অসাধারণ জীববৈচিত্র্যের আধার অনিন্দ্য সুন্দর প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনস বিগত দশকগুলোতে বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। মাত্র ৮ বর্গকিলোমিটারের দ্বীপ হলেও সেন্ট মার্টিনসের গুরুত্ব অনেক। সামুদ্রিক শৈবালে সমৃদ্ধ দ্বীপটিতে এ পর্যন্ত ১৫১ প্রজাতির শৈবাল শনাক্ত করা হয়েছে। সেখানকার বেশিরভাগ সামুদ্রিক প্রাণী খাদ্য ও প্রজননের জন্য শৈবালের ওপর নির্ভরশীল। দ্বীপটিতে ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া ও দ্বীপসংলগ্ন সাগরে ২৩৪ প্রজাতির মাছ রয়েছে। জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার তথ্যানুসারে দ্বীপটিতে ১৮২টি বন্য জীব প্রজাতির অস্তিত্ব চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৪টি প্রজাতি উভচর গোত্রের, ২৮টি সরীসৃপ, ১৩০টি পাখি এবং স্তন্যপায়ীর প্রজাতির সংখ্যা ২০টি। কিন্তু শতাধিক বছর ধরে গড়ে ওঠা জনবসতি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং শীতকালীন পর্যটন মৌসুমে উপচেপড়া পর্যটকের ভিড়ে সেন্ট মার্টিনসের জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৫ সালে সরকার সেন্ট মার্টিনস দ্বীপকে সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে।
বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় গত বছর এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল যে, ২০১৯ সালের অক্টোবর মাস থেকে পর্যটকদের জন্য সেন্ট মার্টিনসে রাত কাটানো নিষিদ্ধ করা হবে। কিন্তু সেন্ট মার্টিনস-টেকনাফ রুটে চলাচলকারী যাত্রীবাহী জাহাজের মালিক, পর্যটক, দ্বীপের হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিক ও বাসিন্দাদের চাপে এ সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি সরকার। তবে, সরকার সেন্ট মার্টিনসের সুরক্ষায় পর্যটকদের ভ্রমণ সীমিত করাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে ২০২৫ সালের মধ্যে সেন্ট মার্টিনসের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তির মালিকানা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার পাশাপাশি বাসিন্দাদের অন্যত্র পুনর্বাসন করতে বলা হয়েছে। এছাড়া দ্বীপের ছেঁড়াদিয়া অংশে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা ছাড়াও এক বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য ৯ দফা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে সেন্ট মার্টিনসে নতুন রাস্তা নির্মাণ, নাফ নদী ও দ্বীপে যাতায়াত এবং মূল দ্বীপে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা, দ্বীপের সৈকতে মোটরসাইকেল চালনা, দ্বীপে রাতে আলো জ্বালানো নিষিদ্ধ করা অন্যতম। এছাড়া আগামী তিন বছরের মধ্যে দৈনিক পর্যটকের সংখ্যা ৫০০ জনে নামিয়ে আনা ও দুটির বেশি জাহাজ চলাচল করতে না দেওয়া; দ্বীপে জেনারেটর ব্যবহার নিষিদ্ধ করে শুধু সৌরশক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি ভ্রমণের জন্য নির্দিষ্ট ফি দিয়ে অনলাইনে নিবন্ধন করে দ্বীপে যেতে হবে পর্যটকদের।
মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে এখন শীতকালে দ্বীপটিতে প্রতিদিন ৫-৭ হাজার পর্যটক ভ্রমণ করেন। গত তিন দশকে দ্বীপের কেয়াগাছ ও ঝোপঝাড় ধ্বংস করে ৬৬টি কটেজ, ১৯টি একতলা, ১৬টি দোতলা, ৫টি তিনতলা এবং একটি চারতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁগুলোর কোনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই এবং একমাত্র হাসপাতালের বর্জ্যওে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। হোটেল-মোটেলের জেনারেটরের শব্দে কাছিম, পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর বিশ্রামে সমস্যা ও বংশবিস্তার ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দ্বীপের ভূগর্ভস্থ পানিতে মারাত্মক কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। এছাড়া পাম্প ব্যবহারের কারণে দ্বীপে পানির স্তর দ্রুত নিচে নামছে এবং ছোট্ট ম্যানগ্রোভ বনও ধ্বংস হচ্ছে। দ্বীপের মিঠাপানি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে ও প্রবাল মরে যাচ্ছে।
উপরোক্ত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটির সুরক্ষায় সরকার যে পরিকল্পনা করেছে তাকে ইতিবাচকই বলতে হবে। পর্যটকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণসহ পরিবেশবান্ধব আচরণবিধি মেনে চলার জন্য সবাইকে অবশ্যই সচেতন করে তুলতে হবে। তবে, সেখানকার সব বাসিন্দাকে সরিয়ে এনে দ্বীপটিকে পুরোপুরি জনশূন্য করে ফেলা হবে না কি বাসিন্দাদের সংখ্যাও সীমিত করা হবে সে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটসহ মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সেন্ট মার্টিনস নিয়ে নিরাপত্তাজনিত কোনো উদ্বেগ সৃষ্টি হলে তা অবশ্যই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। দ্বীপের বাসিন্দা, পর্যটনকেন্দ্রিক নানা ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ এবং পর্যটকসহ দেশের সব নাগরিককে অবশ্যই সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের অস্তিত্ব ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার বিষয়টিকে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের বিবেচনাতে দেখতে হবে। তাহলেই কেবল দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটির সুরক্ষা নিশ্চিত হবে এবং সমুদ্রমাতৃক বাংলাদেশ আগামী প্রজন্মের জন্য নিজেদের এ প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে।
—দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয়: ৬ অক্টোবর, ১৯ ইং