মোঃ তারেকুর ইসলাম:
সিরাতুল মুস্তাকিম বা সরল পথ কি? এক কথায়- যে পথে কোন বাঁক নেই, মোড় নেই সেটাই তো সোজা পথ, সরল পথ। কিন্তু সেই বাঁক ও মোড় বিহীন পথ বুঝব কিভাবে? আল্লাহ বললেন, সেই পথ হলো তাদের পথ যারা নেয়ামতপ্রাপ্ত তথা আল্লাহ যাদেরকে নেয়ামত দান করেছেন।

আল্লাহ কাদেরকে নেয়ামত দিয়েছেন? আল্লাহ নিজেই বলে দিলেন, যাদের প্রতি আল্লাহ্ পাক অনুগ্রহ করেছেন বা যারা নেয়ামতপ্রাপ্ত তাঁরা হচ্ছেন নবী, সিদ্দীক, শহীদ এবং সৎকর্মশীল বা সালেহীন। -(সূরা ৪ নিসাঃ আয়াত ৬৯)

আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে মকবুল উপরোক্ত লোকদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তর নবী ও রাসূলগণের। অতঃপর নবী ও রাসূলগণের উম্মতের মধ্যে যারা সর্বাপেক্ষা বড় মরতবা ও মর্যাদার অধিকারী, তাঁরা হলেন সিদ্দীক। যাঁদের মধ্যে রুহানী কামালিয়াত ও পরিপূর্ণতা রয়েছে, সাধারণ ভাষায় তাদেরকে ‘আউলিয়া’ বলা হয়। আর যাঁরা দীনের প্রয়োজনে স্বীয় জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছেন, তাঁদেরকে বলা হয় শহীদ। আর সালেহীন হচ্ছেন- যাঁরা ফরজ, সুন্নত, ওয়াজিব, মুস্তাহাব প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রে শরীয়তের পুরোপুরি অনুসরণ ও আমলকারী, সাধারণ পরিভাষায় এদেরকে দীনদার বলা হয়।

ছোট্ট সূরাটির দুটি আয়াতে সহজ এবং স্বচ্ছ দু‘টি পন্থা বাদ দিয়ে প্রথম ইতিবাচক এবং পরে নেতিবাচক পদ্ধতিতে সিরাতে মুস্তাকীম চিহ্নিত করতে গিয়ে রাসুল (সা) বলেছেন, যদি সিরাতে মুস্তাকীম চাও তবে ঐ সমস্ত লোককে তালাশ করে তাদের পথ অবলম্বন কর। কেননা, রসূল (সাঃ) এ দুনিয়াতে চিরকাল অবস্থান করবেন না। তাঁর পরে আর কোন নবী বা রসূলেরও আগমন হবে না। তাই তাঁদের মধ্যে নবীগণ ছাড়াও সিদ্দীক তথা আউলিয়া কেরাম, শহীদান ও সালেহীনকেও অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। কারণ, কিয়ামত পর্যন্ত এঁদের অস্তিত্ব দুনিয়াতে থাকবে।

সারকথা এই যে, সরল পথ অনুসন্ধানের জন্য আল্লাহ তা‘আলা কিছু সংখ্যক মানুষের সন্ধান দিয়েছেন; কোন পুস্তকের হাওয়ালা দেননি। এক হাদীসে রসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন সাহাবীগণকে জানিয়েছেন যে, আমার উম্মতও পূর্ববর্তী উম্মতগণের ন্যায় সত্তুরটি দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। তন্মধ্যে মাত্র একটি দলই সরল পথে থাকবে। তখন সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন সেটি কোন দল? প্রত্যুত্তরে তিনি যা বলেছিলেন তাতেও তিনি কিছু লোকের সন্ধান দিয়েছেন। এরশাদ করেছেনঃ আমি এবং আমার সাহাবীগণ যে পথে রয়েছি সে পথই সত্য ও ন্যায়ের পথ। বিশেষ ধরণের এ বর্ণনা পদ্ধতিতে হয়তো সে দিকে ইশারা করা হয়েছে যে, মানুষের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা-দীক্ষা কেবল কিতাব ও বর্ণনা দ্বারা সম্ভব হয় না, বরং দক্ষ ব্যক্তিগণের সাহচর্য ও সংশ্রবের মাধ্যমেই তা সম্ভব হতে পারে।

বাস্তবপক্ষে মানুষের শিক্ষক এবং অভিভাবক মানুষই হতে পারে। কেবল কিতাব বা পুস্তক শিক্ষক ও অভিভাবক হতে পারে না।
এ এমনই এক বাস্তব সত্য যে, দুনিয়ার যাবতীয় কাজকর্মের এর নিদর্শন বিদ্যমান। শুধু পুঁথিগত বিদ্যার দ্বারা কেউ না পারে কাপড় সেলাই করতে, না পারে আহার করতে। শুধু ডাক্তারী বইপত্র পাঠ করে কেউ ডাক্তার হতে পারে না। ইঞ্জিনিয়ারিং বইপত্র পাঠ করে কেউ ইঞ্জিনিয়ারও হতে পারে না। অনুরূপভাবে শুধু কোরআন-হাদীসের পাঠ করাই কোন মানুষের পরিপূর্ণ তা‘লীম ও তরবিয়তের জন্য যথার্থ হতে পারে না। যে পর্যন্ত কোন বিজ্ঞ লোকের নিকট বাস্তবভাবে শিক্ষা গ্রহণ না করে সে পর্যন্ত দীনের তা‘লীম অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কোরআন ও হাদীসের ব্যাপারে অনেকেই এ ভুল ধারণা পোষণ করে যে, কোরআনের অর্থ ও তফসীর পাঠ করে কোরআন ও হাদীস সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অধিকারী হওয়া যায়। এটা সম্পূর্ণ প্রকৃতি বিরুদ্ধ ধারণা। কেননা, যদি কিতাব এ ব্যাপারে যথেষ্ট হতো তবে নবী ও রাসূল প্রেরণের প্রয়োজন হতো না। কিতাবের সাথে রাসূলকে শিক্ষকরূপে পাঠানো হয়েছে। আর সরল পথ নির্ধারণের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক স্বীয় মকবুল বান্দাদের তালিকা প্রদানও এর প্রমাণ যে, শুধু কিতাবের পাঠই পূর্ণ তা‘লীম ও তরবিয়তের জন্য যথেষ্ঠ নয়; বরং কোন কোন বিজ্ঞ লোকের নিকট এর শিক্ষালাভ করার প্রয়োজনীয়তা রযেছে।

বোঝা গেল, মানুষের প্রকৃত মুক্তি এবং কল্যাণপ্রাপ্তির জন্য দু‘টি উপাদানের প্রয়োজন। প্রথম, আল্লাহ্‌র কিতাব যাতে মানবজীবনের সকল দিকের পথনির্দেশ রয়েছে এবং অপরটি হচ্ছে আল্লাহ্‌র প্রিয় বান্দা বা আল্লাহ-ওয়ালাগণের সাহচর্য বা সান্নিধ্যে থেকে শিক্ষা লাভ । (তাফসিরে মারেফুল কুরআন, সূরা ফাতেহার তাফসির থেকে সংগৃহীত)।

সরল সঠিক পথ বা সিরাতুল মুস্তাকিম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর একটি হাদিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ হাদিসে একটি রূপক উপমার মাধ্যমে তিনি সিরাতুল মুস্তাকিম থেকে মানুষের বিচ্যুত হবার পন্থা বর্ণনা করেছেন। হাদিসটি নাওয়াস ইবনে সামআন (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেনঃ আল্লাহ সিরাতুল মুস্তাকিমের একটি উপমা দিয়েছেন। (সেটি হলোঃ) একটি সোজা সরল সুদৃঢ় পথ। সেই পথের দুই ধারে রয়েছে দেয়াল। দেয়ালগুলোতে রয়েছে অনেক উন্মুক্ত দরজা। দরজাগুলোতে রয়েছে ঝালরের পর্দা। আর রাস্তার মাথায় আছেন একজন আহবায়ক। তিনি আহবান করে বলছেনঃ ‘হে মানুষ! তোমরা সবাই মিলে সোজা রাস্তার উপর দিয়ে এগিয়ে চল, রাস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়োনা।’ আরেকজন আহবায়ক আহবান করছে রাস্তার উপর থেকে। যখনই কোনো ব্যক্তি রাস্তার পার্শবর্তী দরজার পর্দা সরিয়ে ভেতরে তাকাতে বা ঢুকতে চায়, তখনই এই আহবায়ক তাকে সতর্ক করে বলে উঠেঃ ‘সাবধান! পর্দা সরাবে না, পর্দা উন্মুক্ত করলে ধ্বংসে নিমজ্জিত হবে।’ (অতপর রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ) সরল পথটি হলোঃ ইসলাম।’ দুই পাথের দেয়ালগুলো হলোঃ ‘আল্লাহর নির্ধারিত সীমানা।” উন্মুক্ত দরজাগুলো হলোঃ ‘আল্লাহ্‌র নিষিদ্ধ পথ ও বিষয় সমূহ।’ রাস্তার মাথার আহবায়ক হলোঃ ‘আল্লাহ্‌র কিতাব (আল কুরআন)।’ রাস্তার উপরের আহবায়ক হলোঃ প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির অন্তরে অবস্থিত উপদেশ দাতা বা বিবেক বা কালব। (তথ্য সূত্রঃ তিরমিযি, আহমদ)।

শয়তান ইসলামের সরল সঠিক রাজপথে ওঁৎ পেতে বসে থাকে। ওঁৎ পেতে বসে থেকে মানুষকে প্রলুব্ধ ও বিভ্রান্ত করে দুই পাশের পাপের গলিতে ঢুকিয়ে দেয়াই তার (শয়তানের) কাজ। কাজেই বুঝা গেল, সিরাতুল মুস্তাকিম বা সরল সঠিক পথ হলো সত্য ইসলাম বা শরীয়ত ও সুন্নত। অর্থাৎ শরীয়ত ও সুন্নতের সাজে নিজেকে যতবেশী সাজানো যাবে শয়তানের ধোকা বা প্রতারণা তত অকার্যকর হবে।

শরীয়ত ও সুন্নত দু‘প্রকার। তথা জাহের ও বাতেনী। নিজের জাহের ও বাতেনকে যখন শরীয়তের উভয় সাজে সজ্জিত করা যাবে তখনই সম্ভব হবে শয়তানের ধোকা ও প্রতারণা থেকে নিজেকে রক্ষা করা, সম্ভব হবে সিরাতুল মুস্তাকিমের উপরে থাকা, তখন আসবে আল্লাহর দয়া ও ক্ষমা। আসবে আল্লাহর বান্দা হিসাবে স্বীকৃতি। তাতেই আপনি পুরস্কার হিসেবে পাবেন চির শান্তির জান্নাত।

মোঃ তারেকুর ইসলাম
ছাত্র: শারজাহ বিশ্ববিদ্যালয়-UAE