শাহেদ মিজান, সিবিএন:

মহেশখালীর কালারমারছড়ায় অধিগ্রহণ করা জমির পানবরজের ক্ষতিপূরণের প্রায় ২২ কোটি লোপাট করা হয়েছে। কিছু জমির প্রকৃত মালিকের টাকাও লুটপাট করা হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ শাখার লোকজন ও স্থানীয় কিছু লোকজন সিন্ডিকেট করে এসব টাকা লুটপাট করেছে। এই বিশাল দুর্নীতির খবর প্রকাশ হওয়ার পর ভুক্তভোগীরা চরম ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। এর প্রতিকার চেয়ে তারা জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। এর প্রতিাবাদ জানিয়ে গতকাল ২২ জানুয়ারি মঙ্গলবার কালারমারছড়ায় প্রধান সড়কে এক প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন ভুক্তভোগীরা।

অভিযোগ মতে, কালারমারছড়ার সোনারপাড়ায় সরকার বিপুল জমি অধিগ্রহণ করছে। অধিকাংশ জমিতে বর্তমানে পানবরজ রয়েছে। প্রায় দেড়শ পানচাষী পানবরজ চাষ করেছেন। অধিগ্রহণের আওতায় পড়ায় জমিগুলো দখলে নিতে পানবরজ গুটিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

তথ্য মতে, এসব জমি ও জমির অবকাঠামোর জন্য একর প্রতি ৬২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য্য করা হয়েছে। অবকাঠামো হিসেবে রয়েছে পানের বরজ। টাকা ছাড় দেয়ার জন্য ২২ ধারা নোটিশ জারি করে ভূমি অধিগ্রহণ শাখা। ২২ধারায় জমির মালিক ও পানবরজের ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নির্দিষ্টভাবে ক্ষতিপূরণের টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু কিছু জমির মালিক ও ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজস করে ২২ ধারা নোটিশ গোপন করে প্রকৃত মালিকদের অগোচরে প্রায় ২২ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। এসব টাকা ভূমি অধিগ্রহণ শাখার লোকজন ও ওই স্থানীয়রা অসাধু ব্যক্তিরা অর্ধেক অর্ধেক ভাগ-ভাটোয়ারা করে নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।

জেলা প্রশাসককে দেয়া অভিযোগপত্র মতে, টাকা লোপাটের এই সিন্ডিকেটে রয়েছেন চিকনী পাড়ার মৃত হোছন আলীর পুত্র নূরুল ইসলাম বাহাদুর, নোয়াপাড়ার মৃত ফলাতনের পুত্র আবদুল মান্না কানু, চিকনী পাড়ার ছৈয়দ আহমদের পুত্র আবদুস সালাম ও নূরুল ইসলাম, সোনার পাড়ার নূও আহামদেও পুত্র পেরু, চিকনীপাড়ার ছৈয়দ আহমদের পুত্র আবু ছিদ্দিক, সোনারপাড়ার মৃত কবির আহমদের পুত্র মনজুর আলম এবং ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কানুনগো শাওনেয়াজ কুতুবী, সার্ভেয়ার ফরিদুল আলম।

এর প্রতিাবাদ জানিয়ে গতকাল ২২ জানুয়ারি মঙ্গলবার কালারমারছড়ায় প্রধান সড়কে এক প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন ভুক্তভোগীরা। প্রায় দু’শতাধিক ভুক্তভোগী সেখানে সমবেত হন। সেখানে তারা নানা ভূমি অধিগ্রহণ শাখার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও ওই স্থানীয় লোকজনের বিষোদ্গার করে নানা শ্লোগান দেন। এসময় তারা ২২ কোটি টাকা লোপাটকারীদের কঠোর শাস্তি দাবি করে ক্ষতিপূরণের টাকা দেয়া আকুতি জানান।

