মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :
কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলার বারবাকিয়া ইউনিয়নের সোনাইছড়ি গ্রাম। ১৯৯১ সালের ১৬ এপ্রিল বিকেল ৪টা। সীমানা বিরোধের জের ধরে বিরোধীয় দু’পক্ষের সংঘর্ষে স্থানীয় কালা মিয়ার ১৩ বছরের কন্যা রোকেয়া বেগম নিহত হয়। এ ঘটনায় কালা মিয়ার নিকটাত্মীয়, সোনাইছড়ি জামে মসজিদের ইমাম ও আবদুস সমদের পুত্র মাওলানা সালাহউদ্দীন বাদী হয়ে তৎকালীন চকরিয়া থানায় ১০ জনকে আসামী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার চকরিয়া থানা মামলা নম্বর ১৫/১৯৯১ ইংরেজি, জিআর মামলা নম্বর ৫৮/১৯৯১ ইংরাজি (চকরিয়া), এসটি মামলা নম্বর ২৬১/২০১১ ইংরেজি। ধারা হলো ফৌজদারী দন্ডবিধি ৪৪৭/৩২৩/৩২৪/৩২৫/৩০২/ ৩৪। প্রায় ২৮ বছর আগে দায়ের হওয়া মামলার আসামীরা হলেন-আমীন শরীফের পুত্র নুরুল আলম, নুরুল আলমের কন্যা পুতুনী, আমিন শরীফের কন্যা আনোয়ারা বেগম, ফতেহ আলীর পুত্র কাছিম, মৃত সিরাজ মিয়ার পুত্র শাহ আলম, মৃত আবদুর রহমানের পুত্র নজীর আহামদ, মৃত ইজ্জত আলীর পুত্র বুদরুজ মিয়া, নুর আহমদের পুত্র আইয়ুব আলী, বুদরুজ মিয়ার পুত্র আবদুল কাদের এবং নুরুল কবিরের পুত্র আবদুল মালেক। ১৯৯১ সালের ১৭ জুলাই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলাটির অভিযোগপত্র দেন। যার নম্বর ৯৮/১৯৯১। মামলার এজাহারভুক্ত ৩ নম্বর আসামী আনোয়ারা বেগম ২০০২ সালের ৩ জুলাই গ্রেপ্তার হয়। মামলার অন্য ৯ জন আসামীও পুলিশ কতৃক বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হয়। এই ৯ জন আসামীর সকলে প্রথমে নিম্ম আদালতে জামিন চাইলেও নিম্ম আদালতের বিচারক জামিন নামন্ঞ্জুর করেন। পরে নিম্ম আদালতের নামন্ঞ্জুর আদেশের বিরুদ্ধে আপীল করে উচ্চ আদালত হতে ৯ জন আাসামীই জামিন পায়। মামলাটি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে থাকতেই উক্ত ৯ জন আসামী জামিনে মুক্তি লাভ করেন। মামলাটি চকরিয়া সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত হতে বিচারের জন্য বদলী হয়ে ২০১১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। এসময়ে মধ্যে আসামীদের একজন মৃত্যূবরন করেছে বলে জানা গেছে। মামলাটি বিচারের জন্য দায়রা জজ আদালতে আসলেও কারাবন্দী আনোয়ারা বেগমের তখনো জামিন হয়নি। ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি বিকেল ৩ টায় কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ খোন্দকার হাসান মোঃ ফিরোজ কক্সবাজার জেলা কারাগার পরিদর্শনে যান। সাথে ছিলেন কক্সবাজারের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তৌফিক আজিজ, সিনিয়র সহকারী জজ আলাউল আকবর, সিভিল সার্জন ডাঃ আবদুল মতিন, সহকারী সিভিল সার্জন ডাঃ মহিউদ্দিন আলমগীর, জেল সুপার বজলুর রশিদ আকন্দ, জেলার বিতে চাকমা, ডেপুটি জেলার মনির হোসেন, অর্পন চৌধুরী, জেলা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এস.এম আব্বাস উদ্দিন ও ফার্মাসিস্ট ফখরুল আজিম। এ পরিদর্শনই অসহায় আনোয়ারা বেগমের জামিনের উসীলা হয়ে যায়। কারাগারে মহিলা ওয়ার্ড পরিদর্শনের সময় একজন মহিলাবন্দী জেলা ও দায়রা জজের সামনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলে জেলা ও দায়রা জজ খোন্দকার হাসান মোঃ ফিরোজ মহিলার কাছ থেকে তার কান্নার কারণ কি জানতে চান। পরে আনোয়ারা বেগম তার পরিচয় দিয়ে প্রায় ১৭ বছর যাবৎ বিনা বিচারে সে কারান্তরীন থাকার কথা জানান। আনোয়ারা বেগম বলেন-গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার জামিনের তদবির করার জন্য কোন স্বজন নাথাকায় সে একবারের জন্যও আদালতে জামিন আবেদন করতে পারেনি। তাই সে দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর যাবৎ কারাবন্দী রয়েছে। প্রায় ২০ বছর বয়সে আনোয়ারা বেগম গ্রেপ্তার হলে জীবনের স্বর্ণালী যৌবন কারাগারেই শেষ করে এখন তার বয়স ৩৭ বছর উত্তীর্ণ। আনোয়ারা বেগমের করুণ আকুতি শুনে কোমল হৃদয়ের অধিকারী জেলা ও দায়রা জজ খোন্দকার হাসান মোঃ ফিরোজ তখনি কোন আইনজীবীর মাধ্যমে তাঁর আদালতে জামিনের আবেদন করার ব্যবস্থা করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী গত ১৭ ফেব্রুয়ারি এডভোকেট সাইফুল হক জেলা ও দায়রা জজ খোন্দকার হাসান মোঃ ফিরোজের আদালতে আনোয়ারা বেগমের জামিন আবেদন করেন। শুনানী শেষে আদালত দীর্ঘ হাজতবাস ও নারী বিবেচানায় ১০ হাজার টাকা বন্ডে আনোয়ারা বেগমের জামিন মন্ঞ্জুর করেন। সোমবার ১৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ২৮ বছর আগে দায়ের হওয়া মামলায় আনোয়ারা বেগমের জামিননামা জেলা কারাগারে প্রেরন করা হয় বলে জেলা আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এস.এম আব্বাস উদ্দিন সিবিএন’কে নিশ্চিত করেছেন। তবে আনোয়ারা বেগমের বিরুদ্ধে অন্য একটি মামলায় সাজা থাকায় তাকে কারামুক্ত হতে আরো বছর খানেক সময় লাগবে বলে কক্সবাজার জেলা কারাগারের জেল সুপার বজলুর রশিদ আখন্দ সিবিএন’কে জানিয়েছেন। ২৮ বছর আগে মামলাটি দায়ের করা হলেও মামলাটির সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে নাআসায় মামলাটির বিচার কার্যক্রমে কোন অগ্রগতি নেই। মামলাটির ডকুমেন্টে পর্যালোচনায় দেখা গেছে-আনোয়ারা বেগমের বিরুদ্ধে এজাহার, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট, সুরতহাল রিপোর্ট, ১৬১ ধারার জজবানবন্দী , অভিযোগপত্র সহ অন্যান্য কাগজপত্রে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ নেই। আনোয়ারা বেগম দোষী কি নির্দোষ-সেটা বিজ্ঞ আদালতের বিচার্য্য বিষয়। কিন্তু বিনাবিচারে আনোয়ারা বেগমকে ১৭ বছর জেল খাটতে হলো। আনোয়ারা বেগম জেলা ও দায়রা জজ খোন্দকার হাসান মোঃ ফিরোজের জেল পরিদর্শনকালে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে নাপারলে আরো কতদিন পরে জামিন পেতো সেটা একমাত্র আল্লাহই জানেন। জেলা ও দায়রা জজ খোন্দকার হাসান মোঃ ফিরোজের বদন্যতায় অসহায় আনোয়ারা বেগম জামিন পেলেও দীর্ঘ ২৮ বছর যাবৎ মামলাটির বিচার কার্যক্রমের খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। সাক্ষী দিতে নাআসায় ধার্য্যদিনে রাষ্ট্রপক্ষ মামলায় বার বার সময়
চেয়ে আবেদন করেন বলে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সিনিয়র বেন্ঞ্চ সহকারী নুরুল হুদা জানিয়েছেন। এদিকে, ২৮ বছর আগে দায়ের হওয়া উক্ত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও), সুরতহাল রিপোর্ট তৈরীকারী পুলিশ কর্মকর্তা, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক সহ সরকারি সাক্ষীর প্রায় সকলেই চাকুরী শেষে অবসরে চলে গেছেন বলে অন্য একটি সুত্র জানিয়েছে। ২৮ বছর আগে দায়ের করা মামলাটির প্রায় সরকারি সাক্ষী অবসর চলে গেছে, প্রাইভেট সাক্ষীদের অনেকেই মারা গেছে, ডকুমেন্ট গুলো নথীতে ছিড়ে যাচ্ছে, আলামত গুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে-এ অবস্থায় মামলাটি চুড়ান্ত নিষ্পত্তি হতে আর ক’বছর লাগবে সেটা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত।