ডেস্ক নিউজ:
বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, ছোটখাটো গণ্ডগোলের মধ্যে দিয়ে বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) শেষ হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র ভারতের সাধারণ নির্বাচনের প্রথম পর্বের ভোটগ্রহণ। আগামী ১৯ মে পর্যন্ত আরও ছয় দফায় এই নির্বাচনে ভোট নেওয়া হবে। ভারতের সবচেয়ে লম্বা স্থলসীমান্ত প্রতিবেশী বাংলাদেশের কতটুকু ভূমিকা রয়েছে এ নির্বাচনে? কী বলছেন বিশ্লেষকরা?
আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরাম— ভারতের এই পাঁচটি রাজ্য বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী। এসব রাজ্যের অন্তত ৩০টা লোকসভা আসন সরাসরি বাংলাদেশ-লাগোয়া। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, অতএব ভারতের নির্বাচনে ‘বাংলাদেশ ফ্যাক্টরে’র একটা প্রভাব থাকে অবধারিতভাবেই। বিশ্লেষকদের মত এমনটাই।
দিল্লির স্ট্র্যাটেজিক থিংকট্যাংক ওআরএফের সিনিয়র ফেলো নিরঞ্জন সাহু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “তবে লক্ষণীয় হলো, এবারের নির্বাচনে বিজেপি বা কংগ্রেস— কেউই বাংলাদেশের নাম সরাসরি উচ্চারণ করছে না। কিন্তু সূক্ষ্মভাবে একটা ‘বাংলাদেশ তাস’ খেলার চেষ্টা অবশ্যই আছে।”
তিনি বলেন, ‘গত নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার নরেন্দ্র মোদী কিন্তু সরাসরি বাংলাদেশের নাম করেই অনুপ্রবেশের ইস্যুতে সরব হয়েছিলেন। ২০১৪ সালে আসামের এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন, লোটাকম্বল নিয়ে সব বাংলাদেশিকে আসাম থেকে ফেরত পাঠানো হবে।’
এই বিশ্লেষক বলেন, “অনুপ্রবেশের ইস্যুকে খুঁচিয়ে তুলতে এবারেও বিজেপি সেই একই চেষ্টা করছে, কিন্তু ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা উচ্চারণ না করে।”
বস্তুত আসামসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (এনআরসি) চূড়ান্ত করাকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা ও আশঙ্কার পরিবেশ তৈরি হয়েছে, ভোটের বাজারে তার ফায়দা তোলার চেষ্টাও চলছে পুরোদমে।
এনআরসি থেকে যাদের নাম বাদ পড়েছে, তাদেরই সাধারণভাবে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এদের অনেকেই হলেন বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম।
বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ বৃহস্পতিবারই পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ে এক জনসভায় বলেছেন, ‘আমরা ক্ষমতায় এলে আসামের মতোই সারাদেশে এনআরসি তৈরি করবো। আমাদের নির্বাচনি ইশতেহারেও আমরা সেই কথা দিয়েছি। ভারতের বুক থেকে প্রতিটি অনুপ্রবেশকারীকে আমরা বের করে ছাড়বো।’
বিজেপি সভাপতি বলেন, ‘তবে হ্যাঁ, হিন্দু ও বৌদ্ধ শরণার্থীদের কথা আলাদা। আমরা তাদের ভারতের নাগরিকত্ব দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কাজেই তাদের প্রত্যেককে খুঁজে খুঁজে নাগরিক করবো আমরা, এ দেশে বসবাসের অধিকার দেবো!’
অমিত শাহ একবারও তার ভাষণে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা ব্যবহার করেননি, কিন্তু তিনি কোথা থেকে অনুপ্রবেশের কথা বলছেন, কোথা থেকে আসা হিন্দু বা বৌদ্ধ শরণার্থীদের কথা বলছেন, সেটা বুঝতে কারোর অসুবিধা হচ্ছে না।
বাংলাদেশ থেকে কথিত অনুপ্রবেশের ইস্যু আসাম তথা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বরাবরই একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর রাজনৈতিক ইস্যু। বিরোধী কংগ্রেসও কিন্তু এই ইস্যুতে সাবধানে পা ফেলতে চাইছে বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
কংগ্রেসের ইশতেহারে এনআরসি নিয়ে সরাসরি মন্তব্য এড়িয়ে গিয়ে বলা হয়েছে, উত্তর-পূর্ব ভারত চিরকালই একটি সংবেদনশীল এলাকা, আর তাই ওই অঞ্চলের জন্য সংবিধানে যে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া ছিল, সেটা ফিরিয়ে আনা হবে।
বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু বা বৌদ্ধদের নাগরিকত্ব দিতে বিজেপি যে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল এনেছিল সেই বিতর্কিত বিলটিও কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে প্রত্যাহার করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
তবে লক্ষণীয় হলো, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধী মাত্র দুদিন আগেই আসামের শিলচরে যে জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন, সেখানে তিনি এই নাগরিকত্ব বিলের প্রসঙ্গ পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন। বিশ্লেষকদের অনুমান, সম্ভবত বরাক উপত্যকার হিন্দু ভোটের কথা মাথায় রেখেই তিনি হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রস্তাবের প্রকাশ্য বিরোধিতা করতে চাননি।
আসামের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি নিয়ে নির্বাচনি রাজনীতি তুঙ্গে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস বলছে, তারা কিছুতেই ওই রাজ্যে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি তৈরি করতে দেবে না।
এদিকে শুধু বাংলাদেশ লাগোয়া রাজ্যগুলোতেই নয়, ‘বাংলাদেশ ফ্যাক্টর’ ছায়া ফেলছে সুদূর মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোর, জম্মু বা কেরালার তিরুবনন্তপুরমের মতো শহরগুলোতেও।
এসব শহরে কথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশি’দের বিরুদ্ধে ভোটের মৌসুমে আন্দোলন জোরদার করছে শিবসেনা, বিজেপি ও বজরং দলের মতো কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো।
কাজের সন্ধানে যে বাঙালিরা ওই সব জায়গায় গেছেন, তাদের ঢালাওভাবে ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে উচ্ছেদেরও চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের রাজনৈতিক নেতারা হয়তো ভোটের প্রচারে সরাসরি বাংলাদেশের নাম মুখে নিচ্ছেন না, কিন্তু বাংলাদেশের প্রসঙ্গ নির্বাচনি ইস্যু বা বাগবিতণ্ডায় থাকছেই।