শাহীন মাহমুদ রাসেলঃ

সদরের লিংকরোড়ে থাকে পনের বছর বয়সী রাফিয়া জান্নাত। তার বাবা হামিদ আলী স্থানীয় একটি কারখানার শ্রমিক। রাফিয়ার স্বপ্ন পড়ালেখা করে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। শ্রমিক বাবার যেখানে তিন বেলা আহার জুটাতেই অনেক কষ্ট হয়, সেখানে মেয়েকে পড়ালেখা করানোর চিন্তা তো গরিবের ঘোড়ারোগের মতো। রাফিয়ার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসে অমাখোঁ ফাউন্ডেশন। অমাখোঁর প্রচেষ্টায় রাফিয়া এখন একাদশ শ্রেণির নিয়মিত শিক্ষার্থী। শুধু রাফিয়া নয়, শত শত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্বপ্নপূরণে কাজ করছে অমাখোঁ।

অমাখোঁ ফাউন্ডেশন আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত একটি স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক উন্নয়নমূলক সংস্থা। অমাখোঁর শুরুর গল্প বলতে গিয়ে সংগঠনের উদ্যোক্তারা জানান,সমাজ ও মানুষের মানোন্নয়নে সামাজিক সংগঠনগুলোর বিকল্প নেই। আর্ত্মমানবতার কল্যাণে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসা উচিত। সমাজের হতদরিদ্র মানুষের পাশে থেকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করা একটি মহৎ কাজ। সামাজিক পরিবেশ ও মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার ন্যায় সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে একটি সুখী-সুন্দর সমাজ বিনির্মান করা সম্ভব। তাঁরা ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে স্বপ্ন দেখতেন শিশু ও তরুণদের জন্য কাজ করার। ২০১৬ সালে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে একজন মুমূর্ষু রোগীর রক্তের প্রয়োজন। এক ব্যাগ রক্তদান করার মাধ্যমে সংগঠনের কাজ শুরু হয়।

যা ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত হয় অমাখোঁ ফাউন্ডেশন নামে। জাহাজের মাশুল যেমন জাহাজকে তীরে পৌঁছাতে সাহায্য করে, তেমনি সংগঠন হিসেবে অমাখোঁ তরুণ নাবিকদের নিয়ে আলোর তীরে এসে বাংলাদেশকে বদলে দিবে। এই স্বপ্ন নিয়ে ধীরে ধীরে একটি গ্রুপ থেকে বর্তমানে অমাখোঁ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সরকারের একার পক্ষে সকল ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করা কষ্টকর। আর এই বিষয়টাকে মাথায় রেখেই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের এবং মানুষের অধিকার আদায় ও তরুণদের অংশগ্রহণে সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং অসহায় মানুষদের জন্য অমাখোঁ ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে।

অমাখোঁ’ কক্সবাজার জেলা ব্যাপী একটি মানবিক আন্দোলন যা মানুষের জীবন এবং স্বাস্থ্য রক্ষা, সব মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিশ্চিত করা, এবং মানুষের দুর্ভোগ প্রতিরোধ ও লাঘব করার জন্য প্রতিষ্ঠিত।

‘অমাখোঁ’ আন্দোলনটি বেশ কিছু সদস্য দ্বারা পরিচালিত। যারা একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আন্তরিকভাবে মানবিক কার্য সম্পাদন করে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ,সশস্ত্র সংঘাতের ভুক্তভোগীদের জীবন ও মর্যাদা রক্ষা করা এবং এরা নিজ নিজ জাতীয় স্বাস্থ্য
ব্যবস্থা ও জরুরী চিকিৎসা সেবার সাথে সংযুক্ত।।

বর্তমানে সংগঠনটির ২১ জন কর্মী, ৯ জন উপদেষ্টা ও ৩০ জন অস্থায়ী কর্মী রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন স্কুলে ইউনিট তৈরি, পঞ্চাশের অধিক সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। ১০০ জনের বেশি স্বেচ্ছাসেবী সরাসরি যুক্ত রয়েছে অমাখোঁর সঙ্গে। যারা কক্সবাজার সদরের বিভিন্ন ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। অমাখোঁ এরমধ্যে তরুণ স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে সফলভাবে ১৪টির বেশি ইভেন্ট করেছে।

