ষিত বলা যায় না।এমন শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে যাতে মানুষ দুনিয়াতে মোটামুটি ভাল ভাবে সুখে শান্তিতে বাঁচতে পারে।আর পরকালে ও শান্তির উপাদান সঞ্চয় করতে পারে। অর্থাৎ এই জীবন এবং পরকালের জীবন এ দুই জীবনেই যাতে শান্তিতে থাকা যায়।

এমন প্রশিক্ষণ যে শিক্ষায় দেওয়া হয় তাই ইসলামী শিক্ষা বা প্রকৃত শিক্ষা সে কারণেই ইসলাম দৈহিক ( Physical) ও আত্মিক ( Spiritual) শিক্ষার সমন্বয় অনুমোদন করেছে। কেবল দৈহিক বাঁচার শিক্ষা Physical education লাভ করা এবং জগতে মহানন্দে বেঁচে থাকা Learn to live ইসলাম অনুমোদন করে না ইসলামের আদর্শ হলো Learn to earn এবং Earn to live happily both here and here after. আধুনিক পাশ্চাত্য আদর্শ হলো Eat Drink and be merry খাও দাও ফূর্তি করো।ইসলাম অনুমোদিত জীবন ধারণের আদর্শের বিপরীত। ইসলামের আদর্শ হলো Live and Let live নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচতে দাও। অপর বলতে নিকট আত্মীয় তার পর দূরবর্তী আত্মীয় তার পর এ ধারাই প্রসারিত হবে ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে জাতিতে এবং জাতি থেকে আন্তর্জাতিকতায়।

মহান আল্লাহ মানব জীবন প্রবাহে এ ধারার স্ফুরণ দেখতে চেয়েছেন।এরই নাম মানবতা Humanism মুরুওয়াত। এই মানবতার লালন যে শিক্ষায় নেই সে শিক্ষা আর যাই হোক মানুষের কাম্য নয়।

কবি বলেন:-

যে ফুলে গন্ধ নেই তাকে কে বা চায়

যে শিক্ষায় মানবতা নেই কী বা কাজ তায়?

পাশ্চাত্য শিক্ষা পদ্ধতির খপ্পরে পড়ে আমরা দুনিয়ার শিক্ষার প্রতি এতটা আকৃষ্ট হয়ে পড়ছি যে শিক্ষার মূল আদর্শই ভুলে গেছি।দুনিয়াদারী শিক্ষার যে প্রয়োজন নেই তা নয়।দুনিয়াদারী শিক্ষার খুব বেশি প্রয়োজন ডাক্তারী না শিখলে আমরা মানবতার সেবা করবো কী করে? ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষায় শিক্ষিত না হলে বৈজ্ঞানিক কৌশল প্রয়োগ করবো কী করে? আর এ ধরণের সব শিক্ষাই মানবতার সেবায় দেশ সেবায় প্রযুক্ত ইহকালীন প্রয়োজন।

আমাদের কথা হলো সকল বিদ্যা শিক্ষা করাই ফরয বা আবশ্যাক কিন্তু এর মধ্যে মহান আল্লাহ ও রাসুলুল্লাহ সা.এর প্রদর্শিত পথের পরিপূর্ণতা থাকাও ফরয বা কর্তব্য। যেহেতু মহান আল্লাহ ও তার রাসুলের বিধানে রয়েছে, মানবতার যাবতীয় সাফল্যের চাবিকাঠি। অন্যথায় সমাজ ভেঙ্গে পড়বে মানবিক ক্রাইসিসে ধ্বসে পড়বে সমাজ ব্যবস্থা। আর একথাটা স্পষ্ট বুঝতে হবে যে ধর্মহীন কর্ম পার্থিব শিক্ষা এবং পার্থিব শিক্ষাহীন ধর্ম শিক্ষা এ দুটিই অচল এবং ইসলাম অননুমোদিত। বিগত শতাব্দীর একজন পাশ্চাত্য মনীষী বলেছেন। The Technical education without Religion and Religious education without technical education is a farce.
“ধর্ম শিক্ষাহীন প্রকৌশলী শিক্ষা এবং প্রকৌশলী শিক্ষাহীন ধর্ম শিক্ষা উভয় অবাস্তব”। শিশুদের শৈশব থেকে কর্ম শিক্ষার সাথে সাথে ধর্ম শিক্ষা ও অবশ্য দিতে হবে এবং ধর্ম শিক্ষার সাথে সাথে কর্ম শিক্ষা ও দেওয়া উচিৎ। আমাদের দেশের উগ্র আধুনিক কতিপয় শিক্ষাবিদ শিশুদের ধর্ম শিক্ষা দিতে অনাগ্রহী। তাদের মতে মাতৃভাষা ওদ্বিতীয় ভাষা ইংরেজি শিখে এমনিতেই মাথা ভারি হয়ে যায়।এর সাথে আরবী ও ধর্ম বিদ্যা দান করলে মাথা ফেটে যাবে…!

