শ্রীধর দত্ত 

মানুষ সামাজিক জীব। মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যরা ছাড়া অন্য একজন মানুষ থাকে সে হচ্ছে বন্ধু। বন্ধু শব্দটি অত্যন্ত পবিত্র ও আত্মার বন্ধন। মনের মিলের মধ্যে বন্ধুত্বের সৃষ্টি। একে ছিন্ন করা যায় না, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অম্লান থাকে। পরিবারের মধ্যে যে কথাগুলো বলা যায় না তা বন্ধুদের কাছে মনের কথাগুলো বলা যায়। বন্ধু হচ্ছে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার নিত্য সঙ্গী। সুখ দুঃখে যে সব সময় পাশে থাকে সেই হচ্ছে প্রকৃত বন্ধু। আমার ব্যক্তিগত জীবনে বন্ধু যদিও ছন্দ-পতন হয়েছিল তবুও আমি বন্ধু দিবসকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করি।

রক্তের টান না থাকলেও আত্মার টানে বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়।ধারণা করা যায় ঊনবিংশ শতাব্দির ত্রিশ থেকে চল্লিশের দশকের মধ্যবর্তী সময়েই বন্ধু দিবস পালন শুরু হয়। ১৯৫৮ সালের ২০ জুলাই ওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডশিপ ক্রুসেডের প্রতিষ্ঠাতা ড. আর্তেমিও ব্রেঞ্চো বন্ধুদের সঙ্গে প্যারাগুয়ের পুয়ের্তো পিনাসকোতে এক নৈশভোজে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সে রাতেই ওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডসিপ ক্রুসেড প্রতিষ্ঠা পায়। এই প্রতিষ্ঠানটি ৩০ জুলাই বিশ্বব্যাপী বন্ধু দিবস পালনের জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব পাঠায়। প্রায় পাঁচ যুগ পর ২০১১ সালের ২৭ জুলাই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৩০ জুলাইকে বিশ্ব বন্ধু দিবস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। অন্য একটি তথ্যে জানা যায়, প্রথম দিকে বিভিন্ন কার্ড তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান ফ্রেন্ডশিপ ডে’র চল শুরু করে। পরবর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে এই দিন উদযাপন বিশাল আকার ধারণ করে। ধারণা করা হয় ১৯৩৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এই দিনটি উদযাপনের সময় আমেরিকার সরকার এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। দিনটি ছিল আগস্টের প্রথম শনিবার। হত্যার প্রতিবাদে পরের দিন ওই ব্যক্তির এক বন্ধু আত্মহত্যা করেন। এরপর থেকে জীবনের নানা ক্ষেত্রে বন্ধুত্বের অবদানের প্রতি সম্মান জানানোর লক্ষ্যেই আমেরিকান কংগ্রেস ১৯৩৫ সালে আইন করে আগস্ট মাসের প্রথম রবিবারকে আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস ঘোষণা করে। তবে ভারত, বাংলাদেশ সহ কিছু দেশে আগস্টের প্রথম রবিবার বন্ধুত্ব দিবস উদযাপন করে ।