অমাখোঁর প্রধান লক্ষ্য সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অধিকার নিশ্চিতকরণ। এ লক্ষ্যে শিশুর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপদ বাসস্থান, স্যানিটেশন, বিনোদন, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবিচার রোধসহ নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অমাখোঁ ফাউন্ডেশন শিশু অধিকার কার্যক্রম পরিচালনা করছে ঝরে পড়া শিশুদের পড়াশোনা চলমান রাখার জন্য। এরমধ্যে অমাখোঁ ফাউন্ডেশনের শিশু অধিকার রক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে এক শতাধিক সুবিধাবঞ্চিত মানুষ উপকৃত হচ্ছে। যার মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত এ শিশুরা অন্য সবার মতোই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে এবং বড় হয়ে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে শিশুকে দক্ষ এবং যোগ্যভাবে গড়ে তোলা, যতক্ষণ না পর্যন্ত সে স্বনির্ভর হচ্ছে। এর মানে আর্থিকভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তায় সহযোগিতা করা। বর্তমানে তাদের শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় ৫০ জন শিশু বিনা বেতনে পড়াশোনা করার সুযোগ পাচ্ছে। তাদের স্পন্সরশিপ কার্যক্রমে একজন সামর্থ্যবান ব্যক্তি একটি শিশুর পড়াশোনার দায়িত্ব বহন করে থাকেন। এই স্পন্সরশিপ কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৈশোর উন্নয়ন, বিনোদনসহ শিশুদের অধিকার সুরক্ষায় ও তাদের নিরাপদ জীবন গড়তে কাজ করে যাচ্ছে অমাখোঁ ফাউন্ডেশন।

অমাখোঁর ভবিষ্যৎ রূপকল্প হলো আগামী পাঁচ বছরে কমপক্ষে পাঁচ সহস্রাধিক ঝরে পড়া শিশুকে বিদ্যালয়ে পাঠানো এবং প্রাথমিক শিক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সহযোগিতা করা। শুধু তাই নয়, বাসস্থানহীন মাধ্যমিক স্তরেও সহায়তা প্রদান করবে অমাখোঁ। অমাখোঁ সুবিধাবঞ্চিত এসব মানুষ ও সমাজের অবহেলিত পথশিশুদের নিয়ে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেখানে সকল শিশুর সমান অধিকার থাকবে, যেখানে শিশু পাবে তার শৈশব ও শিক্ষা। যেখানে পথশিশুদের জন্য থাকবে স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা।

দরিদ্র ও পথ শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এই সংগঠনটি। শিক্ষা উপকরণের পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের দেওয়া হয় নানা প্রশিক্ষণও। এছাড়া বাল্যবিয়ে রোধ, শিশু নির্যাতন বন্ধে চলছে আপ্রাণ চেষ্টা। কয়েকজন তরুণের স্বপ্নঘেরা সংগঠনটি এখন অনেকের পাথেয়। এদিকে সকল বাধা উপেক্ষা করে সমাজ উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে অমাখোঁ।

তবে বর্তমানে আর্থিক সঙ্কটের কারণে সংগঠনটির কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা পেলে অনেক দুর এগিয়ে যাবে এমনটি আশা ব্যক্ত করেছেন সংগঠনটি। সংগঠনটি জানায়, শিশু বয়সে যখন তাদের বই নিয়ে পা রাখার কথা স্কুলের আঙিনায়, সে বয়সে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিচ্ছে তারা। সমাজে এমন মানুষও আছেন, যারা স্বপ্ন দেখেন- হতদরিদ্র সুবিধাবঞ্চিত, শ্রমজীবী এই পথশিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়ানোর। এমন লক্ষ্য নিয়েই ইতিমধ্যেই অনেক শিক্ষার্থীর উপকরণের মাধ্যমে সংগঠনটির যাত্রা শুরু করেছেন ২০১৭ সালে।

অমাখোঁর উদ্দেশ্য সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অক্ষরজ্ঞান প্রদান ও ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখি করে।