এসব তথাকথিত সুশিক্ষিত ও মুরতাদদের বিধান অনুযায়ী যদি আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি নির্ধারিত হয় তাহলে মানবতা দূরীভূত হয়ে 0%জিরো পয়েন্টে আসতে বেশি দিন লাগবে না। তারা তো মাদরাসা শিক্ষাকে দেশের সর্বনাশা শিক্ষা বলে প্রচার করেন।এ বিষয়ে কালের অন্যতম শিক্ষা বিধান নিয়ামক জে.বি হলে এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য তিনি বলেন, If you give your children three RS! Reading writing and Arithmatic and don not give them the fourt R! Religion they will become the fift R! Rascal. অর্থাৎ আপনাদের শিশুদের যদি তিন আর অর্থাৎ পড়া, লেখা, অংক, শিখান চতুর্থ আর ধর্ম না শিখান তা হলে তারা পঞ্চম আর পাজী হয়ে যাবে। (ধর্ম বিমুখ)

ঋষি কবি টলষ্টল বলেছেন:- The man has only one God and that is money.
মানুষের একটাই ভগবান আর সেটি হলো অর্থ।
আমাদের নব্য তরুণ সমাজের চোখে পাশ্চাত্য সভ্যতার চাকচিক্যময় কৃত্রিম সৌন্দর্য এক অপরূপ রূপ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। সেখানে শুধু Eat Drink, and be merry. খাও দাও ফূর্তি করো।No চিন্থা Do ফূর্তি। শাস্ত্র অনুমোদিত জীবন সূত্র এই যে ঋণং কৃত্বা খর্তং পিবেৎ খাব্য জীবেৎ মুখেং জীবেৎ। ঋণ করে হলে ও ঘি খাও যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। এ জীবন ক্ষণিকের যতক্ষণ পারো ভোগ করে নাও পরে পস্তাবে। এই কি মনুষ্য জীবন? বিধান ছিলো মাধ্যমিক -উচ্চ মাধ্যমিক এর দরজা পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করবো এবং বিশ্ববিদ্যা শিক্ষার দ্বারপ্রান্তে পৌছাবো।

২০০১ সালে পত্রিকায় একটি কার্টুন দেখেছিলাম
।একটি মানব সন্তান কৈশোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গেট দিয়ে প্রবেশ করেছে ছ’বছর পর যুবকটি অন্য গেট দিয়ে গর্দভ হয়ে বের হচ্ছে। এ হচ্ছে শিক্ষাঙ্গনের দৃশ্য। শিক্ষার মান এতটা নিচে নেমেছে যে পিতা হয়ে এখন কুকুর হয়েছি। কারণ আমার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ার জন্য দরখাস্ত করেছে।মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় তাকে বলা হলো :আমার পিতার একটি কুকুর আছে একথাটি ইংরেজিতে বলো? ছেলে বিনা দ্বিধায় বলে ফেলল।My father is a dog. এই তো বিদ্যার মান। সত্য কথা বলতে কি অনেক বি.এ, এম.এ পাশ আসলে গেট পাস। বিদ্যার ঘরের দরজা প্রবেশের সনদ। তারপর বিদ্যার গৃহে প্রবেশ করেন।লেখাপড়া করে নিজেকে বিদ্ধান করুণ।কারণ বিশ্বের সকল সুশিক্ষিতরাই স্বশিক্ষিত। এতদিন বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে কেবল বিদ্যার রাজ্যে প্রবেশের চাবিকাঠির সন্ধান করা হয়েছে। আমরা সত্যিকার জ্ঞান অর্জনের পিছনে ঘুরি না সনদের মাধ্যমে চাকরির পিছনে ঘুরি।আমরা জ্ঞান সাধনার আদি নীতি ভুলে গেছি।

