নিউজ ডেস্ক:
সম্প্রতি এক রোহিঙ্গা মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের পর রোহিঙ্গাদের চাহিদা বা মর্যাদা নিয়ে নতুন করে আলোচলা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের আসল মর্যাদা কী? তারা কি শরণার্থী, নাকি শুধুই আশ্রয়প্রত্যাশী? আর বাংলাদেশে তাদের অধিকারইবা কতটুকু?

বাংলাদেশের আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের অধিকার, সুযোগ সুবিধা, চাহিদা ও তাদের মর্যাদা দিয়ে বিবিসি বাংলা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে রোহিঙ্গা বিষয়ে নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে।

সারা বিশ্বে শরণার্থীদের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করতে ১৯৫১ সালে জাতিসংঘ একটি কনভেনশন গ্রহণ করে, যা ১৯৬৭ সালের প্রটোকল হিসাবে সংশোধিত হয়। তবে বাংলাদেশ ওই কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। ফলে বিশ্বব্যাপী শরণার্থীদের জন্য যেসব অধিকার বা সুবিধা নিশ্চিত করতে হয়, সেগুলো করার জন্য বাংলাদেশের সরকারের ওপর বাধ্যবাধকতা নেই।

এ বিষয়ে শরণার্থী ও অভিবাসী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেছেন, ওই কনভেনশনে স্বাক্ষর না করলেও বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ এবং সে কারণে বাংলাদেশ আশ্রয় প্রত্যাশীদের অনেকগুলো অধিকার নিশ্চিত করতে বাধ্য।

তিনি আরও বলেন, শরণার্থী কনভেনশনে একটা আন্তর্জাতিক দায়-দায়িত্ব থাকে, সেখানে সরকারের বেশ কিছু অধিকার নিশ্চিত করতে বাধ্যবাধকতা থাকে। কেউ আশ্রয়প্রার্থী হলে পুরোপুরি শরণার্থী বিষয়ে সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত তার দায়িত্ব নিতেও সরকার বাধ্য থাকে। কিন্তু শরণার্থী মর্যাদা দেয়া না হলে সরকার এসব দায়িত্ব পালন এড়িয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ফরেনার্স অ্যাক্ট অনুসারে। বাংলাদেশে শরণার্থীদের ব্যাপারে কোনো আইন নেই। শরণার্থীদের ব্যাপারে নির্দিষ্ট আইন ও বিধিবিধান জারির আবেদন জানিয়ে ২০১৭ সালে সেপ্টেম্বরে হাইকোর্টে নিদের্শনা চেয়ে রিট পিটিশন করেছিলেন একজন আইনজীবী। তবে সেই রিটের এখনো রায় হয়নি।

এছাড়া বিহারী জনগোষ্ঠী আর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ঘটনা ছাড়া বাংলাদেশে শরণার্থী হিসাবে আবেদনের খুব একটা নজির নেই। জাতিসংঘের সহায়তায় এক সময় আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ক্ষেত্রে শরণার্থী মর্যাদা দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে অবশ্য তাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়।

রোহিঙ্গারা কি শরণার্থী?
সনদে স্বাক্ষর না করলেও ১৯৯২ সালে যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছিলেন (প্রথম দফায়) তাদের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে শরণার্থী মর্যাদা দেয়া হয়েছিল। এ কার্যক্রমে সহায়তা করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা। এদেরকে কক্সবাজারের দু’টি ক্যাম্পে রাখা হয়।

তবে এর কিছুদিন পরেই আরও দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। কিন্তু তাদেরকে আর শরণার্থী মর্যাদা দেয়া হয়নি। শরণার্থী মর্যাদা না পেলেও সরকারি দু’টি ক্যাম্পের বাইরে আশপাশে ঘর বানিয়ে তারা বসবাস করতে শুরু করেন।

২০১৭ সালের আগস্টের পর যে প্রায় ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন। তাদেরকে ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক’ বলে বর্ণনা করছে বাংলাদেশ সরকার। তাদেরকে শরণার্থী মর্যাদা দেয়া হয়নি।

