নিউজ ডেস্ক:
বিশ্বের ১৪০টি দেশের সংস্কৃতি, জলবায়ু, পরিবেশ, শিক্ষা, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য ও জীবনযাপনের মানের ওপর ভিত্তি করে বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বৈশ্বিক বাসযোগ্য শহরের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এবার বিশ্বে বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় ঢাকার অবস্থান নিচের দিক থেকে তিন নম্বর, অর্থাৎ ১৩৮ তম।

বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় সর্বনিম্নে থাকা ১০ দেশের মধ্যে ঢাকার পরে রয়েছে মাত্র দুটি শহর; একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার দামেস্ক, অপরটি নাইজেরিয়ার লাগোস। এই তালিকায় বাসযোগ্য শহরের তালিকায় প্রথমে আছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা। এর পরেই রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, সিডনি, জাপানের ওসাকা, কানাডার ক্যালগারি, ভাঙ্কুবার, টরেন্টো।

বসবাসের জন্য ঢাকা আসলে কতটুকু খারাপ, আর শহরে বসবাস করে কী কী সমস্যা চোখে পড়ে বা কী কী সমস্যার মধ্যে প্রতিনিয়ত পড়তে হয়, সেসব ব্যাপারে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে ঢাকায় বসবাসকারী বেশ কয়েকজনের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে।

রাজধানীর মিরপুরে থাকেন বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের উপস্থাপিকা শারমীন নাহার নিপা। তিনি বলেন, মিরপুর থেকে তার কর্মস্থল সিদ্ধেশ্বরীতে যেতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। তার মতে, ঢাকা শহরে বসবাসের সবচেয়ে খারাপ দিকটি হচ্ছে যানজট।

শহরের পরিবহন ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন নিপা। তিনি বলেন, বাসের মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা নেই, ভাড়া নিয়ে কোনো শৃঙ্খলা নাই, যাত্রী তোলা নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা থাকে চালকদের মধ্যে। এছাড়া দক্ষ চালকও নেই। এ বিষয়ে বারবার আলোচনা, এমনকি বড় ধরনের একটি আন্দোলন হওয়ার পরও পরিবহন খাতে কোনো পরিবর্তন আসেনি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

স্বামী-সন্তান নিয়ে ফার্মগেটের পূর্ব রাজাবাজার এলাকায় থাকেন নাদিরা জাহান। সংসার সামলানোর পাশাপাশি তিনি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরিও করেন।

নাদিরার মতে, তার এলাকাটি অনেক বেশি ঘনবসতি। এ কারণে রাস্তায় যানবাহনও থাকে বেশি। ফলে সময় মতো গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে।

তিনি বলেন, ঘনবসতি হওয়ায় বিল্ডিংগুলো একটার গায়ে আরেকটা লেগে থাকে। ফলে অনেক সময় দেখা যায়, মানুষের প্রাইভেসিও থাকে না।

তার অভিযোগ, ফার্মগেট এলাকায় সকাল-বিকেল গ্যাস থাকে না বললেই চলে। সেই সঙ্গে নিয়মিত পানি সরবরাহ পাওয়া যায় না। পূর্ব রাজা বাজারে আরও যেটি সবচেয়ে বড় সমস্যা সেটা হচ্ছে রাস্তা কাটা। একেক বার একেক কর্তৃপক্ষ এসে রাস্তা কাটে, কখনও বিদ্যুতের থেকে কাটা হচ্ছে, কখনও গ্যাস, কখনো ওয়াসা অর্থাৎ একেক জন একেক সময় রাস্তা কাটে আর মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ওই তালিকার বিবেচ্য বিষয়ের মধ্যে এ ধরনের কিছু নাগরিক সমস্যার কথা উঠে এসেছে। এ বছর শহরগুলোর বসবাসের যোগ্যতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে যেসব বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেগুলো হলা- স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো।

এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রাজধানী ঢাকা দুটি বিষয়ে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। তার মধ্যে একটি সংস্কৃতি ও পরিবেশ এবং অন্যটি অবকাঠামো। এই দুটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যা যা রয়েছে তা হলো- জলবায়ু ও তাপমাত্রা, দুর্নীতির মাত্রা, সামাজিক বা ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা, খেলাধুলার সুযোগ, খাদ্য ও পানীয় দ্রব্য, ভোগ্যপণ্য ও সেবা, সড়ক-পরিবহন ব্যবস্থা, গৃহায়ন, জ্বালানি, পানি এবং টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা।

তবে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্সের এই বিশ্লেষণকে গ্রহণযোগ্য মনে না করে এটাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তাদের মতে, এই তালিকায় যেসব শহরের সঙ্গে ঢাকার তুলনা করা হয়েছে, সেগুলো অনেকটা জনমানবহীন শহর বললে ভুল হবে না।

নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলী ইকবাল হাবিব বলেন, ভিয়েনা বা মেলবোর্নের জনঘনত্ব ঢাকার তুলনায় একবারই কম।
মেলবোর্ন বা ভিয়েনাতে যদি ঢাকার কোনো একটি এলাকার জনসংখ্যাও ঢুকিয়ে দেয়া যায়, তাহলে পুরো ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। ভিয়েনা বা মেলবোর্নে দশটি ছবি তুললে তার মধ্যে চারটা মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না।

তিনি আরও বলেন, এসব শহরের সঙ্গে ঢাকাকে তুলনা করার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, তারা আসলে প্রাণের শহর, মানবিক শহর, মানুষের শহরের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই আমাদেরকে এতটা নিচে নামিয়েছে।

ইকবাল হাবিব বলেন, এই তুলনা যারা করছেন তারা বিনিয়োগ এবং পর্যটনভিত্তিক পর্যালোচনার সাপেক্ষে মূল্যায়নটা করেন। সেই মূল্যায়নে ফুটফুটে শহর কল্পনা করেন তারা। কিন্তু যে শহরে একুশের প্রভাত ফেরি এবং পহেলা বৈশাখে লাখ লাখ মানুষ নির্বিঘ্নে আনন্দ করে, সে শহরকে এভাবে মূল্যায়ন যারা করে তাদের মূল্যায়নের ঘাটতি বলাই বাহুল্য।

তবে তার মানে এই নয় যে, ঢাকা শহরে বাসযোগ্যতা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। ঢাকাকে তার সম্ভাবনার দিক থেকে বিবেচনা করলে বাসযোগ্যতার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। সে অর্থে তার বসবাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ইকবাল হাবিব বলেন, ঢাকা শহরে মানুষের সংখ্যা এবং তার বিপরীতে বসবাসযোগ্য জমির পরমাণের অনুপাত অনেক কম। ফলে একটি পরিকল্পিত নগরী হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তুলতে হলে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

শহর হিসেবে ঢাকাকে বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে নানা ধরনের পদক্ষেপের কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। মেট্রোরেলের মতো বড় প্রকল্পসহ নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

ইকবাল হাবিব বলেন, ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে গুরুতর রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে কঠোরভাবে কাজে নামতে হবে। এ বিষয়ে অনেক ধরনের পরিকল্পনা তৈরি করা হলেও, সেগুলো এখনও বাস্তবায়ন করা যায়নি বলে মনে করেন তিনি। যার কারণ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজের কথা উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি বলেন, একটি অনানুষ্ঠানিক চাঁদাবাজি এবং একটি অর্থনৈতিক কোটারিগোষ্ঠী পুরো পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ভেস্তে দিচ্ছে। এ ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করতে যে ধরনের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সংশ্লিষ্ট সাংগঠনিক কাঠামো প্রয়োজন, সেগেুলো নেই।

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে ইকোনমিস্টের এই তালিকার বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে বিবিসি বাংলার কথা হয়। তিনি বলেন, এ ধরনের জরিপের জন্য তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য নেয়নি ইকোনমিস্ট। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো তথ্য না নিয়ে ইকোনমিস্ট কীভাবে এই তালিকা তৈরি সে বিষয়েও সন্দেহ রয়েছে।

সিরাজুল ইসলাম বলেন, ঢাকা যেহেতু বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর, সে হিসেবে আমরা সার্বিক সেবা প্রদান করে এটার বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট কাজ করছি। ঢাকা শহরের সিটি গ্রিনারি, পার্ক, খেলার মাঠ, রাস্তা, স্ট্রিট লাইট- এগুলোর বিষয়ে যথেষ্ট কাজ হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি বলেন, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে আন্তর্জাতিক মানের ৩১টি খেলার মাঠ রয়েছে। তবে প্রতিনিয়ত বাড়তি মানুষের চাপ সামলাতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে সরকার। জলবায়ুর প্রভাব যেমন, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদী ভাঙন এবং কর্মসংস্থানের সন্ধানে মানুষ প্রতিনিয়তই ঢাকামুখী হয়। কম ঘনবসতি এবং বেশি ঘনবসতিপূর্ণ শহরের ব্যবস্থাপনার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। সিটি কর্পোরেশন ও সরকার যৌথভাবে ঢাকাকে আরও বাসযোগ্য করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন এই পরিকল্পনাবিদ।

সিরাজুল ইসলাম বলেন, মেট্রোরেলের মতো বড় প্রকল্পের কারণে নাগরিকদের কিছুটা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এটা সাময়িক। শহরের অন্য বিষয়গুলো যেমন, রাস্তাঘাট, ভবন নির্মাণ, যানজট, গণপরিবহন এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো দেখার জন্য আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

সূত্র : বিবিসি বাংলা