অনলাইন ডেস্ক:

আসন্ন নির্বাচনে জিতলেই ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের জর্ডান উপত্যকা দখলের ঘোষণা দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। নির্বাচনের ঠিক সাত দিন আগে মঙ্গলবার এক টেলিভিশন ভাষণে তিনি এ ঘোষণা দেন।

নেতানিয়াহু বলেন, নির্বাচনে জিতে উত্তর মৃত সাগর (ডেড সি) ও জর্ডান উপত্যকা দখল ছাড়াও পশ্চিম তীরের সব এলাকায় ইহুদি বসতি স্থাপন নিশ্চিত করা হবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরামর্শেই এ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হবে বলে তিনি জানান।

আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এর এক সপ্তাহ আগে নেতানিয়াহু কেন এমন ঘোষণা দিলেন? কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল জর্ডান উপত্যকা?

বিবিসি বাংলা জানায়, ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের ৩০ ভাগ এলাকা জুড়ে হচ্ছে উত্তর মৃত সাগর (ডেড সি) ও জর্ডান উপত্যকা।

১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে জর্ডান উপত্যকার অধিকাংশ ইসরায়েলের সামরিক এবং প্রশাসনিক দখলে চলে যায়। ইসরায়েল ওই যুদ্ধে বিপুলভাবে জয়ী হয়।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত জর্ডান উপত্যকায় ৬৫ হাজার ফিলিস্তিনি এবং ১১ হাজার অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীর বসবাস।

এখানকার কৃষি, ফসল উৎপাদন, বাজার ব্যবস্থা, রপ্তানি সবই ইসরায়েলিদের নিয়ন্ত্রণে। সবদিক দিয়ে তারাই অধিক সুবিধা ভোগ করে।

পশ্চিম তীরের উর্বর কিন্তু অনুন্নত এক চতুর্থাংশ বিস্তৃত এই এলাকাকে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখা হয়। তবে ইসরায়েল বলছে, নিরাপত্তার কারণে তারা এই উপত্যকা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।

ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকে ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে দেখা হয়, যদিও ইসরায়েল তা অস্বীকার করে আসছে।

২০টিরও বেশি বসতির প্রতিনিধি আঞ্চলিক কাউন্সিলের প্রধান ডেভিড এলহায়ানি বলেন, “জর্ডান উপত্যকার মীমাংসার জন্য সরকার আমাদের পাঠিয়েছে।”

তিনি বলেন, “একজন ইহুদি হিসেবে আমি আপনাকে বলতে পারি আমরা কোনো ঝুঁকি নিতে পারি না। জর্ডান উপত্যকা ইসরায়েলি সার্বভৌমত্বের অধীনেই থাকতে হবে। আমি বাইবেল থেকে আমাদের দাবির বিষয়ে বলছি না। আমি বলছি নিরাপত্তার কথা। এখানে অবস্থানের মাধ্যমে আমরা তেল আবিব এবং ইসরায়েলের সব মানুষকে রক্ষা করছি। ইসরায়েল এবং আরব দেশগুলোর মধ্যে কিছু একটা ঘটবে, এটা হলো তার প্রতিরক্ষা রেখা।”

ফিলিস্তিনিদের দ্বারা পশ্চিম তীরের সঙ্গে যোগাযোগে ব্যবহৃত হতে পারে জর্ডানের একমাত্র ক্রসিং অ্যালেনবাই ব্রিজের নিয়ন্ত্রণও ইসরায়েলি সীমান্ত-রক্ষা কর্তৃপক্ষের হাতে।

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার শান্তি আলোচনার তথ্যের অনুপস্থিতি থাকলেও তা দুই পক্ষের নেতাদের জর্ডান উপত্যকা সম্পর্কে তাদের দীর্ঘদিনের অবস্থাকে টলাতে পারেনি।

বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে হিসাব দেখানো হয়েছে যে, দক্ষিণাঞ্চলীয় ডেড সি বা মৃত সাগরের খনিজ সম্পদকে কাজে লাগাতে পারলে ফিলিস্তিনি অর্থনীতি এক বছরে ৯১৮ মিলিয়ন ডলার বেড়ে যাবে।

রিপোর্টে আরও বলা হয়, ইসরায়েলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকা পশ্চিম তীরের বিভিন্ন অংশে কৃষিজমি এবং পানি সম্পদের আরও অধিকার পেলে ফিলিস্তিন বছরে আরও ৭০৪ মিলিয়ন ডলার যোগ করতে পারবে।

জর্ডান উপত্যকা অঞ্চলটি সবচেয়ে বড় একক অংশ নিয়ে তৈরি যা ‘সি অঞ্চল’ হিসেবে পরিচিত-ইসরায়েলের এই অংশে ১৯৯৩ সালে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি চুক্তির অধীনে চূড়ান্ত শান্তি চুক্তি ঝুলে আছে।

মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনার একজন প্রতিনিধিত্বকারী টনি ব্লেয়ার বলেন, “সি অঞ্চলে, যে অঞ্চলটি পশ্চিম তীরের ৬০ শতাংশ, ফিলিস্তিনিরা তার উন্নয়নে ধাপে ধাপে সক্ষমতা অর্জন করেছে।”

তিনি বলেন, “জর্ডান উপত্যকায় প্রচুর উর্বর কৃষি জমি রয়েছে। খোলাখুলি-ভাবে এটা প্রত্যক্ষ করা কঠিন যে, ভবিষ্যতে আপনি এমন একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র পেতে চলেছেন যার অন্তর্গত এটি নেই।”

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি আলোচনা চললেও জর্ডান উপত্যকার মানুষ উদ্বেগে-অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন।

অতীতেও নেতানিয়াহু এই উপত্যকা ধরে রাখার ব্যাপারে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তার পূর্বসূরি আরেক ইহুদি প্রধানমন্ত্রী আইজেক রবিনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে গত অক্টোবরে পার্লামেন্টে জর্ডান উপত্যকা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।

একই ভাবে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস একটি নতুন পুলিশ একাডেমিতে সদ্য স্নাতক পাস শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলীয় সীমানা, মৃত সাগর থেকে শুরু করে জর্ডান উপত্যকা এবং মধ্য উচ্চভূমি হয়ে উত্তর ইসরায়েলের বিসান হয়ে ফিলিস্তিনি-জর্ডানি সীমান্ত এবং তেমনই বহাল থাকবে।”

এদিকে ইসরায়েলি দখলদারি নিয়ে চিন্তিত উপত্যকাটির ফিলিস্তিনি বাসিন্দারা।

আবু আল আজাফা গ্রামটি এখন যে কোনো সময় গুঁড়িয়ে দেওয়া হতে পারে এমন আতঙ্কে স্থানীয় বাসিন্দারা। একজন বয়স্ক নারী জামিলা আদেইস তাই ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।

নিকটবর্তী মাসুয়া বসতি এলাকা দেখিয়ে তিনি বলেন, “ইসরায়েলিরা চায় না যে আমরা এখানে থাকি। লাথি মেরে তারা আমাদের উৎখাত করে দিতে চায় এবং বসতি স্থাপনকারীদের এই জমি দিয়ে দিতে চায় যাতে করে তারা খেজুর গাছ চাষ করতে পারে।”

যদিও ফিলিস্তিনি শ্রমিকেরা এই সব বসতি নির্মাণে কাজ করছে, তবে সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে অস্বস্তিপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করছে।

এবং গত মাসে জর্ডান উপত্যকায় ব্রোশ হাবিকা সম্প্রদায়ের একজন ইসরায়েলি সেটেলারের হত্যা এবং সন্দেহভাজন ফিলিস্তিনিকে গ্রেপ্তারের পর উত্তেজনা কেবল আরও তীব্র হয়েছে।