বিশ্বজিত সেন :

রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট-বাঙালী জাতির জীবনে গভীর শোকাবহ দিন। এদিন ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিলো আমাদের জাতি গৌরবের সমস্ত অহংকার-একই সাথে রক্তাক্ত করা হয়েছিলো বাংলার সবুজ দুর্বাঘাসকে। ঘাতকের বুলেটে প্রাণ হারিয়েছিলেন বাঙালীর হাজার বছরের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ তাঁর পরিবার পরিজন। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট সারা বাংলার আকাশ ছিলো কালো মেঘে ঢাকা স্বাধীনতার চেতনার অন্যতম কেন্দ্র ধানমন্ডির বাড়িটিতে বইয়ে ছিলো রক্তের বন্যা-বাড়িটি হয়ে ছিলো নীরব নিথর, ১৫ আগস্ট বাংলার আকাশ ছিল শোকে ভারাক্রান্ত, সবার দৃষ্টি এবং উত্তেজনা ধানমন্ডির বাড়িটিতে কি হয়েছে…

ধানমন্ডির বাড়িটিতে কেউ আছেন?

দরজাটা একটু খুলুন, কেউ নেই।

নরম মাটিতে শুয়ে আছেন পিতা

শুয়ে আছে বাংলাদেশ।

’৭৫ এ বঙ্গবন্ধু শুয়ে ছিলেন রক্তের দিঘীতে কিন্তু আজও মনে হয় তিনি এই মানচিত্রে দাঁড়িয়ে আছেন।

স্বপ্নে দেখি দাঁড়িয়ে আছেন পিতা

বুকে বাংলাদেশ, মানচিত্র থেকে ঝরছে অনর্গল রক্ত।

সময় এগিয়ে গেছে, ইতিহাসে হয়েছে বিভিন্ন বিষয় সংযোজন, তারপরও বঙ্গবন্ধুর জন্য এখনো শোকার্ত বাংলার প্রতিটি ইঞ্চির জমিন, প্রতিটি মানুষ। সবাই এখনো অপেক্ষা করে কখন আবার বাড়ি ফিরবেন বঙ্গবন্ধু…

বঙ্গবন্ধু

আমরা তোমার অপেক্ষায় বসে আছি রেল স্টেশনে

এখানে আছে স্টেশন মাস্টার, টিকেট চেকার

কোলাহলমূখর প্ল্যাটফর্ম,

আছে নীল পাখি, রৌদ্রের গান, বনের ছায়া

নেই! শুধু তুমি…তুমি…তুমি

তুমি কি আর আসবে না ফিরে

রক্তের পথ বেয়ে এই সবুজ বাংলায়?

বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানী শাসকচক্র পাকিস্তানী সেনাবাহিনী হত্যা করতে পারেনি, কিন্তু এদেশীয় ঘাতক দালালচক্র তাঁকে ক্ষমা করেনি, বঙ্গবন্ধুর বিশাল হৃদয়ের উদারতাকে তারা গ্রহণ করতে পারেনি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে ষড়যন্ত্রকারীরা সবসময় চক্রান্তে ছিল লিপ্ত। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিলো এদেশের বিশ্বাসঘাতক জুডাস ব্রুটাস চক্র। তবে আমরাও এর জন্য কম দায়ী নই-এ আক্ষেপ থাকবে সারাজীবন।

মহামানব যীশুর ও জুডাস ছিলো,

জুলিয়াস সীজারেরও ছিলো ব্রুটাস।

বঙ্গবন্ধুর জুডাস ও ব্রুটাস আমরা

কেউ প্রতিবাদ করিনি বর্বর হত্যাকান্ডের

ধিক! এই জীবন, পরাজিত জীবন!

এদেশের নতুন প্রজন্ম সবসময় জিজ্ঞাসা করবে। বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল জীবনকে কেন হত্যা করা হয়েছিলো, কি অপরাধ ছিলো তাঁর, বাংলাদেশ স্বাধীন করাই কি হয়ে তাঁর অপরাধ, কেন সেসময় প্রতিবাদ প্রতিরোধ করা হয়নি ঘাতক দালালদের?

একদিন অনাগত কালের নতুন প্রজন্ম বলিবে

আমাদের পূর্ব পুরুষদের হাতে বঙ্গবন্ধুর রক্ত ছিলো

আমরা অভিশাপ দিচ্ছি সে সব খুনীদের,

আমরা অভিশাপ দিচ্ছি প্রতিবাদ না করা কাপুরুষদের।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিলো ’৭৫ এর ১৫ আগস্টে। এরপর থেকে বহু চেষ্টা করা হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি আদর্শ এবং মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে মুছে দেওয়ার জন্য। কিন্তু শত চক্রান্তেও মুছে দেওয়া যায়নি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি, বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন-সারা বাংলার জমিনে মহান মুক্তিযুদ্ধের মানচিত্রে।

