সিবিএন ডেস্ক:
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তীব্র ক্ষোভ আর নিন্দায় সামিল হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের নীরব মিত্র শক্তি ইসরায়েলও এবার অনুসন্ধানী সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডকে ‘ভয়ঙ্কর’ আখ্যা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের তাগিদও দিয়েছেন। তবে স্পষ্ট করে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, খাশোগির হত্যা রহস্য উন্মোচনের সমান্তরালে সৌদি আরবের স্থিতিশীলতা তার দেশের জন্য জরুরি। ওই হত্যাকাণ্ডে যখন সৌদি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ইন্ধন এবং যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ঘুরেফিরে আসছে ঠিক সে সময় সৌদি স্থিতিশীলতার ওপর জোর দিলেন নেতানিয়াহু। তার সরকারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যম দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের কাছে দাবি করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো করেই খাশোগি হত্যার দায় থেকে সৌদি আরবকে নিষ্কৃতি দিতে চাইছে ইসরায়েল। ওই সংবাদমাধ্যম তাই ‘খাশোগি হত্যাকাণ্ড সত্ত্বেও সৌদি যুবরাজের পাশে ইসরায়েল’ শিরোনামে খবর লিখেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানবিরোধী রাজনীতির স্বার্থে সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র যেমন দেখতে চায়, নেতানিয়াহুর মন্তব্য তারই প্রতিফলন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, ইরানবিরোধী অবস্থান সমুন্নত রাখা তার জন্য খাশোগি হত্যা রহস্য উন্মোচনের মতোই জরুরি।
২ অক্টোবর ইস্তানবুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনে প্রবেশের পর নিখোঁজ হন সৌদি অনুসন্ধানী সাংবাদিক জামাল খাশোগি। কনস্যুলেট ভবনে তার হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার কথা স্বীকার করলেও এর সঙ্গে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান কিংবা অন্য কোনও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ নাকচ করে আসছে দেশটি। তবে সৌদি আরবের এমন দাবি মানছে না তুরস্কসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বড় অংশ। ইউরোপীয় দেশগুলো রিয়াদের বিরুদ্ধে সোচ্চার, জার্মানি তাদের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও চাপের মুখে পড়েছেন তার সৌদি সখ্য নিয়ে। দেশের ভেতরে কেবল বিরোধী ডেমোক্র্যাট শিবির নয়, নিজ দল রিপাবলিকান পার্টির অভ্যন্তরেও সমালোচিত হওয়ার এক পর্যায়ে তিনি এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হয়েছেন। এবার সেই ধারাবাহিকতায় সামিল হলো ইসরায়েল। খাশোগি হত্যার ঘটনায় এতোদিন নীরব দর্শকের ভূমিকার পালনকারী ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু শুক্রবার (২ নভেম্বর) বুলগেরিয়ায় সাংবাদিকদের বলেছেন, গত মাসে সৌদি কনস্যুলেট ভবনে যা ঘটেছে তা ‘ভয়ঙ্কর এবং এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।’ তবে একইসঙ্গে সৌদি আরবকে স্থিতিশীল রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘একইসময়ে বিশ্ব ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থে সৌদি আরবকে স্থিতিশীল রাখা জরুরি।’
ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে কোনও আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের মধ্যে গোপন রাজনৈতিক, গোয়েন্দা ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের খবর উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যমে। সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সৌদি ইসরায়েল সম্পর্ককে ট্রাম্প তার কথিত ‘মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনার’ও কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছেন। রিয়াদে সৌদি যুবরাজের সঙ্গে সাক্ষাতের পর পরই ট্রাম্পকে ইসরায়েল সফরে যেতে দেখা গেছে। গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী দ্য আটলান্টিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান স্পষ্ট করেই বলেছেন, বহু বিষয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। একইসঙ্গে তিনি মার্কিন নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে জন্ম নেওয়া ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অধিকারের পক্ষে নিজের অবস্থানের কথা জানান। সৌদি যুবরাজ সে সময় বলেন, ফিলিস্তিনিদের পাশাপাশি ইসরায়েলিদেরও তাদের নিজেদের ভূমিতে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের ‘অধিকার’ রয়েছে। এদিকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও সৌদি আরবের সঙ্গের বিদ্যমান সম্পর্ক ক্রমাগত আরও জোরালো করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ইরানকে পরাস্ত করতেই সৌদি-ইসরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্যের সবথেকে পরীক্ষিত মিত্র হিসেবে দেখে যুক্তরাষ্ট্র। সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাশোগি হত্যার ঘটনাটি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে মনযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। আর তা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের জন্য বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব ঠেকানোর প্রচেষ্টায় ৩৩ বছর বয়সী যুবরাজকে নিজেদের পাশে রাখতে চায় এ দুই দেশ।
কিভাবে আরব দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিবিড় করছে তা নিয়ে প্রায়ই কথা বলেন নেতানিয়াহু। তবে শুক্রবার (২ নভেম্বর) বুলগেরিয়ায় বক্তব্য দেওয়ার আগে পর্যন্ত কখনও সৌদি আরবের নাম সরাসরি উচ্চারণ করেননি তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জ্যেষ্ঠ এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা সিডনি মর্নিং হেরাল্ডকে জানান, খাশোগি হত্যা মামলা থেকে সরে আসতে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে লবিং করছে তার সরকার। ওই কর্মকর্তা জানান, সৌদি আরবের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে অস্ত্র চুক্তি বাতিল করার মতো কিছু হুমকি-ধামকি দেওয়া হতে পারে, তবে নিজেদের মধ্যকার ইরানবিরোধী জোটকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থই সেখানে অগ্রাধিকার পাবে।
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করার মধ্য দিয়ে এমনিতেই নতুন আঞ্চলিক যুদ্ধরেখা টেনে রেখেছেন ট্রাম্প। ইউরোপীয়, রুশ ও চীনা স্বাক্ষরকারীরা নিজেদেরকে এ চুক্তিতে যুক্ত রেখেছে। আর এক্ষেত্রে ইরানবিরোধী যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে তেহরানের শত্রু দেশ সৌদি আরব। সে কারণেই খাশোগি হত্যার ঘটনা নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে নিন্দার ঝড় উঠেছে, তাতে বেকায়দায় রয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। একদিকে সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ রাখতে অস্বীকৃতি জানিয়ে যাচ্ছেন তিনি, অন্যদিকে মধ্যবর্তী নির্বাচনকে সামনে রেখে নৈতিক অবস্থান নিতে তার ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছেন আইনপ্রণেতারা। সৌদি যুবরাজ্যের সুনামহানি হলে মার্কিন পরিকল্পনার প্রতি আরব রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন জোগাড়ে তার সক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। লন্ডনভিত্তিক গালফ স্টেট অ্যানালিটিকস-এর বিশ্লেষক সিনজিয়া বিয়ানকো বলেন, ‘আঞ্চলিক রাজনীতির এ পর্বটি, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে। কারও কাছ থেকে তার সমর্থন আদায়ের সক্ষমতাও হ্রাস পাবে-এটি সেই সক্ষমতা যা ট্রাম্প অন্তরালে থেকে সৌদি যুবরাজের কাছ থেকে চাইছেন বলে মনে করা হয়।’ সৌদি আরব ছাড়াও পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ছে ইসরায়েল। ২৫ অক্টোবর নেতানিয়াহু ওমান সফর করেছেন, দেশটির সুলতান কাবুস বিন সাইদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ২২ বছরের মধ্যে ওমানের প্রথমবারের মতো কোনও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে জনসমক্ষে দেখা গেছে।
শুক্রবার (২ নভেম্বর) বুলগেরিয়ায় সৌদি স্থিতিশীলতার পক্ষেদেওয়া বক্তব্যে নেতানিয়াহু বলেন, ‘নিরাপত্তার স্বার্থেই ইরানকে ঠেকানোর পক্ষপাতী আমরা, এ কেবল ইসরায়েলের স্বার্থ নয়, ইউরোপসহ গোটা বিশ্বের জন্যই জরুরি। আমি মনে করি উভয় লক্ষ্য অর্জনে (খাশোগির হত্যা রহস্য উন্মোচন ও ইরানবিরোধী অবস্থান) আমাদেরকে একটি পথ খুঁজে বের করতে হবে।’ উল্লেখ্য, খাশোগি হত্যাকাণ্ডে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ হলে সৌদি আরবের শাসন ব্যবস্থায় তার ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে বলে এরইমধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবরে। এমন সময়ে নেতানিয়াহুর এই মন্তব্য বিশ্লেষণ করে সিডনি মর্নিং হেরাল্ড বলছে, খাশোগি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সৌদি যুবরাজের অবস্থান সমুন্নত রাখাকেই কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু বানিয়েছে ইসরায়েল।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।