ডেস্ক ‍নিউজ:

পিবিআইপুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), একের পর এক ক্লু-লেস মামলার রহস্য উন্মোচন করে চলেছে। এমনও দেখা গেছে, মামলার তদন্ত করতে গিয়ে কুলকিনারা না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে পুলিশের অন্য ইউনিট। এ ধরনের মামলার তদন্তেও সাফল্য দেখিয়েছে পিবিআই। সম্প্রতি বেশ কিছু আলোচিত মামলার তদন্ত করে পিবিআই যেমন সবার নজর কেড়েছে, তেমনই তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বেড়েছে। আর এ কারণে পিবিআই মামলার তদন্তে নতুন ধারা নিয়ে এসেছে। এমনকি ভিকটিমের বক্তব্য শুনে অপরাধীর ছবি আঁকার জন্য আর্টিস্টের পদ সৃষ্টিরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে পুলিশের এই বিশেষায়িত এই ইউনিটে।

পিবিআই’র তদন্তে নতুন ধারা এবং কর্মকৌশল নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা বলেছেন সংস্থাটির প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, ‘পুলিশের তদন্তের কিছু কৌশল আছে। সব কৌশলই হচ্ছে— কীভাবে মামলার রহস্য উদঘাটন করা হবে, কাকে ধরতে হবে। বলা যায় একই কৌশল। তারপরও কৌশল প্রয়োগের ক্ষেত্রে অন্যদের সঙ্গে পিবিআই’র কাজের কিছুটা পার্থক্য আছে।’

কী ধরনের কৌশল বা তদন্তের ধারা সম্পর্কে জানতে চাইলে বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘আমরাও থানা ও জেলা পুলিশে চাকরি করেছি। সবার তদন্তের কৌশলই এক। তবে আমরা (পিবিআই) মামলা তদন্তের সময় উচ্চ পর্যায়ের মনিটরিং একটু বেশিই করি। প্রতিটি মামলায় যতটুকু সময় লাগবে ততটুকু সময় দেই। মামলার ভিকটিম ও আসামি— উভয়ের স্বার্থ দেখার চেষ্টা করি। ভিকটিম ন্যায়বিচার অবশ্যই পাবেন, আবার আসামির প্রতিও যেন অবিচার করা না হয়। এই দিকগুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়।’

তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকটি মামলাকে আমরা তিন স্তরে পর্যালোচনা করে থাকি। তদারক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে প্রত্যেকেরই ক্ষমতা আছে— মামলাটি পর্যালোচনা বা অনুসন্ধান করার। আমাদের কাছে এমন কোনও ম্যাজিক নাই, যে ম্যাজিক দিয়ে আমরা আসামি ধরে ফেলবো। রহস্য উদঘাটন করে ফেলবো। এই যে তদারকি এবং তদারকির ফলে সময় দেওয়া, যে সময়টুকু হয়তো অনেকে দিতে চান না। কিন্তু আমরা প্রয়োজনীয় সেই সময় দেই বলেই কিছুটা উপকৃত হচ্ছি। তারপরও অনেক সময় ছোটখাটো ভুল হয়ে যায়।’

পিবিআই প্রধান বলেন, ‘আমাদের মূল কৌশল হচ্ছে— তদন্ত, তদন্ত এবং তদন্ত। আমি অফিসারদের বলে দিয়েছি, রাত ১০টা কিংবা ১২টা যেকোনও সময় ফোন করতে পারি যে— ওই মামলাটার কী হলো। তখন তাকে সেই মামলার নতুন তথ্য আমাকে দিতে হয়। এর কারণ হলো, আমার কাছে মামলার সব তথ্য লেখা আছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমরা ভিজিটরকে খুব প্রাধান্য দেই। তিনি আসামি কিংবা বাদী যে-ই হোক। ভুল তথ্য আর মিথ্যা তথ্য যা-ই দিক না কেন, আমরা সবার কথা শুনি। সবার কথা যাচাই করে দেখি। এই অর্থে আমরা আসামিদেরও ফেভার করি।’

বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘পিবিআই’র গ্রেফতারের ক্ষমতা আছে। থানার একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মতো পিবিআই ক্ষমতা ভোগ করে। কিন্তু গ্রেফতারের ক্ষেত্রে খুব বিচার-বিবেচনা করা হয়। আমাদের যত ক্ষমতাই থাকুক না কেন, যাকে গ্রেফতার করলে আমার কোনও কাজে আসবে না, তাকে আমরা গ্রেফতার করি না। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তার তদারক কর্মকর্তার অনুমতি ও পরামর্শ ছাড়া কোনও আসামিকে গ্রেফতার করেন না। এমনও হয়েছে যে, একজন লোক আসামি, কিন্তু তাকে ধরে বেশি তথ্য পাওয়া যাবে না, তাই আমরা তাকে ধরি না।’

পিবিআইর এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সারাদেশে পিবিআই’র ৫০টির মতো ইউনিট আছে। সেক্ষেত্রে আমরা আরেকটি বিষয় অনুসরণ করি। হত্যা, ডাকাতি বা অন্য যে মামলাই হোক, যেমন ঘটনা চট্টগ্রামের, কিন্তু আসামি চলে গেছে ময়মনসিংহে। তখন আমরা ময়মনসিংকে বলে দেই, তারা আসামি ধরার কাজটি করে ফেলে। পরে তদন্ত কর্মকর্তা গিয়ে আসামিকে নিয়ে আসেন।’

ফেনীর নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন মামলার রহস্য উদঘাটনে তদারকি করে পিবিআইকে আলোচনায় নিয়ে আসা পুলিশের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘মামলার তদন্তের জন্য উন্নত মানের একটি ফরেনসিক ল্যাবরেটরি থাকা দরকার, সেটি আমাদের আছে। এই ল্যাবে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আছে। আছে ল-ফুল ইন্টারসেপশন। ফলে অনেক কাজ আমরা নিজেরা প্রাথমিকভাবে করে থাকি। সব মিলিয়ে টেকনিক্যালি একটি মামলা তদন্তের জন্য যতটুকু সাপোর্ট থাকা দরকার, সরকার সবগুলোই আমাদের দিয়ে দিয়েছে। এদিক থেকেও অনেকের চেয়ে আমরা এগিয়ে আছি। এগুলোই আমাদের মূল কৌশল।’

পিবিআই প্রধান বলেন, ‘আমাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হচ্ছে— তিন মাস পর পর মামলাগুলো নিয়ে আমরা মিটিং করি। যেসব মামলার কোনও ক্লু ছিল না, সেই মামলারও রহস্য উদঘাটিত হয়। মফস্বলের অনেক বড় বড় মামলা, হয়তো চার, পাঁচ কিংবা সাত বছর আগের। যেসব মামলার কথা হয়তো গণমাধ্যমও ভুলে গেছে। তখন এ মামলাগুলোর রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে আমাদের অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে, বুদ্ধি খাটাতে হয়েছে। আমরা এ মামলাগুলোকে কেস স্টাডি হিসেবে গ্রহণ করি। তদন্ত কর্মকর্তা ও তার তদারক কর্মকর্তাকে (ইউনিট ইনচার্জ) আমরা বিভিন্ন জেলায় পাঠাই। তারা সেখানে গিয়ে মামলা নিয়ে ব্রিফ করে আসেন। সেখানে ২০-২৫ জন কর্মকর্তা থাকেন। বলা হয়, এ ধরনের ঘটনা হাতে আসার পর আমরা কী কী ভুল করেছি তা ব্রিফ করা। এটি আমাদের বড় একটি কৌশল।