শরণার্থী মর্যাদা থাকা কতটা জরুরি
শরণার্থী ও অভিবাসী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর এ বিষয়ে বলছেন, ‘শরণার্থী মর্যাদার ব্যাপারটা আসলে একটা স্বীকৃতি দেয়া যে, তুমি তোমার দেশে বিপদে আছো, সেখানে যেতে পারছো না, তাই তোমাকে এখানে থাকতে দেয়া হলো। যখন আপনি কাউকে থাকতে দেবেন, তখন তো তার দরকারি চাহিদাগুলো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন ইত্যাদি সুবিধাও আপনাকে দিতে হবে।’

তবে বাংলাদেশের সরকার চায় না যে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে থেকে যাক। এ কারণেই এ ইস্যুতে সরকার শরণার্থী মর্যাদা দিতে চায় না বলেও তিনি মনে করেন।

তিনি আরও বলেন, যে টার্ম সরকার ব্যবহার করছে ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত নাগরিক’ -এটি ব্যবহারের ফলে তাদের ফেরত পাঠানোর একটি চাপ থাকবে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও তাদের স্থায়ীভাবে থাকার পরিবেশ তৈরিতে আগ্রহী নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন এ বিষয়ে বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান কিন্তু বিদেশি নাগরিকদের দায়িত্ব নেয়ার কথা বলে না।

তিনি বলেন, আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এ ১০ লাখের বেশি মানুষকে আমরা দেশের মেইনস্ট্রিমে মিশিয়ে নিতে চাই কি না, নাকি তাদের মিয়ানমারে, তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে চাই। এখন যদি তাদের এখানে পড়াশোনার সব ব্যবস্থা করে দেয়া হয়, নাগরিকদের মতো সব সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তারা আর নিজেদের দেশে ফেরত যেতে চাইবেন না।

তবে সেই সঙ্গে তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যাপারটিও নিশ্চিত করা দরকার। সে জন্য ক্যাম্পের ভেতরেই তাদের উপযুক্ত ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে -বলেন লাইলুফার ইয়াসমিন।

শরণার্থী হলে কী সুবিধা পাওয়া যাবে
আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, মালয়েশিয়ায় যে রোহিঙ্গারা শরণার্থী মর্যাদা পেয়েছেন, তাদের একটা কার্ড ইস্যু করা হয়। সেটি দেখিয়ে তারা সেখানে কাজ করতে পারেন, পড়াশোনা করতে পারেন, যদিও স্থানীয় বাসিন্দাদের তুলনায় কিছুটা পার্থক্য থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে বিষয়টা তেমন নয়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা সেখানকার স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারে। এ বেশি পড়ার অনুমতি তাদের নেই। আবার ক্যাম্পের বাইরে চাকরি বা কাজের সুযোগ নেই। যাতায়াতের ক্ষেত্রেও সবসময় পাস বা অনুমতির দরকার হয়।

জেনেভা ক্যাম্পে যেসব আটকে পড়া পাকিস্তানি ছিলেন, তাদের জাতিসংঘের সহায়তায় অর্থ ও খাদ্য সহায়তা দেয়া হতো। পরবর্তীতে অবশ্য তারা স্থানীয় চাকরি ও ব্যবসায় জড়িত হয়ে যান। যে রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে কয়েকশ জন তৃতীয় দেশে বসবাসের সুযোগ পান।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের অতিরিক্ত কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, দুই ধরনের রোহিঙ্গা এখানে রয়েছেন। কিছু রোহিঙ্গার শরণার্থী মর্যাদা আছে, বাকিদের নেই। যদিও সবাই হয়তো তাদের শরণার্থী বলছেন, কিন্তু কনভেনশনের হিসাবে সবাই শরণার্থী নন। তবে সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে সেটা আর আলাদা বলার সুযোগ নেই।

তিনি আরও বলেন, শরণার্থী হিসাবে যে অধিকারগুলো পাওয়ার কথা, সেটা এখন সবাই সমানভাবে পাচ্ছেন। সুতরাং তাদের মধ্যে আমরা সুযোগ সুবিধার খুব একটা পার্থক্য দেখতে পাই না।