সমুদ্র তীরের নিঃসঙ্গ ঝাউয়ের বনে তুমি আছো

কীর্তন খোলার পাড়ে তুমি আছো,

টুঙ্গিপাড়ার শান্ত ছায়ায় তুমি আছো

বাঙালীর বেদনার মানচিত্রে তুমি আছো।

বঙ্গবন্ধু মুজিবকে হেয়প্রতিপন্ন করে বিভিন্নভাবে চিত্রিত করার চেষ্টা চলেছিলো, বহু তর্ক বিতর্কে তাঁকে ছোট করার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু সত্য ইতিহাস সত্যই, বাংলাদেশ-বঙ্গবন্ধু বাঙালীর জীবনের শাশ্বত বিষয়-এদেশ চিরকাল বাঙালীর-এদেশের মাটিতে চিরকাল গর্বোন্নত শির নিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী পুরুষ হিসেবে বেঁচে থাকবেন বাঙালী জাতির আকাক্সক্ষার প্রিয়জন বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান।

পূর্বেরও না পশ্চিমেরও না

এদেশ থাকুক-চিরকাল বাঙালীর

এদেশ থাকুক-চিরকাল বঙ্গবন্ধুর।

এদেশের মাটিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে নতুন প্রজন্মসহ বাঙালী জাতি নতুনভাবে অভিযাত্রা শুরু করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর চেতনায় এগিয়ে যাচ্ছে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। স্বাধীনতার চার দশক পরেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী শক্তি তৎপর, গণতন্ত্রের সঙ্কট রয়ে গেছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তবে এসব বাঁধা পেরিয়ে আমাদের সামনে যেতে হবে। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে বঙ্গবন্ধু এখনো সাহসী প্রতীক, তারপরও মনে হয়-বাঙালীর প্রিয় বন্ধু নেই-প্রিয়জন নেই!

শহরে মিছিল আছে, রেসকোর্স আছে

আছে নগরীর ব্যস্ত কোলাহল,

কিন্তু। কৃষক শ্রমিকের একজন প্রিয় বন্ধু নেই,

তিনি বাঙালীর আপনজন-বঙ্গবন্ধু।

দেশবিরোধী এবং স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ইতিহাসের যাত্রায় বারবার চেষ্টা করেছে বঙ্গবন্ধুকে ছোট করবার জন্য, পিছনে ঠেলে দেবার জন্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুই, ইতিহাসে তাঁর স্থান সুনির্দিষ্ট সুবিদিত। যাঁরা বঙ্গবন্ধুকে ছোট করতে চেষ্টা করে, তারা পতনের সিঁড়িতে বারবার মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধু চির সম্মানিত, মহাগৌরব নিয়ে সমাহিত বাঙালীর শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবুর…

আমার দেশের পুণ্য মাটিতে শত মণীষা শুয়ে আছে

পক্ষপাত হলেও আমি বলে যাবো,

বাঙালীর শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবুর।

’৭৫ এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু শহীদ হয়েছেন। তাঁর রক্ত ঝরেছে এদেশের শ্যামল মাটিতে। কৃষক, শ্রমিকসহ সবাই এখনো অপেক্ষা করে একজন বঙ্গবন্ধুর জন্য, স্বাধীনতার আলো আনা মানুষটির জন্য! তাঁদের প্রত্যাশা একদিন অবশ্যই বঙ্গবন্ধু ফিরে আসবেন, ফিরে আসবেন বাংলার মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে। বঙ্গবন্ধুর জন্য এ অপেক্ষা থাকবে চিরদিন চিরকাল…

নবান্নের উৎসব শেষে

শীতের সকালে

একদিন বঙ্গবন্ধু ফিরবেন,

গায়ে বাংলার মাটি মেখে জিজ্ঞেস করবেন

তোমরা এদেশে কেমন আছো?

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ, মৃত্তিকা আর মানুষের বন্ধনের মতো এ বন্ধন। নিজের মায়ের, মাটির টান যেমন মানুষ ভুলতে পারেনা- তেমনি মানুষ কোনদিন বঙ্গবন্ধু- বাংলাদেশ- মুক্তিযুদ্ধকে ভুলে যাবেনা। পৃথিবীতে এদেশে অনেক ইতিহাস তৈরি হবে কিন্তু একজন বঙ্গবন্ধু তৈরি হবেনা-মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল বাংলাদেশের অন্তরে সারা জাতির হৃদয়ে।

পৃথিবীর সমস্ত পথ ঘুরে

এ জাতির কন্ঠে উঠিবে নতুন স্বর

বাঙালীর স্বাধীনতা আনা রহমান মুজিবুর

বাঙালীর মুক্তি আনা রহমান মুজিবুর।

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক, পরিবেশবিদ।

Email- bishawjitsen@gmail.com