এসময় সোনাপাড়ার আমান উল্লাহ জানান, তার রেকর্ডীয় ৭০ শতক জমি অধিগ্রহণের আওতায় পড়েছে। তিনি দীর্ঘদিন গুরুতর অসুুস্থ হয়ে চট্টগ্রামের এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেই সময় তার অনুপস্থিতির সুযোগে দুর্নীতিবাজ চক্র তার জমির ক্ষতিপূরণের টাকা তুলে নিয়েছে।

স্থানীয় মৃত মনুর দু’স্ত্রী মাহমুদা ও হামিদা জানান, স্বামীর ওয়ারিশসূত্রে মাহমুদা ও হামিদা ৮০ শতক করে জমি পেয়েছেন। এসব জমি গত ২০ বছর ধরে পানচাষ করা হচ্ছে। অধিগ্রহণের আওতায় পড়ায় তাদের তারা ২০ ধারা নোটিশও পেয়েছেন। কিন্তু টাকা উত্তোলনের ২২ ধারা নোটিশ পাননি। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তাদের জমির দেড়কোটি তুলে নিয়েছে দুর্নীতিবাজ চক্র। এই কথা বলে গতকাল গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে কান্নায় লুটিয়ে পড়েন তারা দু’জন।

সোনারপাড়া পানচাষী জামাল উদ্দীন, তাজ উদ্দীন, আবুল হোসেনসহ অন্যান্য পানচাষীরা জানান, একর প্রতি প্রায় তিন লাখ টাকা লাগিয়ত দিয়ে তারা পান বরজ চাষের জন্য জমিগুলো লাগিয়ত নিয়েছেন। চাষাবাদের জন্যও আরো কয়েকগুণ টাকা খরচ হয়েছে। বর্তমানে পানবরজগুলোতে আয়ের দিন শুরু হয়েছে। এই মুহূর্তে বরজগুলো গুটিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা ক্ষতিপূরণের আওতায় এসে ২০ ধারা নোটিশ পেলেও চূড়ান্তভাবে ২২ ধারা নোটিশ পাননি। খোঁজ নিয়ে জেনেছেন- তাদের টাকা গুলো তুলে নেয়া হয়েছে।

তারা বলেন- এত বিপুল টাকা খরচ করে করা পানবরজগুলো চলে গেলে তারা নি:স্ব হয়ে যাবেন। ক্ষতিপূরণের টাকাগুলো না পেলে তাদেরকে পরিবার নিয়ে আত্মহত্যা করতে হবে।

অন্যদিকে ১০ একর জমি লাগিয়ত করলেও অধিগ্রহণের কথা বলে তাদের পানের বরজ করতে দেয়নি প্রতারকরা। কিন্তু জমিগুলো দেখিয়েও টাকা তুলে নিয়েছে ওই দুর্নীনিবাজ চক্র। ধানি জমিকে পানবরজের জমি দেখিয়েও কোটি কোটি হাতিয়ে নিয়েছি চক্রটি।

এদিকে জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে করা তদন্তটি ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কানুনগো শাওনেয়াজ কুতুবী, সার্ভেয়ার ফরিদুল আলমকে দিয়ে করানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগীরা। তারা জানিয়েছেন, টাকা লোপাটের সাথে জড়িতদের দিয়ে করানো তদন্ত সঠিক হবে না। নিরপেক্ষ সরকারি কর্মকর্তা দিয়ে স্বচ্ছভাবে তদন্ত করারও দাবি জানান তারা।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এড. সিরাজুল মোস্তফা বলেন, ‘ক্ষতিপূরণের ২২ কোটি লোপাট করার ঘটনাটি আমি জেনেছি। এটা নিয়ে আমি জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলেছি। তিনি বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবে বলে জানিয়েছেন। টাকা লোপাটকারীদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। এর জন্য যেখানে যেতে হয় আমি সেখানে যাবো।’

জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন আমার কাছে অভিযোগ নিয়ে এসেছিল। তাদের অভিযোগ গুরুত্বসহকারে নিয়ে আমি দ্রুত তা তদন্ত করার ব্যবস্থা করেছি। তদন্তে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রমাণ পেলে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

এ ব্যাপারে ভুক্তভোগীদের সব ধরণের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক।