বাংলা ট্রিবিউন:

২০১৭ সালের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এর আগে থেকে আরও প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা ছিল এ দেশে। বিপুলসংখ্যক এই রোহিঙ্গার একজনও এখন পর্যন্ত মিয়ানমারে ফেরত যায়নি। গত বছরের ১৫ নভেম্বর প্রত্যাবাসনের একটি চেষ্টা করা হলেও রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না থাকায় কোনও রোহিঙ্গা পরিবার ফেরত যেতে রাজি হয়নি।
এ প্রেক্ষাপটে সরকার আগের রোহিঙ্গা কূটনীতির মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক, বহুপাক্ষিক ব্যবস্থায় প্রত্যাবাসনের জন্য আরও জোরদার পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক বলেন, ‘এটি একটি সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এমন কোনও দ্বিপক্ষীয় বা বহুপাক্ষিক বৈঠক নেই যেখানে আমরা সুযোগ পেলে এ বিষয়টি উত্থাপন না করি।’ তার মতে, রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের মধ্যে কোনও সমস্যা নয়, বরং এটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। এর শুরু হয়েছে সেখানে এবং এর সমাধানও মিয়ানমারে রয়েছে।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘বাংলাদেশ পরিস্থিতির শিকার এবং আমরা এর থেকে উত্তরণের জন্য দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বহুপাক্ষিক ব্যবস্থায় চেষ্টা চালাচ্ছি।’
সরকারের আরেকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্ট ইতোমধ্যে বাংলাদেশে একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল। তাদের সব ধরনের সহায়তা দিতে বাংলাদেশ প্রস্তুত।’ তিনি জানান, শুধু তাই নয়, সম্প্রতি ওআইসি একটি রেজ্যুলেশন পাস করেছে, যার মাধ্যমে এর যেকোনও সদস্য দেশ আন্তর্জাতিক কোর্ট অব জাস্টিসে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে।
এম শহীদুল হক বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টে ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হয় এবং আন্তর্জাতিক কোর্ট অফ জাস্টিসে দেশের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। সুতরাং এখন উভয় পথেই দায়বদ্ধতার বিষয়টি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।’
দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র বলছে, প্রথম থেকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। মিয়ানমারের একাধিক প্ররোচনার পরও বাংলাদেশ কোনও শক্তি প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকে। মিয়ানমারের হেলিকপ্টার ও বিমান একাধিকবার সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করলেও বাংলাদেশ কোনও পাল্টা পদক্ষেপ নেয়নি।
সূত্রগুলো জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেকোনও ধরনের শক্তি প্রয়োগের বিরুদ্ধে এবং ২০১৭ সালে এই সংকট শুরু হওয়ার আগেও তিনি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের প্রস্তাব করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখেছিলেন।
অনেক আলোচনার পর ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রত্যাবাসনসংক্রান্ত একটি চুক্তি সই হয় এবং এর অধীনে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। এ পর্যন্ত এই কমিটি দুটি বৈঠক করেছে এবং তৃতীয়টি এ মাসেই হওয়ার কথা।
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এটি পরিষ্কার, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াতে কোনও ধরনের উন্নতি নেই এবং সে জন্য আমরা নতুন কিছু আগামী বেঠকে প্রস্তাব করার চিন্তা করছি।’ তিনি জানান, এই সংকটের সঙ্গে জড়িত সবার সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে যাতে করে প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়টি ত্বরান্বিত হয়।
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশ চায় টেকসই প্রত্যাবাসন। যাতে করে এই রোহিঙ্গারা আর ফেরত না আসে এবং তাদের অধিকার যেন প্রতিষ্ঠিত হয়।’
তিনি বলেন, নভেম্বরে যে চুক্তি হয়েছে সেখানে বলা আছে রোহিঙ্গারা যেন নিরাপদে রাখাইনে অবস্থান করতে পারে এবং তাদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা তাদের অধিকার না থাকায় ১৯৭৮ পালিয়ে এসেছে, ১৯৯২ সালে এসেছে এবং আমরা চাই না তারা আর বাংলাদেশে আসুক।
আঞ্চলিক যোগাযোগ
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, চীন ও ভারতসহ এই অঞ্চলের সব দেশের সঙ্গে এই সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ যোগাযোগ রক্ষা করে আসছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সাম্প্রতিক ভারত সফরে এ বিষয়ে আলোচনা হয়। অন্যদিকে চীনের বিশেষ দূত সান গোসিয়াং রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনার জন্য একাধিকবার ঢাকা সফর করেছেন।
সরকারের আরেকজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চীন ও ভারত উভয় দেশের নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ আছে এবং মিয়ানমারে তাদের স্বার্থ আছে এবং এই প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিয়ে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে আছে বলে জানিয়েছে।’
তিনি জানান, প্রতিটি দেশ রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার বিষয়ে একমত, কিন্তু কীভাবে যাবে এবং কী শর্তে যাবে, সেটি নিয়ে মতভেদ আছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘চীন আমাদের একাধিকবার অনুরোধ করেছে যাতে করে আমরা বিষয়টি আন্তর্জাতিকীকরণ না করি। কিন্তু এটি আমাদের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন এই কারণে যে আন্তর্জাতিক চাপ না থাকলে মিয়ানমার আমাদের সঙ্গে যে আলোচনায় বসেছে, সেটিও বসতো না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বৈঠকে তাদের সবসময় অনুরোধ করি তারা যেন মিয়ানমারকে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে প্রভাবিত করে এবং তারা আমাদের এ বিষয়ে আশ্বস্ত করেছে।’
ভারতের বিষয়ে সরকারের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশটি আমাদের সঙ্গে আছে বলে জানিয়েছে, কিন্তু আমরা যে ধরনের আচরণ তাদের কাছে প্রত্যাশা করি, সেটি তারা করেনি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের অনুরোধ করেছি তারা যেন আমাদের উদ্বেগকে আমলে নেয় এবং এ বিষয়ে আরও জোরালো ভূমিকা রাখে।’
চীন ও ভারত ছাড়াও বাংরাদেশ আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ
পশ্চিমা দেশগুলো রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে আসছে এবং মানবিক সহায়তাও দিচ্ছে। কিন্তু তাদের সঙ্গেও কিছুটা মতপার্থক্য আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যতের বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলো চায় বাংলাদেশে তাদের ওপর বিনিয়োগ করতে যাতে মানবসম্পদের উন্নতি করা যায়। কিন্তু সরকার চায় এই বিনিয়োগ রাখাইনে করার জন্য, যাতে করে তারা ফেরত গিয়ে সেখানে সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে।
একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা সবাই চাই রোহিঙ্গাদের নিরাপদ এবং সম্মানজনক প্রত্যাবাসন। কিন্তু কয়েকটি বিষয়ে তাদের ওপর আমাদের মতপার্থক্য আছে এবং আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে একটি কমপ্রোমাইজে পৌঁছানো যায়।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সবর্তোভাবে সহায়তা করছে এবং আমরা চাই তারা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করুক।’
এদিকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের তৃতীয় দেশে স্থানান্তরের (রিলোকেট) বিষয় নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়ার অপপ্রচারণা নিয়ে বিরক্ত।
সরকারের আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘গত নভেম্বরে আমরা যখন প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম, তখন একটি পশ্চিমা মিডিয়া প্রচার করলো যে বাংলাদেশ কানাডাতে সীমিতসংখ্যক রোহিঙ্গার রিলোকেশন প্রস্তাবে রাজি নয়।’
তিনি বলেন, ‘প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে ১০ জনেরও কম রোহিঙ্গা, যারা বাংলাদেশে অবস্থান করছে, তাদের পরিবারের পুনর্মিলনের বিষয়ে কানাডার পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে জানতে চাওয়া হয়েছিল মাত্র।’