বিদেশ ডেস্ক :

তুরস্কে নিযুক্ত সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্বজুড়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে সৌদি আরব ও দেশটির প্রভাবশালী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে সৌদি যুবরাজকেই দায়ী করা হচ্ছে। খাশোগি হত্যাকাণ্ডের আগে থেকেই ইয়েমেনে নৃশংস যুদ্ধ ও সেখানে বেসামরিক হত্যা, ভিন্নমতালম্বীদের দমন এবং নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে পশ্চিমা ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো নিন্দা ও সমালোচনা করে আসছে। এবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) সৌদি যুবরাজের কাছে ১০টি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। সংগঠনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, এ বিষয়ে সৌদি সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে বিশ্বনেতাদের আহ্বান জানিয়েছে তারা।   

সংস্থাটির মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের উপ-পরিচালক মাইকেল পেজ বলেন, ‘খাশোগির এই নির্মম হত্যাকাণ্ড আসলে কোনও ভুল হওয়া মিশন নয়। বরং অনেকদিন ধরে চলে আসা সৌদি আরবের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধারা। তারা মনে করে সৌদি যুবরাজ ও অন্যান্য কর্মকর্তারা আইনের ঊর্ধ্বে।’ তিনি বলেন, এই সুযোগেই সৌদি আরবকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। অনেকদিন ধরেই সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ২০১৫ সালের মার্চ মাস থেকে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ইয়েমেনে হামলা চালিয়ে আসছে। তাদের উদ্দেশ্য, দেশটির আন্তর্জাতিকভাবে বৈধ হিসেবে স্বীকৃত প্রেসিডেন্ট আবু রাব্বু মানসুর হাদির সরকারকে স্থিতিশীল করা। ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা হাদি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত অন্তত ১০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। আর এই ইস্যুটি নিয়েই এইচআরডব্লিউ’র প্রথম প্রশ্ন-  ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট কেন অবৈধভাবে হামলা চালিয়েই যাচ্ছে এবং বেসামরিক হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বেসামরিকদের সুরক্ষা দিতে কেন ব্যর্থ হচ্ছে?

দ্বিতীয় প্রশ্নে সৌদি আরবের নারী অধিকারকর্মীদের প্রসঙ্গে। ২০১৮ সালের মে মাস হতে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন নারী অধিকারকর্মীকে গ্রেফতার করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। এদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী গাড়ি চালানোর অনুমতি ও পুরুষ অভিভাবকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রচারণায় যুক্ত ছিলেন। মে মাসে কর্তৃপক্ষ নারী অধিকারকর্মী এমান আল-নাফজান, লুজাইন আল-হাতলুল, আজিজা আল-ইউসেফ, আয়শা আল-মানিয়ে, ইব্রাহিম মোদেইমাহ ও মোহাম্মদ আল-রাবেয়াকে গ্রেফতার করে। কর্তৃপক্ষ জানায়, বিদেশি শক্তির সঙ্গে যোগসাজশ ও বিদেশি শত্রুদের আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার মতো সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডের জন্য সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্ত চলাকালে আরও গ্রেফতার করা হতে পারে। এই পরিস্থিতি নিয়ে সংস্থাটির প্রশ্ন-  নারী অধিকারকর্মীদের কেন আটক করেছে সৌদি আরব এবং তাদের কবে মুক্তি দেওয়া হবে?

জামাল খাশোগির ছাড়াও বিদেশে বসবাস করা অন্যান্য মানবাধিকারকর্মীদের হেনস্তা করে আসছে সৌদি আরব। চলতি বছর মার্চে সংযুক্ত আরব আমিরাতে থাকা বিশিষ্ট অধিকারকর্মী লুজাইন আল হাতাউল নিরাপত্তা বাহিনীর হয়রানির শিকার হন। আমিরাতে পড়াশোনা করলেও তাকে রিয়াদে জোর করে ফিরিয়ে আনা হয়। ফিরিয়ে আনা হয় জর্ডানে থাকাতার স্বামীকেও।  অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, কানাডায় থাকা সৌদি অধিকারকর্মী ও যুক্তরাজ্য জানিয়েছে এই অধিকারকর্মীদের ওপর নজরদারি ব্যবস্থা চালু রেখেছিল সৌদি আরব। এইচআরডব্লিউ’র তৃতীয় জিজ্ঞাসা, বিদেশ অবস্থান করা মানবাধিকারকর্মীদের কেন টার্গেট করছে সৌদি আরব?

মোহাম্মদ বিন সালমানকে সৌদি যুবরাজ ঘোষণা করার পর থেকেই দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে দেশটিতে শুরু হয় ধরপাকর। এইচআরডব্লিউ প্রশ্ন করে, কেন ৩০০ এরও বেশি প্রিন্স, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তাদের আটক করেছে সৌদি আরব? তাদের অনেককেই রিতজ কার্টন হোটেলে আটকে রাখা হয়েছে এবং কেন তাদের ব্যাপারে কোনও আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি?

পুরুষের অভিভাবকত্বের বিধানকে কেন্দ্র করে আবারও নারী অধিকারের বিষয়টি সামনে আনে এইচআরডব্লিউ। কট্টর ইসলামি শাসন ব্যবস্থার তেল নির্ভর অর্থনীতির দেশ সৌদি আরবে নারীদের জন্য অভিভাবকত্ব আইন প্রচলিত রয়েছে। এই আইন অনুযায়ী নারীদের ঘরের বাইরে বের হওয়াসহ অন্য কাজের আগে অভিভাবকের অনুমতির দরকার পড়ে। গত বছর অর্থনৈতিক নির্ভরতা কমাতে সৌদি যুবরাজ এক সংস্কার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এর আওতায় দেশটিতে মে মাসে প্রথমবারের মতো গাড়ি চালানোর অনুমতি পেয়েছেন নারীরা। তবে অভিভাবকত্ব আইন বহাল থাকায় ওই অনুমতির সুফল পাওয়া নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন অনেকে। সংস্থাটি  প্রশ্ন করে,সৌদি নারীদের দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য কেনপুরুষ আত্মীয় সঙ্গেথাকতে হবে?

সৌদি আরবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করলেও অনেক সময় সরকারের রোষানলে পড়তে হয় আন্দোলনকারীদের। কখনও কখনও কারাদণ্ড দেয় আদালত। হিউম্যান রাইটস প্রশ্ন,  শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কারণে কেন রাইফ বাদাউই, ওয়ালিদ আবু আল-খায়ের, মোহাম্মদ আল-কাহতানিকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে?

সামার বাদাউই সৌদি ব্লগার রাইফ বাদাউইয়ের বোন। ইসলাম অবমাননা ও সৌদি সাম্রাজ্যের প্রভাবশালী ধর্মভিত্তিক শাসকগোষ্ঠীকে অপমান করার অভিযোগে গত বছর অর্ধশত বেত্রাঘাতের দণ্ড ভোগের পর বর্তমানে ১০ বছরের কারাদণ্ডে রয়েছেন রাইফ বাদাউই। আর কর্মক্ষেত্র বিষয়ক নানা অভিযোগসহ রাইফ বাদাউইয়ের হয়ে আইনি লড়াই করার অভিযোগে ১৫ বছরের জেল খাটছেন ওয়ালিদ আবু আল খায়ের। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সৌদি আরবে প্রথম দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি খায়ের। টুইটারে সবচেয়ে প্রভাবশালী আরব ব্যক্তিত্ব হিসেবে ফোর্বসের শত ব্যক্তির তালিকায় উঠে এসেছিল তার নাম।

সপ্তম প্রশ্নে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে হাজার হাজার মানুষকে আটক রাখার বিষয়টি উঠে এসেছে। কয়েকজনকে তো ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আটকে রাখা হয়েছে। চলতি বছর এপ্রিলে এক প্রতিবেদনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, ছয় মাসের বেশি সময় ধরে আটক আছে ২৩০৫ জন, এক বছরের বেশি সময় থরে আছেন ১৮৭৫ জন। ও তিন বছরের বেশি সময় ধরে বিনা বিচার আটকে আছেন ২৫১ জন সৌদি নাগরিক। তাই যুবরাজের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে- কোনোরকম অভিযোগ ও মামলা ছাড়া সন্দেহভাজন কাউকে মাসের পার মাস, এমনকি বছরের পর বছর আটক রাখা হয় কেন?

অষ্টম প্রশ্নে সৌদি সরকারের সমালোচনাকারীদের ওপর দমন-পীড়নের কথা তুলে আনা হয়েছে। ২০১৭ সালে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় অনেককে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়। কাউকে দেওয়া হয় ৫ থেকে ১০ বছরের সাজাও। তাদের অপরাধ ছিলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুবরাজ কিংবা বাদশার বিরুদ্ধে কথা বলা। এভাবে শান্তিপূর্ণ অনেক কাজকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আখ্যা দিয়েছে সৌদি সরকার। মানবাধিকার সংস্থাটি জানতে চেয়েছে,  সৌদি আরবে বাদশা সালমান কিংবা যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সমালোচনা করাকে সন্ত্রাসমূলক অপরাধ বিবেচনা করা হয় কেন?

২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৬৫০ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে সৌদি আরব। এর মধ্যে ২০০ জনই অসহিংস মাদক অপরাধে যুক্ত ছিল। ২০১২ সালে জাতিসংঘের বিশেষ দূত বলেছিলেন, মাদক সম্পর্কিত অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত নয়। এই ইস্যু নিয়ে যুবরাজের প্রতি নবম প্রশ্ন, সৌদি আরব এমন অপরাধে কেন মৃত্যুদণ্ড দেয় যা আন্তর্জাতিক আইনে গুরুতর অপরাধ নয়?

শেষ প্রশ্নে দেশটিতে ধর্মীয় আচার পালনে বৈষম্য ও নিপীড়নের বিষয়টি তুলে আনা হয়েছে। সৌদি আরবে ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্ম প্রকাশ্যে পালন করা যায় না। একইসঙ্গে সংখ্যালঘুদের নিপীড়নের শিকার হতে হয়। বিশেষ করে শিয়া মুসলিমদেরকে। শিক্ষা, বিচার ব্যবস্থা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, কর্মসংস্থান প্রভৃতি বিষয়ে বৈষম্য প্রকট। জানতে চাওয়া হয়েছে,  কেন সৌদি আরব অন্য ধর্ম পালনে সহযোগিতা করে না এবং শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর এত বৈষম্য কেন?