মামলার তদন্ত শেষে যখন আমরা সফল হয়ে যাই, তখন কেস স্টাডি হিসেবে সেগুলো আমরা বিভিন্ন ইউনিটে পাঠিয়ে দেই। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা গিয়ে সেখানে বিষয়টি উপস্থাপন করে বুঝিয়ে দিয়ে আসেন। ফলে আমাদের অফিসারদের মধ্যে এমন একটি ধারণা হয়েছে যে, যে মামলাই হোক, পিবিআই ক্লু উদ্ধার করতে পারবে। মূল কথা হচ্ছে, আমাদের কৌশল একটাই— সেটা হচ্ছে, অব্যাহতভাবে কঠোর পরিশ্রম ও পর্যাপ্ত সময় দেওয়া।’

তিনি বলেন, ‘পিবিআই হলো এমনি একটি সংস্থা, যেখানে ইউনিট ইনচার্জ থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত সবাইকে ২৪ ঘণ্টা মামলা নিয়েই চিন্তা করতে হয়। আমরা একটি জিনিস নিশ্চিত করেছি যে, যে যেখানেই যাক, বাসায় কিংবা বাজারে, তাকে তার মামলা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। কারণ, কয়েকদিন পরপরই মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়।’

ডিজিটালি বা টেকনোলজি ব্যবহার করে অপরাধ বিশ্লেষণ বা তদন্ত করা হয় কিনা, জানতে চাইলে বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘আমাদের একটি ফরেনসিক ল্যাব আছে, যা সম্পূর্ণ ডিজিটাল ও আধুনিক ল্যাব। সর্বশেষ যেসব টেকনোলজি বাংলাদেশে আছে, সেগুলো আমরা ব্যবহার করি। আমাদের ফেস আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম আছে। এক্ষেত্রে ভিকটিমের মুখে শুনে আমাদের অপারেটর ছবি আঁকেন। তবে এটা করতে খুব দক্ষ অপারেটর লাগে। সফটওয়্যারও আরও ডেভেলপ করা দরকার। এক্ষেত্রে আমরা বলছি যে, ডিজিটালে যাবো না, আমরা ম্যানুয়েলে যাবো। সেটি হচ্ছে আমাদের প্রত্যেকটি ইউনিটে একজন করে আর্টিস্টের পদ সৃষ্টি করতে হবে। যখন অপরাধীর বর্ণনা কোনও ভিকটিম দেবেন, তখন সেই আর্টিস্ট সেই অপরাধীর ছবি আঁকবেন। কয়েকটি ছবি আঁকার পর দেখা যাবে যে, ছবি অপরাধীর চেহারার কাছাকাছি চলে আসছে। পুলিশ সদর দফতরকে বলার পর তারা বলেছে, তোমরা চাইলে আমরা মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়টি লিখবো। এটি হলে আরেকটি বিপ্লব হয়ে যাবে।’

পিবিআই প্রধান বলেন, ‘আমরা ডিজিটালের পাশাপাশি এনালগ পদ্ধতিকেও গুরুত্ব দিয়ে থাকি। তাছাড়া ২৪ ঘণ্টা যদি আপনি তদন্ত নিয়ে চিন্তা করেন, তাহলে আপনার মাথায় একটা না একটা বুদ্ধি আসবেই। পিবিআইকে আমরা এমনভাবে গড়ে তুলতে চাই যে, কোনও মামলাই আর রহস্যাবৃত থাকবে না। এটাই হচ্ছে আমাদের মূল কৌশল।’

নুসরাত হত্যা মামলার তদন্ত বিষয়ে জানতে চাইলে ডিআইজি বনজ কুমার বলেন, ‘মামলাটি যেহেতু বিচারের শেষ পর্যায়ে, তাই এটা নিয়ে এই মুহূর্তে কথা বলার আইনগত অধিকার নাই। রায় শেষে আমরা কথা বলতে পারবো।’

মামলা তদন্তকালে রাজনৈতিক চাপ থাকে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালে আমরা যখন তদন্ত শুরু করেছি, তখন থেকেই আমরা এই বিষয়গুলো আমলে নেইনি। শুরু থেকে যেহেতু আমরা তদন্তের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ লাইনে আছি, তাই আমাদের কর্মকর্তারাও এগুলোকে কিছু মনে করে না।’