যুগান্তর :
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গ্রিনসিটি প্রকল্পের ১১০ ফ্ল্যাটের জন্য অস্বাভাবিক মূল্যে আসবাবপত্র কেনা ও ভবনে উঠানোর ঘটনা অনুসন্ধানে নামছে দুদক। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে এ ঘটনা তদন্তের জন্য গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলীকে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কমিটিকে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমার জন্য সময় বেঁধে দেয়া হবে। মন্ত্রণালয়ের তদন্তে দুর্নীতি প্রমাণিত হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তদন্ত প্রতিবেদন দুদককে দেয়া হবে।

দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গ্রিনসিটি প্রকল্পে ২০ ও ১৬ তলা ভবনের ১১০টি ফ্ল্যাটের আসবাবপত্র ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনা এবং ভবনে উঠানোর কাজে অস্বাভাবিক ব্যয় নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের নজরেও এসেছে। এরপরই নির্দেশ দেয়া হয় তদন্তের।

এ অস্বাভাবিক খরচের বিষয়ে গণপূর্তমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি শনিবার যুগান্তরকে বলেন, এ ঘটনা আমিও জেনেছি। জানার পর পিডব্লিউডির চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে রোববারের মধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে বলেছি। তদন্ত কমিটিকে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদনে দাখিলের জন্য নির্দেশ দিতে বলা হয়েছে বলেও জানান তিনি। মন্ত্রী আরও বলেন, এ প্রকল্পের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে তার আগের মন্ত্রীর আমলে। তার আমলে এ ধরনের কোনো কার্যাদেশ দেয়া হয়নি। তারপরও যদি তদন্তে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

গ্রিনসিটির বিভিন্ন ভবনের ২০ তলায় একটি বালিশ তুলতে ৭৬০ টাকা ব্যয়ের ঘটনা সবচেয়ে বেশি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। অনেকেই এ ঘটনাকে রূপকথার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নিজেদের পক্ষেই সাফাই গেয়েছেন। ২০ তলায় একটি বালিশ উঠাতে ৭৬০ টাকা কেন দিতে হল। এ প্রশ্নের উত্তরে পাবনা জেলার গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৗশলী মাসুদুর রহমান বলেন, একেক ফ্লোরে একেক সময় হেঁটে হেঁটে বালিশ উঠাতে হয়েছে। উপরের ফ্লোরে একাধিকবার উঠতে হয়েছে। তাই এত ব্যয় হয়েছে। একটি বালিশ তুলতে কোনো ঠিকাদার ৭৬০ টাকা রেট দিলে ওই টেন্ডার বাতিল করে কেন দ্বিতীয় দফায় আহ্বান করা হল না। এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্তের কারণে এভাবে কাজ দেয়া হয়েছে। সব কিছুই উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমেই হয়েছে।

গ্রিনসিটির বিভিন্ন ফ্ল্যাটে রাশিয়ান নাগরিকদের থাকার জন্য কেনাকাটার ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিটি বালিশ কিনতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৯ হাজার ৯৫৭ টাকা। আর সেই বালিশ ফ্ল্যাটে উঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৩৮ টাকা থেকে শুরু করে ৭৬০ টাকা। একেকটি ইলেকট্রিক কেটলি ৫ হাজার ৩১৩ টাকায় কেনা হয়। ওই কেটলি ভবনে উঠানোর খরচ দেখানো হয়েছে ২ হাজার ৯৪৫ টাকা। একইভাবে প্রতিটি আয়রন কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে ৪ হাজার ১৫৪ টাকা। আর তা ভবনে উঠানোর খরচ দেখানো হয়েছে ২ হাজার ৯৪৫ টাকা। ৯৪ হাজার ২৫০ টাকা করে কেনা প্রতিটি রেফ্রিজারেটর উপরে উঠাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১২ হাজার ৫২১ টাকা। একেকটি ওয়াশিং মেশিন কেনা হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার টাকায়। ফ্ল্যাটে উঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৩০ হাজার ৪১৯ টাকা করে। এভাবে ফ্ল্যাট সাজাতে বিভিন্ন ধরনের পণ্য কেনা ও ভবনে তোলার কাজে বেশুমার খরচ দেখানো হয়েছে।

