সিবিএন ডেস্ক:

আধুনিক বাংলাভাষার প্রধানতম কবি আল মাহমুদের ৮৪তম জন্মদিন ১১ জুলাই। ১৯৩৬ সালের এই দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল গ্রামের মোল্লাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সর্বব্যাপ্ত এ কীর্তিমান নিজের অমরতা নিশ্চিত করে লোক থেকে লোকান্তরিত হন ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সাল

‘আমাকে এ অদম্য চলার পথে নিয়ে এসেছে/ তারা তো সবাই জানে আমার পা পাথর/ দৃষ্টিশক্তি স্বপ্নের কুয়াশায় আচ্ছন্ন।/ তবু মানুষের মন বলে একটা কথা আছে। আছে না কি?/ হ্যাঁ, মন বলছে এখনও আমার দিগন্তে পৌঁছার/ খানিকটা পথ বাকি।’- স্বরচিত কবিতার মতোই অদম্য পথচলা তার। বয়সের ভারে দৃষ্টিশক্তি হারালেও কবিত্বশক্তি তার রয়েছে অটল, যা তাকে দিয়েছে সম্মোহনী মর্যাদা। তিনি আল মাহমুদ, সমকালীন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রধান কবি।

জীবনবোধের অনন্য এ শব্দশিল্পী ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক হিসেবেও কম ভাস্বর নয়। ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই তিতাস বিধৌত ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মৌড়াইলের মোল্লাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা- মীর আব্দুর রব, মাতা- রওশন আরা মীর। তার ‘সোনালি কাবিন’ অবিস্মরণীয় অনবদ্য এক কাব্য যা বাংলা কবিতা সাহিত্যে চিরজীবী হয়ে থাকবে অনন্তকাল ধরে। ‘একুশে পদক’প্রাপ্ত মহান এই কবিকে দৈনিক সংগ্রাম পরিবারের পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

তার প্রকৃত নাম মীর আব্দুস শুকুর আল মাহমুদ। তবে ‘আল মাহমুদ’ নামেই পরিচিত ও খ্যাত ত্রিকালদর্শী এ কবি। তিনি বেড়ে উঠেছেন তার প্রিয় নদী তিতাস পাড়ের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সংবাদপত্রে লেখালেখির সূত্র ধরে কবি ঢাকা আসেন ১৯৫৪ সালে। সমকালীন বাংলা সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকার মধ্যে কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী সম্পাদিত ও নাজমুল হক প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক কাফেলা’য় লেখালেখি শুরু করেন। তিনি পাশাপাশি ‘দৈনিক মিল্লাত’ পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে সাংবাদিকতা জগতে পদচারণা শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী কাফেলার চাকরি ছেড়ে দিলে তিনি সেখানে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরে তিনি ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। তিনি স্বাধীনতা-উত্তর আওয়ামী লীগ সরকারের সময় একবার জেল খাটেন। পরে তিনি শিল্পকলা একাডেমিতে যোগদান করেন এবং পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।

কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর (১৯৬৩)’ সর্বপ্রথম তাকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। এরপর ‘কালের কলস (১৯৬৬)’, ‘সোনালি কাবিন (১৯৬৬)’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে উঠো (১৯৬৯)’ কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৭১’র মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি গল্প লেখার দিকে মনোযোগী হন। ১৯৭৫ সালে তার প্রথম ছোট গল্পগ্রন্থ ‘পানকৌড়ির রক্ত’ প্রকাশিত হয়। ১৯৯৩ সালে বের হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘কবি ও কোলাহল’। তার আরো কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘দিনযাপন’, ‘দ্বিতীয় ভাঙ্গন’, ‘একটি পাখি লেজ ঝোলা’, ‘আল মাহমুদের গল্প’, ‘জিবরাইলের ডানা’, ‘প্রেমের গল্প’, ‘যেভাবে গড়ে উঠি’, ‘কিশোর সমগ্র’, ‘কবির আত্মবিশ্বাস’, ‘গন্ধ বণিক’, ‘ময়ূরীর মুখ’, ‘নদীর ভেতরের নদী’, ‘পাখির কাছে, ফুলের কাছে’, ‘উপমহাদেশ’, ‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’ ইত্যাদি।
কবিতার শব্দ ব্যবহারের নিপুণতাই নয় কিন্তু স্বতঃবেদ্য স্বাভাবিকতা এবং বিশ্বাসের অনুকূলতা নির্মাণে আল মাহমুদ নিঃসংশয়ে আধুনিক বাংলা ভাষার একজন অগ্রগামী কবি। তার সম্পর্কে সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন, ‘আধুনিক জীবনের কর্মকাণ্ডের মালটিপ্লিসিটি বা বহুলীকৃত অজস্রতা অনেক কবিকে অস্থির করেছে, তাই তাদের কবিতায় ভাষার অস্পষ্টতা এবং জটিলতা এসেছে। আল মাহমুদের কবিতা এ সংকট থেকে মুক্ত। আন্তরিক সত্যের সামীপ্যে তার কবিতা স্পষ্টবাক প্রকৃতির মতো উন্মুক্ত ও স্বাভাবিক। কোনও অঘটনে নয় কিন্তু হৃদয়ের লোক-লোকান্তরে তার বসতি; তাই তিনি উজ্জ্বল, স্বতন্ত্র এবং একনিষ্ঠ’।
আল মাহমুদ ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। এ আন্দোলন নিয়ে তিনি চার লাইনের একটি কবিতা লিখে পুলিশী হয়রানির শিকার হন। গ্রেফতার এড়াতে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে পালিয়ে বেড়ান। আর এ কারণেই তার একাডেমিক শিক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারেননি। আল মাহমুদের প্রথম দিকের কবিতা মূলত প্রেম, দেশপ্রেম, প্রকৃতি নিয়ে রচিত। দ্বিতীয় পর্যায়ের কবিতার মূল বক্তব্য সৌন্দর্যের আদি কারণ অনুসন্ধান ও আধ্যাত্মিকতা। আল মাহমুদ জীবনের প্রথম দিকে মার্কসবাদী জীবনাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। মার্কসবাদী চিন্তা- চেতনা বা শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন তার কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৭৪ সালে জাসদ সমর্থিত ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’র সম্পাদক হলে তৎকালীন সরকারের নির্দেশে তিনি গ্রেফতার হন। জেলে থাকাকালে তার জীবনাদর্শের পরিবর্তন হয়। তিনি মার্কসবাদী চিন্তা- চেতনা বাদ দিয়ে ইসলামকেন্দ্রিক জীবনাদর্শে নিমগ্ন হন।