নীতিটি ছিলো:-
অধ্যবসায় দদআতি বিদ্যাং। বিদ্যা দদাতি বিষয়ং। বিনয় দাতি জ্ঞান। জ্ঞান দদাতি প্রজ্ঞাং। অধ্যবসায় দ্বারা বিদ্যা অর্জিত হয় বিদ্যায় অর্জিত হয় বিনয়। আর বিনয়ে জ্ঞান অর্জিত হয়।এবং জ্ঞানই প্রজ্ঞার দরজায় পৌঁছে দেয়।জ্ঞান হলো ইলম (Knowledge) আর প্রজ্ঞা হলো হিকমত (wisdom) আর এ ও সত্য যে Knowledge is pride and wisdom is humble.জ্ঞান যে অহংকারী বানায় ইবলিস তার প্রমাণ। তার জ্ঞান ছিলো কিন্তু তা প্রজ্ঞার পর্যায়ে পৌঁছেনি তাই তা তাকে বিনাশ করলো।আর প্রজ্ঞা বিনয়ী বানায় যে প্রজ্ঞার আলোকে জ্ঞানকে আলোকিত করার জন্য হযরত মুসা আ: কে খিজির আ:এর কাছে পাঠান হয়েছিলো।মুসা আ: মনে করেছিলেন তিনিই জ্ঞানই তার ওপর কেউ নেই। তিনি নবী মহান আল্লাহর সাথে কথা বলেন।

কিন্তু তার চাইতেও যিনি মহাজ্ঞানী তার কাছে হযরত মুসা আ:শিক্ষা পেলেন যে বিশ্বের অতীত বর্তমান ভবিষ্যত সকল কালের সকল দৃশ্য অদৃশ্য জ্ঞানের সমষ্টি একটি চড়ুই পাখির ঠোটে বিধৃত এক ফোটা পানি বাদ বাকি Knowledge বা ইলম অর্থাৎ জ্ঞান সীমাহীন সমুদ্রবৎ।আর এর পরবর্তী স্তর প্রজ্ঞা বা হিকমত (wisdom) আরো উন্নত আরো সূক্ষ।

আল্লাহতায়ালা ইলমে লাদুন্নীর পর্যায়ের স্তরকে wisdom বা প্রজ্ঞা বলা হয়েছে। স্বরণ রাখতে হবে ইলম অর্জন হয় মহান আল্লাহর
রহমত প্রাপ্তির সহায়ক হয়।কারণ রাসুলুল্লাহ সা.বলেছেন:আল্লাহু ইউতিহী ও আনা ঊক্বসিমুহু অর্থাৎ মহান আল্লাহ ইলম দান করেন আর আমি তা বন্টন করি।প্রকৃত শিক্ষায় জ্ঞানের মোহ বা ইলমের অহম ভাব দূর করে প্রজ্ঞার বা হিকমতের পথ প্রদর্শন করে। যে বিদ্যা অতদূর পৌঁছায় না সে বিদ্যা ভয়ংকারী। তা মানুষ কে ধ্বংসের নিম্নপর্যায়ে নিয়ে যায়। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে আসমানী তথা ধর্মভিত্তিক জ্ঞান অর্জন করে আদর্শ মানুষ হয়ে সমাজের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে সফল হওয়ার তাওফিক দান করুন…..আমীন।

লেখক:-গবেষক,সেক্রেটারি,আল-কোরআন ফাউন্ডেশন।পেকুয়া, কক্সবাজার।
E-mail:-m.atikulislam2019gmail.com