দুর্নীতি ও সুশাসন নিয়ে কাজ করেন এমন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলেছেন, রূপপুর গ্রিনসিটি প্রকল্পের কেনাকাটায় যে অর্থ ব্যয় হয়েছে তা রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে। যারা এমন আয়োজন করছেন তাদের সবাইকে এক এক করে আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। এটা করা না হলে অভিনব এ দুর্নীতির খোলা দরজা বন্ধ করা খুবই কঠিন হবে।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও টিআইবির ট্রাস্টি এম হাফিজ উদ্দিন খান যুগান্তরকে বলেন, এমন অদ্ভুত ঘটনা আগে শুনিনি। ঘটনা যদি সত্য হয় তাহলে তো খুবই বিপদের কথা। রূপকথার গল্পের মতো শোনায়। এমন অস্বাভাবিক ব্যয়ের ঘটনা রোধ করতে হলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

কেনাকাটায় অর্থ খরচের বিষয়টিকে অস্বাভাবিক উল্লেখ করে দুদকের একজন দায়িত্বশালী কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান করা হবে। অনুসন্ধানে সবকিছু বেরিয়ে আসবে।

দুদক সচিব মুহম্মদ দিলওয়ার বখত যুগান্তরকে বলেন, আমি মনে করি এ ধরনের ঘটনা অনুসন্ধান হওয়া উচিত। স্বাভাবিক দরদামের চেয়ে বেশি দামে কেনাকাটা করা হলে তা অবশ্যই অস্বাভাবিক ও অনিয়মের মধ্যে পড়ে। তবে আন্তর্জাতিক কোনো ‘রেট’ এখানে প্রযোজ্য কিনা সেটা দেখতে হবে।

এ প্রসঙ্গে রূপপুর পারমাণবিক মেগা বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শওকত আকবর যুগান্তরকে বলেন, সরকারের মেগা এ প্রকল্পে অনেকগুলো মন্ত্রণালয় কাজ করছে। প্রতিটি মন্ত্রণালয় তাদের নিজস্ব খরচে নিজ নিজ উদ্যোগে কাজ করছে। গ্রিনসিটি প্রকল্পের সব কাজ গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব। ওখানে কোনো ধরনের অনিয়ম হলে সেজন্য ওই মন্ত্রণালয় দায়ী হবে। তিনি বলেন, তারপরও এ ‘অস্বাভাবিক’ খরচের বিষয়টি নিয়ে তিনি ওই মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলবেন। কারণ এ প্রকল্পটি বর্তমান সরকারের বিদ্যুৎ উন্নয়নে সবচেয়ে অগ্রাধিকার প্রকল্প। এর প্রতিটি কাজ সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে আছে। এখানে কোনো ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রশ্রয় দেয়া হবে না।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পাবনা জেলার গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৗশলী মাসুদুর রহমান শনিবার যুগান্তরকে বলেন, আমাদের প্রধান প্রকৌশলীর সিডিউল অনুসারে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে কেনাকাটা করা হয়। মালামাল কেনা ও ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে উঠানোর জন্য সর্বনিু দরদাতাকে কাজ দেয়া হয়েছে। ‘স্বাধীন কনস্ট্রাকশন’ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাজারে সাড়ে ৭ হাজার টাকা দামের বালিশ আছে। আবার ৩ হাজার টাকা থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা দামের বালিশও আছে। কেনাকাটা কমিটি এ কাজটি তদারক করেছে। আর এ কমিটির প্রধান হচ্ছেন গণপূর্তের রাজশাহী বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী। একটি বালিশের দাম এত কেন? বাজারে খুঁজলে আপনারা পাবেন- এত দাম কেন। এ বালিশগুলো রাশিয়ান নাগরিকদের জন্য কেনা হয়েছে। যারা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাজ করার জন্য এখানে থাকবেন।

তিনি জানান, তিনটি ভবনে ১১০টি ফ্ল্যাটে ৩৩০ জন রাশিয়ান নাগরিক বাস করবেন। তারা ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে থাকবেন। তাদের থাকার সুবিধার জন্য ২৫ কোটি টাকার কেনাকাটা করেছি। ১১০টি ফ্ল্যাট সাজানোর জন্য যা যা দরকার সব কেনা হয়ছে। আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়ে আমরা মন্ত্রণালয়কে রিপোর্ট দেব। কেনাকাটা ও পণ্য ভবনে উঠানো সংক্রান্ত সব ডকুমেন্ট সরবরাহ করব। এক্ষেত্রে দুর্নীতি হওয়া সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, গোপনে কিছুই করা হয়নি। তিনি এও উল্লেখ করেন- হাজার হাজার বালিশ কেনা হয়েছে।

অভিযোগসংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, প্রকল্পের ২০ ও ১৬ তলা ভবনের ১১০টি ফ্ল্যাটে একটি বৈদ্যুতিক কেটলি নিচ থেকে উপরে তুলতেই খরচ হয়েছে প্রায় ৩ হাজার টাকা। একই রকম খরচ দেখানো হয়েছে জামা-কাপড় ইস্ত্রি করার কাজে ব্যবহৃত প্রতিটি ইলেকট্রিক আয়রন উপরে তোলার ক্ষেত্রেও। একেকটি ওয়াশিং মেশিন উঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৩০ হাজার টাকারও বেশি। এভাবে ওয়াশিং মেশিনসহ অন্তত ৫০টি পণ্য উঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ক্রয়মূল্যের প্রায় অর্ধেক। প্রায় ৮ হাজার টাকা করে কেনা প্রতিটি বৈদ্যুতিক চুলা ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিতে খরচ দেখানো হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার টাকার বেশি। ৩৮ হাজার ২৭৪ টাকা দরে কেনা মাইক্রোওয়েভ ওভেন ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ৮৪০ টাকা করে। অস্বাভাবিক এ অর্থ খরচ শুধু ভবনে উঠানোই নয়, আসবাবপত্র কেনার ক্ষেত্রেও দেখানো হয়েছে। প্রতিটি বিছানার চাদর কেনা হয়েছে ৫ হাজার ৯৮৬ টাকা করে।

এ হিসাবে ৩৩০টি চাদর কিনতে খরচ হয়েছে ১৯ লাখ ৭৫ হাজার ৩৮০ টাকা। কাপড় পরিষ্কারের জন্য ১১০টি ওয়াশিং মেশিনের প্রত্যেকটি কেনা হয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ১১২ টাকা করে। ১১০টি টেলিভিশনের প্রত্যেকটি কেনা হয়েছে ৮৬ হাজার ৯৬০ টাকায় এবং সেগুলো রাখার জন্য টেলিভিশন কেবিনেট কেনা হয়েছে ৫২ হাজার ৩৭৮ টাকা করে। একেকটি ড্রেসিং টেবিল কেনা ২১ হাজার ২১৫ টাকায়, আর উঠাতে খরচ ৮ হাজার ৯১০ টাকা করে দেখানো হয়েছে। এছাড়া রুম পরিষ্কার করার মেশিন কিনতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১২ হাজার ১৮ টাকা, ভবনে উঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ৬৫০ টাকা। প্রতিটি চুলা কিনতে খরচ করেছে ৭ হাজার ৭৪৭ টাকা, ভবনে উঠাতে খরচ দেখিয়েছে ৬ হাজার ৬৫০ টাকা। ছয়টি চেয়ারসহ ডাইনিং টেবিলের একেকটি সেট কেনা হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৭৪ টাকায়, ভবনে তুলতে লেগেছে ২১ হাজার ৩৭৫ টাকা করে। ৫৯ হাজার ৮৫৮ টাকা দরে ওয়ারড্রোব কিনে ভবনে উঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ১৭ হাজার ৪৯৯ টাকা করে।

৩৬ হাজার ৫৭ টাকা দরে ৩৩০টি ম্যাট্রেস ও তোশক কেনা হয়েছে মোট ১ কোটি ১৯ লাখ টাকায়, যার প্রতিটি ভবনে উঠাতে খরচ করা হয়েছে সাত হাজার ৭৫২ টাকা করে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য ৪৩ হাজার ৩৫৭ টাকা দরে ১১০টি খাট কিনতে খরচ হয়েছে ৪৭ লাখ ৫৯ হাজার ২৭০ টাকা। খাটগুলোর প্রত্যেকটি ফ্ল্যাটে নিতে খরচ দেখানো হয়েছে ১০ হাজার ৭৭৩ টাকা। একেকটি সোফা কেনা হয়েছে ৭৪ হাজার ৫০৯ টাকা, ভবনে উঠাতে খরচ হয়েছে ২৪ হাজার ২৪৪ টাকা করে। ১৪ হাজার ৫৬১ টাকা দরে কেনা সেন্টার টেবিলের প্রত্যেকটি ভবনে তুলতে লেগেছে ২ হাজার ৪৮৯ টাকা। অভিযোগ উঠেছে, অস্বাভাবিক দামে এসব আসবাবপত্র কেনার পর তা ভবনের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে উঠানোর এ ঘটনা ঘটিয়েছেন গণপূর্ত অধিদফতরের স্থানীয় কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা সত্য হলে তা দুঃখজনক। তবে এ ব্যাপারে কাজ করার জন্য দেশে স্বাধীন সংস্থা হল দুদক। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তিনি বলেন, বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি অভিশাপ। এখান পরিত্রাণ পেতে হলে এ ঘটনায় শাস্তি নিশ্চিত হওয়া জরুরি।