বন্ধু কথাটি খুব ছোট্ট হলেও এর গভীরতা আকাশ সমান বিশাল। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা একা নই।
চলার পথের রাস্তা গুলো বন্ধু বিনে চলা যায় না।
যে কোন বয়সেই বন্ধুত্বের সৃষ্টি হতে পারে। তবে বাল্যকাল, কৈশোরকাল ও ছাত্র জীবনের বন্ধুগুলো হচ্ছে খুবই আপন ও প্রিয়। কর্মজীবনের বন্ধুত্বও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেই সময় কালের বন্ধুদের কখনো ভুলা যায় না। প্রথমেই বলেছিলাম আমার জীবনে বন্ধুত্বের ছন্দ পতন। কারো জীবনে ঘটেছে কিনা জানিনা তবে আমার জীবনে ঘটেছে। বাবার চাকরির কর্মক্ষেত্র বদলির কারণে আমার শিক্ষাজীবনও পরিবর্তন হতে থাকে। আমার বাড়ি পটিয়া থানার মেলঘর গ্রামে হলেও বাবার চাকরির সুবাদে আমার জন্ম হয়েছিল শঙ্খ নদীর পাড় দোহাজারীতে। আমার বাবা বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন চাকরি করতো। সেখানে আমি পূর্ব কাটগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে যখন হাই স্কুল দোহাজারী জামিজুরী আব্দুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়া অবস্থায় ১৯৮৯ সালে বাবার কাপ্তাই বদলির আদেশ আসে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় প্রাথমিক স্কুলের বন্ধু এবং হাই স্কুলের বন্ধুদের ফেলে চলে আসতে হয়। আমার প্রিয় বন্ধু ছিল মান্নান, লোকমান, যীশু, বাদল, বাপ্পা, লিটন, মিঠন, রাজিব, নাড়ু, পিংকু, কিশোর, টিংকু, চাঁনু , রুপম, এবং নাম ভুলে যাওয়া আরো অনেক। কাপ্তাই উচ্চ বিদ্যালয়ে আমার দুই বৎসর লেখাপড়া চলে। তারপর আবারো বাবার বদলি রাউজান রাবার বাগানে। কাপ্তাইয়ে বন্ধুদের নাম এখন আমি ভুলে গেছি আর মনেও পড়ছে না। রাউজানে এসে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয় রাউজান ব্যারিস্টার সুরেশ বিদ্যায়তনে। তবে বিদ্যালয়টির একটি বিশেষত্ব ছিল সব স্কুলের নাম বিদ্যালয় কিন্তু এই স্কুলটির নাম বিদ্যায়তন এবং স্কুলটি মাটির তৈরি ও উপরে টিন। তাই এই স্কুলটি আমার আত্মার বন্ধন হয়ে যায়। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বন্ধু বান্ধবরা ছিল আমার খুবই প্রিয়, সবাই আমাকে অন্তর থেকে ভালোবাসতো। সুরেশ বিদ্যায়তন থেকে আমি ১৯৯৪ সালে এস এস সি পাশ করি। মনে হয় সেই অতিরিক্ত ভালোবাসা আবারো কাল হয়ে দাঁড়ালো। রাউজান রাবার বাগানে বাবা চাকরিতে অবসর নিয়ে নেন। তারপর আমরা চলে আসি চট্টগ্রাম শহরে। কিন্তু আমার সহপাঠীরা সবাই রাউজান কলেজে অধ্যায়নের কারণে প্রিয় বন্ধুদের সাথে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমি তখন চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজে। আমার মনে পড়ে যীশু, প্রকাশ, পুলক, আনু, মামুন, মোরশেদ, উজ্জল, চম্পক, বিশ্বজিৎ, রুপন, অঞ্জন, স্বপন, সুদীপ, ঝন্টু, জুয়েল, শুলাল, এবং আরো অনেকের কথা। বাবার কড়া শাসনের কারণে কোথাও গিয়ে এক রাত থাকা সম্ভব ছিল না। কলেজ জীবনে আমার বন্ধু ছিল সুকান্ত, সবুজ চিনময়, মুস্তাফিজ, কামাল, পিন্টু, সুনীল, দীপন, সঞ্জয়, গোলাম রহমান এবং আরো অনেকে। এইচএসসি পাশ করার পর বন্ধুরা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি বাবার ব্যবসার সাথে। তারপর দীর্ঘ ১০ বছর চলে অর্থ কষ্ট জীবন সংগ্রাম। শহুরে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ থাকলেও সুদীর্ঘ সময় দোহাজারী কিংবা রাউজানের সকল বন্ধুদের সাথে আমি সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। আমাদের সময় তখন মোবাইল ছিল না। থাকলে হয়তো কিছুটা যোগাযোগ রক্ষা করা যেতো।সময়ের কারণে কিংবা অর্থকষ্টে কিংবা নিয়তির কারণে আমি বন্ধুদের থেকে দূরে সরে পড়ি। জীবন সংগ্রামের ছন্দ-পতনে নিয়তি আমাকে ২০০৭ সালে বিদেশমুখী করে তুলে। এখন দীর্ঘ ১২ বছর হতে চললো প্রবাস জীবন অতিক্রম করছি। বিশেষ করে প্রবাসে যারা জীবন অতিবাহিত করে তারা জানে বন্ধুর দূরত্বটা এবং কত কষ্টকর কত বেদনা দায়ক। জীবনের ৪০ বছর হতে চলল জীবনটা বন্ধুহীন ভাবে এক বুক জ্বালা নিয়ে বেঁচে আছি। এ যেন খাঁচার ভিতর বন্দি পাখির মত জীবন যাপন। গত কিছুদিন আগে আমার সহপাঠী রূপন ফেইসবুকের একটা ভয়েস মেসেজে আমার জীবনের পাথর যেন সরে গেল। রুপন ২০১৮ সালে মেসেঞ্জারে ছবি পাঠিয়েছিল কিন্তু আমি তাকে চিনতে পারিনি। মেসেঞ্জারে ভয়েস মেসেজে যখন শুনতে পারলাম আমি ৯৪ সালের ব্যাচের রুপন, তখন আমার মনে পরল। এ যেন বন্ধুহীন শুষ্ক মরূভূমির মাঝে আমি জলের সন্ধান পেলাম। আমার যে কি আনন্দ হল ঐ দিন সারা রাতে বন্ধুদের কথা ভেবেছি আর কেঁদেছি। মনে হল কালকেই বন্ধুদের কাছে চলে যায়, কিন্তু কর্ম ও প্রবাস জীবন আমাকে শিকল বন্দি করে রেখেছে। বন্ধুরা তোমরা আমাকে ভুল বুঝো না, সময় ও দারিদ্র্য আমাকে তোমাদের থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। আশা করি ফেইসবুকের মাধ্যমে আমার হারানো বন্ধুদের ফিরে পাবো। সময় ও নিয়তি আমাকে বন্ধুদের থেকে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে, আশা করি সেই নিয়তিই আমার বন্ধুদেরকে ফিরে দিবে। আমার বাল্যকাল, ছাত্র জীবন এবং কর্ম জীবনের সকল বন্ধুদের জানাই অন্তরের অন্তস্থল থেকে গভীর ভালোবাসা। বন্ধু দিবস একটা নির্দিষ্ট দিনে বেঁধে রাখা যায় না। বন্ধু হচ্ছে সারা বছরের ও চিরদিনের। বন্ধু দিবসে আমি আমার সকল বন্ধুদের জীবন সুখ স্বাচ্ছন্দে ও আনন্দে ভরে উঠুক এই কামনা করি।