বিবিসি বাংলা:

বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের শীর্ষ দু’জন নেতাকে চাঁদাবাজির অভিযোগে সরিয়ে দেয়ার পর এ নিয়ে এখন নানা আলোচনা চলছে।

বিশ্লেষকদের অনেকে বলেছেন, ক্ষমতাসীনদের সাথে থাকা ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত থাকে বলে বিভিন্ন সময় যে অভিযোগ ওঠে, এবারের পরিস্থিতি সেই ধারণা বা অভিযোগ প্রমাণ করেছে।

তারা মনে করেন, চাঁদাবাজির অভিযোগে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদককে পদ ছাড়তে হয়েছে, এটি ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগকেই ভাবমূর্তির সংকটে ফেলেছে।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, ছাত্রলীগের দুই নেতাকে সরিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দল এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতৃত্বের প্রতি হুঁশিয়ারি বার্তা দিয়েছেন।

ছাত্রলীগের ইতিহাসে প্রথম

চাঁদাবাজির অভিযোগে ছাত্রলীগের শীর্ষ দু’জন নেতার পদ হারানোর ঘটনা সংগঠনটির দীর্ঘ ইতিহাসে এই প্রথম ঘটলো।

আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলটির নীতিনির্ধারকদের এক বৈঠক হয় গত শনিবার। সেই বৈঠক থেকে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।

সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে আল নেহিয়ান খান এবং ভারপ্রাপ্ত সাধাণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য রোববার সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ছাত্রলীগ চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ বা কোন অন্যায়কারীকে প্রশ্রয় দেবে না।

বিশ্লেষকদের অনেকে বলেছেন,ছাঁদাবাজির মতো গুরুতর অপরাধের অভিযোগ নিয়ে শীর্ষ নেতাদের সরে যেতে বাধ্য হওয়ার ঘটনা ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগকে ভাবমূর্তির সংকটে ফেলেছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড: আকতার বানু বলছিলেন, নেতৃত্বের এই অন্যায়ের জন্য ছাত্র সংগঠনটিকে নিয়েই সাধারণ ছাত্রদের মাঝে একটা খারাপ ধারণা তৈরি হতে পারে।

“পুরো ঘটনাটি নি:সন্দেহে খুবই বিব্রতকর। কারণ এটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো যে, ছাত্রনেতারা এইসব করছেন। যদি না করতেন, তাহলে এমন অভিযোগও আসতো না। তাদের পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটতো না।”

“পাশাপাশি একটা ভাল দিকও আছে যে, প্রধানমন্ত্রী কারও কথায় কান না দিয়ে পরিস্থিতিটার লাগাম টেনে ধরার জন্য এমন একটা উদ্যোগ নিয়েছেন, সেটা খুবই ইতিবাচক।”

ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা

ভাবমূর্তি সংকট

ছাত্রলীগের নেতাকর্মিদেরও অনেকে মনে করেন, পুরো ঘটনাটি তাদের সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে।

ছাত্রলীগের ঐ দু’জন নেতার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠে। তবে তাদের সরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে বড় ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন প্রকল্প থেকে বড় অংকের চাঁদা দাবির অভিযোগকে।

বিষয়টি আওয়ামী লীগকেই ভাবমূর্তির সংকটে ফেলেছে বলে দলটির নেতাদের অনেকে মনে করেন।

তবে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সিনিয়র মন্ত্রী ড: আব্দুর রাজ্জাক বলছিলেন, ভাবমূর্তি সংকটের বিষয়টি সাময়িক বলে তিনি মনে করেন।

“সাময়িকভাবে হয়তো মানুষ বলবে যে ছাত্রলীগে আগে কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি। তবে আমি মোটেই মনে করি না যে ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে। ছাত্রলীগ একটা আদর্শ সংগঠন হিসেবে সবসময় ভাবমূর্তি ধরে রেখেছে।”

একইসাথে তিনি বলেছেন, “কিছু অনিয়ম হয়। তবে এবার এটা ব্যাপক পর্যায়ে গিয়েছে বলেই আমাদের দলের সভানেত্রী এবং আমরা সবাই মিলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

যুবলীগের কয়েকজন নেতার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ

ড: আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, তাদের নেত্রী আরও দু’একটি সহযোগী সংগঠনের ব্যাপারেও বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করেছেন।

“ছাত্রলীগের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু এই বার্তাটা আমার জন্যও প্রযোজ্য এবং আমাদের দলের ও সহযোগী সংগঠনের সকলের জন্য অত্যন্ত জোড়ালো বার্তা।”

“আরও দু’একটা সহযোগী সংগঠন সম্পর্কে উনি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলেছেন যে, প্রচলিত আইনে সবাইকে দেখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, চাঁদাবাজি করবে অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াবে, আবার আমার দীর্ঘায়ু কামনা করে দোয়া করবে, এটা হয় না। চাঁদাবাজি করে যদি সেই টাকা দিয়ে মিলাদ করে দোয়া করে, সেই দোয়ায় কি আমার দীর্ঘ জীবন হবে নাকি সর্বনাশ হবে। এই ধরণের কথাও কিন্তু কালকে উনি বলেছেন।”

আওয়ামী লীগের অন্য একাধিক সূত্র বলছে যে, যুবলীগের ঢাকা নগরীর একাধিক নেতার ব্যাপারে দলীয় সিনিয়র নেতাদের কাছে প্রধানমন্ত্রী এমন মন্তব্য করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী কী অন্যদেরও কোন বার্তা দিলেন?

আওয়ামী লীগ নেতা ড: আব্দুর রাজ্জাক যেমনটা বলছিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী একটা বার্তা দিলেন।

বিশ্লেষকরাও একই ধারণা করছেন।

৬০ এর দশকের মাঝামাঝি ডাকসু’র ভিপি ছিলেন অধ্যাপক মাহফুজা শফিক। তিনি পরিস্থিতিটাকে দেখছেন ভিন্নভাবে। তিনি মনে করেন, শুধু ছাত্রলীগ নয়, প্রধানমন্ত্রী সকলকে হুশিয়ার করে একটি বার্তা দিলেন।

“আমি টেন্ডারবাজি বা মাদকের সাথে যুক্ত হতে পারি না। আমি কোন অন্যায় করতে পারি না। এই বার্তাটি প্রধানমন্ত্রী দিলেন ছাত্রলীগ, দল এবং এমপি, মন্ত্রী সবার প্রতি।”

বিশ্লেষকদের অনেকে এটাও বলেছেন যে, আওয়ামী লীগ এখন টানা তৃতীয়দফায় ক্ষমতায় রয়েছে।এই লম্বা সময় একটি দল ক্ষমতায় থাকার কারণে দল এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর অনেকের লোভ বা স্বার্থের বিষয়গুলো সামনে আসছে। সেজন্য হয়তো প্রধানমন্ত্রী একটা কঠোর অবস্থান তুলে ধরছেন।

এদিকে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত নেতারা বলেছেন, ভাবমূর্তি সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে তারা তাদের কর্মকাণ্ড স্বচ্ছ রাখার চেষ্টা করবেন।