বাংলা ট্রিবিউন: চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও বাঁশখালীর বনভূমি ও পাহাড়ি অঞ্চল এখন রোহিঙ্গাদের দখলে। বন উজাড় করে, পাহাড় কাটার পর এসব অঞ্চল মানুষের দখলে চলে যাওয়ায় আবাসন সংকটে বন্যপ্রাণীরা। বিশেষ করে, গভীর বনভূমি ও পাহাড় মানুষের বসবাসের উপযোগী করায় বন্যহাতি এসব অঞ্চল ছেড়ে ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। আক্রমণ করছে সাধারণ মানুষের বাড়িঘরে। বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল মানুষের দখলে চলে গেলে এমন পরিস্থিতি হতে পারে বলে আগে থেকেই আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন পরিবেশবাদীরা।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে হাতি গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক ড. রায়হান সরকার বলেন, ‘আইন অনুযায়ী বনভূমির এক কিলোমিটারের মধ্যে মানব বসতি থাকতে পারবে না। কিন্তু কেউ এই আইন মানছে না। এখন বনের ভেতরেই প্রচুর ঘরবাড়ি হচ্ছে। একসময় টেকনাফের করিডোর মিয়ানমারের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। বিচরণক্ষেত্রে খাদ্য সংকট দেখা দিলেই হাতি মিয়ানমারে চলে যেতে পারতো। যখন গাছপালা উঠতো আবার চলে আসতো।’

ড. রায়হান সরকার আরও বলেন, ‘এখন সেখানে হাতির করিডোর ব্লক করে রোহিঙ্গা ক্যাম্প হয়েছে। সীমান্তে কাঁটাতার ও ল্যান্ড মাইন বসানো হয়েছে। এসব হাতি চাইলেও এখন মিয়ানমার যেতে পারছে না। তাই রুট পরিবর্তন করে কিছু হাতি চুনতি অভয়ারণ্যে ঢুকে পড়েছে। খাদ্য সংকটের পাশাপাশি নতুন করিডোরের সন্ধানে হাতিগুলো এখন ছোটাছুটি করছে। এসব কারণে এখন মানুষ-হাতির সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে।’

সরকার ঘোষিত ২০১০ সালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, টেকনাফ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের আয়তন ছিল ১১ হাজার ৬১৫ হেক্টর। সাত বছরের মাথায় ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা বসতি গড়ে উঠলে টেকনাফ ও উখিয়ার প্রায় ছয় হাজার একর পাহাড় কেটে ফেলা হয়। যার বিরূপ প্রভাব পড়ে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্যের ওপর। আবাসস্থল ও বিচরণক্ষেত্র হারায় হাতিগুলো। স্থানীয় পরিবেশ, বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ায় পথ পরিবর্তন করে হাতিগুলো চট্টগ্রামের দক্ষিণ বন বিভাগের চুনতি অভয়ারণ্য হয়ে বাঁশখালী ও আনোয়ারার লোকালয়ে ঢুকে পড়ে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু চলতি বছরের জুলাই মাসে আনোয়ারা উপজেলায় ১২টি হাতির আক্রমণের ঘটনা ঘটে। উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়ন, মোহাম্মদপুর, হাজিগাঁও, পশ্চিম শোলকাটা, গুয়াপঞ্চক, বটতলী গ্রামে বন্যহাতির দল এসব আক্রমণ চালায়। এরমধ্যে ১০ জুলাই বৈরাগ ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামে হাতি আক্রমণ করে। ওইদিন হাতির আক্রমণে ওই এলাকার আলী হোসেনসহ কয়েকজনের ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর পরদিন ১১ জুলাই উত্তর হাজীগাঁও গ্রামে হাতি আক্রমণ করে। এদিন হাতির আক্রমণে ওই গ্রামের বেলায়েত হোসেনের ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৩ জুলাই মোহাম্মদপুর গ্রামে দ্বিতীয় দফায় হাতি আক্রমণ করে। এদিন হাতির আক্রমণে এই গ্রামের মনির উদ্দিনের ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৫ জুলাই এক দিনে আনোয়ারার গুয়াপঞ্চক, হাজীগাঁও গ্রামে হাতি আক্রমণ করে। ওইদিন হাতির আক্রমণে হাজীগাঁও গ্রামের নুরুচ্ছফা এবং গুয়াপঞ্চক গ্রামের আহমদ মিয়া ও মো. জুয়েল হকের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরদিন ১৬ জুলাই পশ্চিম শোলকাটা গ্রামে হাতির আক্রমণে অমৃত রঞ্জন দত্তের ঘরবাড়ি ও ফসলি জমির ক্ষয়ক্ষতি হয়। ২১ জুলাই গুয়াপঞ্চক এলাকায় হাতির আক্রমণে শহিদুল ইসলাম নামে একজন আহত হন। একই মাসে বাঁশখালীতে জাকের হোসাইন নামে একজন হাতির আক্রমণে মারা যান। ২১ জুলাই বাঁশখালীর নাপোড়া পূর্ব চালিয়াপাড়া গ্রামে হাতির আক্রমণে তিনি মারা যান। ২২ জুলাই আনোয়ারা উপজেলার মোহাম্মদপুর এলাকায় তৃতীয় দফায় হাতি আক্রমণ চালায়। এতে ওই এলাকার ওমর সুলতানের ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি ক্ষয়ক্ষতি হয়।

এর আগে গত জুন মাসে আনোয়ারা উপজেলায় ৭টি হাতির আক্রমণের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে ৩ জুন উত্তর হাজীগাঁও গ্রামে হাতি আক্রমণ করে। এতে ওই গ্রামের নুর নাহার বেগমের ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ২১ জুন গুয়াপঞ্চক এলাকায় হাতি আক্রমণ করে। একই দিন হাজীগাঁও এলাকায় দ্বিতীয় দফায় বন্যহাতি আক্রমণ চালায়। এদিন হাতির আক্রমণে গুয়াপঞ্চক এলাকার আব্দুল কাদেরের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে হাজীগাঁও গ্রামের সামসুদ্দিনের ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ২৬ জুন বন্যহাতির দল আনোয়ারার তিন জায়গায় আক্রমণ চালায়। এদিন হাতির আক্রমণে আনোয়ারার বটতলী গ্রামে মোমেনা খাতুন মারা যান। একই দিন হাজীগাঁও গ্রামের হোসনে আরা বেগম ও একই গ্রামের দুদু মিয়া হাতির আক্রমণে আহত হন।

এরআগে, ২০১৬ সালে হাতির আক্রমণে মারা যান একজন। ২০১৭ সালের মারা যান দুই জন। আর শুধু ২০১৮ সালে প্রাণ হারিয়েছেন ৫ জন।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রাকৃতিক সংরক্ষণ বিভাগ) আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ  বলেন, ‘হাতির করিডোরে ঘরবাড়ি নির্মাণ, গাছ কেটে বনভূমি উজাড় করার কারণেই লোকালয়ে হাতি আক্রমণ করছে। শুধু ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত হাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৭১ জন। এরমধ্যে মারা গেছেন ১৬ জন। হাতির আক্রমণে বাকিদের কেউ আহত হয়েছেন, কারও কারও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গা বসতির কারণে টেকনাফ এলাকায় বনভূমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। হাতির করিডোর নষ্ট হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন বসানো হচ্ছে। এই রেললাইনের কারণে হাতির করিডোর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’ তাই বন্যহাতি রুট পরিবর্তন করে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।