বাংলা ট্রিবিউন:
‘পুলিশ ভেরিফিকেশনের দায়িত্ব আপনি নিলে একটি সাধারণ পাসপোর্টের জন্য আমাকে ৫ হাজার টাকা দিতে হবে। যদি পুলিশ ভেরিফিকেশন আমাকে দেখতে হয়, তাহলে ৭ হাজার ৩০০ টাকা দিতে হবে। এরচেয়ে কম হলে হবে না। এ টাকা দিলে আপনাকে আর কোনও টেনশন করতে হবে না। পাসপোর্ট হাতে পেয়ে যাবেন।’ এভাবেই টাকার বিনিময়ে পাসপোর্ট করে দেওয়ার কথা জানালেন চট্টগ্রামের মনসুরাবাদ বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের দালাল সাইফুল। তবে পুলিশ বলছে, আগে এ ধরনের দু-একটা ঘটনা ঘটলেও এখন এমন হয় না।

রবিবার (৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে পাসপোর্ট আবেদনকারী পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে কথা বললে এই প্রতিবেদককে এসব কথা বলেন সাইফুল।

পাসপোর্ট করে দিতে বললে তিনি প্রথমেই বলেন, ‘আপনি কি চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা? যদি স্থায়ী বাসিন্দা না হন, তাহলে আপনাকে দুই জায়গায় ভেরিফিকেশন করাতে হবে। এজন্য আপনাকে ৭ হাজার ৩০০ টাকা দিতে হবে। একটি জায়গায় ভেরিফিকেশন করতে হলে ৬ হাজার ১০০ টাকা দিতে হবে। যদি জরুরি ভিত্তিতে করতে হয়, তাহলে প্রতিটি পাসপোর্টের জন্য দিতে হবে ১২ হাজার টাকা।’

এভাবেই দালালকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিলে পুলিশ ভেরিফিকেশন ও পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে ঝামেলায়ও পড়তে হয় না। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে টাকার বিনিময়ে পাসপোর্ট করে নিচ্ছেন রোহিঙ্গারা। দালালরা পুলিশকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করায় ঠিকমতো ভেরিফিকেশন হয় না। ফলে পাসপোর্ট করতে এসে ধরা পড়ছে না রোহিঙ্গারা।

রোহিঙ্গারা কীভাবে পাসপোর্ট পাচ্ছে, এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে এমন চিত্র উঠে এসেছে। তবে এ কাজের পেছনে নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও জড়িত। কারণ নির্বাচন কমিশন থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে রোহিঙ্গারা পাসপোর্টের জন্য আবেদন করছে। আর জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে তাদের সহায়তা করেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

ভেরিফিকেশন ছাড়াই পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার এক বাসিন্দা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাস খানেক আগে দালালের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে একটি পাসপোর্ট করেছি। দালালকে টাকা দেওয়ার পর আমাকে আর কিছু করতে হয়নি। এক সপ্তাহ পর দালাল পাসপোর্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন।’

পাসপোর্ট করেছেন এমন একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, ভেরিফিকেশনের সময় পাসপোর্ট আবেদনকারীর কোনও তথ্যই সঠিকভাবে যাছাই-বাছাই করা হয় না। ভেরিফিকিশনের নামে পুলিশ আবেদনকারীর সঙ্গে দেখা করে শুধু টাকা নেওয়ার জন্য। আর এই টাকা দালালদের কাছ থেকে পেলে আবেদনকারীর সঙ্গে দেখাও করে না তারা।

অভিযোগ রয়েছে, ভেরিফিকেশনের সময় আবেদনকারীর ঠিকানায় গিয়ে তার বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ সময় পুলিশ তা করে না। আবেদনকারীকে হয় থানায়, না হয় সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার সুবিধামতো স্থানে গিয়ে দেখা করতে হয়। এ সময় তার কাছ থেকে চা-পানির খরচের কথা বলে টাকা নেয় পুলিশ। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আবেদনকারীকে নানাভাবে নাজেহাল করা হয়। টাকা না দিলে মাসের পর মাস চলে গেলেও ভেরিফিকেশন রিপোর্ট পাসপোর্ট অফিসে পাঠায় না পুলিশ। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও ঘটে। সবকিছু ঠিকঠাকভাবে যাছাই-বাছাই করা হয়।

গত ৫ জুলাই পাসপোর্ট আবেদন করেন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রী আফসান হাসান নেহা। ১৫ জুলাই পুলিশ তার বাসায় এসে ভেরিফিকেশন সম্পন্ন করার পর ২০ জুলাই তিনি পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন। তবে এ ধরনের ঘটনা সংখ্যায় অনেক কম।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার নূরে আলম মিনা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাসপোর্টের ভেরিফিকেশনে আমরা (পুলিশ) আবেদনকারীর বিষয়ে খোঁজ-খবর নিই। তার নাগরিকত্ব সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র ঠিক আছে কিনা এগুলো দেখা বাধ্যতামূলক নয়। এরপরও পুলিশ সদস্যরা ভেরিফিকেশনের সময় কাগজপত্রগুলো ঠিক আছে কিনা মিলিয়ে দেখেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন যদি মামলার তদন্তের মতো করা হয়, তাহলে আবেদনকারীকে পাসপোর্ট হাতে পেতে অনেক বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে। আবার সব বিষয় খতিয়ে দেখতে গেলে আবেদনকারীরা অভিযোগ করেন, পুলিশ টাকার জন্য তাদের নাজেহাল করছে। তাহলে পুলিশ সদস্যরা যাবে কোথায়? এক্ষেত্রে কারও গাফিলতি ধরা পড়লে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সুতরাং কোনও পুলিশ অফিসার চাইবে না, অন্যের জন্য সে বিপদে পড়ুক।’

নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) আব্দুল ওয়ারিশ বলেছেন, ‘এ ধরনের ঘটনা আগে ঘটতো। আগে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবেদনকারী তথ্য যাছাই-বাছাই ছাড়াই ভেরিফিকেশন রিপোর্ট পেয়ে যেতেন। কিন্তু সেটি এখন অনেক কমে গেছে। আমি বলবো মহানগরীতে এটি এখন শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে। তারপরও একেবারে দু-একটা হচ্ছে না, তা নয়। তবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আমি সংশ্লিষ্টদের পুলিশ সদস্যদের বলে দিয়েছি, যেন একটা ভেরিফিকেশন রিপোর্টও যাছাই-বাছাই ছাড়া না যায়।’

ভেরিফিকেশন রিপোর্ট দেওয়ার সময় টাকা নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, যেই পুলিশ সদস্য ভেরিফিকেশন করেন, তাকে সরকার বেতন দেয়। আর যাতায়াতের জন্য তিনি টিএডিএ পান। তাই ওই পুলিশ সদস্য কোনোভাবে আবেদনকারীর কাছ থেকে টাকা নিতে পারেন না। কেউ টাকা চাইলে তিনি বিষয়টি তাকে অবহিত করার অনুরোধ জানান।