তাজুল ইসলাম পলাশ, চট্টগ্রাম:
চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছেই না। বছর বছর মৃত্যুর ঘটনা শুধু বেড়েই চলেছে। বেড়ে চলেছে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসও। সর্বশেষ রবিবার ভোরে চট্টগ্রাম মহানগরীর আকবর শাহ থানার পূর্ব ফিরোজ শাহ কলোনি এলাকার রেলওয়ে পাহাড় ও পাচঁলাইশ থানার হিলভিউ আবাসিক এলাকায় দেয়াল ধসে মারা যায় ৪ জন।

গত বছর এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়েও চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া ও চন্দনাইশ উপজেলায় পাহাড় ধসে মারা গেছে ১৭ জন। গত ১০ বছরে এভাবে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে দুই শতাধিক মানুষ মারা গেছে। প্রতিবছর এই মৃত্যুর মিছিলের সংখ্যা বাড়লেও তাদের বাঁচানোর যেন কেউ নেই।

অভিযোগ উঠেছে, প্রশাসনের উদাসিনতায় চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার বিভিন্ন উপজেলার পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস দিন দিন বেড়েই চলেছে। গত ১০ বছরে এ সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৭ সালে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যুর ঘটনায় বিভাগীয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে প্রশাসন। কিন্তু এ কমিটি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস রোধে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বর্ষা মৌসুম আসলে দুয়েকটি সভা আয়োজনের মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রয়েছে।

অন্যদিকে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস রোধে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তেমন কোনও পদক্ষেপ নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিবছর বৃষ্টির আগে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ অভিযান চালায় প্রশাসন। কিন্তু লোক দেখানো এসব অভিযানের পরপরই পাহাড়ে আবার ফিরে যায় বসবাসকারীরা। আর বর্ষা মৌসুমে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস রোধে প্রশাসনের তোড়জোড় থাকলেও বর্ষার পরপরই বিষয়টি চোখের আড়ালে চলে যায়।

পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক শরীফ চৌহান বলেন, পাহাড় কাটা ও দখলের সঙ্গে জড়িতরা চিহ্নিত হলেও কখনোই প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। দখলকারীরা তাদের অবস্থানেই বহাল আছে।

উল্টো প্রতিবছর নতুন পাহাড় কেটে আরও বসতি স্থাপন করছে। এভাবে চলতে থাকলে এক দশক পরে চট্টগ্রাম শহর ও আশেপাশের এলাকায় একটি পাহাড়ও আর অবশিষ্ট থাকবে না। তখন আর পাহাড় রক্ষার দাবিও জানাতে হবে না।

পরিবেশবাদী আন্দোলনকর্মী অধ্যাপক ইদ্রিস আলী বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বসতি চিহ্নিত করা ও তাদের স্থায়ীভাবে উচ্ছেদের সুপারিশগুলোই এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। দখল হওয়া পাহাড়গুলোর অধিকাংশের মালিক সরকারি সংস্থা। অথচ তাদেরই কোনও নড়চড় নেই।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ২০০৭ সালে স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড় ধসে মারা যান ১২৭ জন। ২০০৮ সালে পাহাড় ধসে মারা যান ১১ জন। ২০০৯ ও ২০১০ সালে মারা যান ১৫ জন। ২০১১ সালে ১৭ জন মারা যান। ২০১২ সালে মারা যান ২৩ জন। ২০১৩ সালে মারা যান ৫ জন। ২০১৫ সালের ১৯ জুলাই মারা যায় ৫ শিশুসহ ৬ জন। ২০১৭ সালে মারা যায় ১৭ জন। সর্বশেষ রবিবার ভোরে পাহাড় ও দেয়াল ধসে মারা যান আরও ৪ জন।

অভিযোগ রয়েছে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধভাবে ঘরবাড়ি ও বস্তি তৈরি করে এসব কম টাকায় ভাড়া দেয় প্রভাবশালীরা। সেই অবৈধ ঘরগুলোতে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ থাকায় নগরীর স্বল্প আয়ের মানুষেরা ওইসব ঘরে ভাড়া থাকছেন। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ এ বসবাস রোধ করতে না পারার কারণে দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল।

২০০৭ সালে স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনার পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ২৮টি কারণ নির্ধারণ করে ৩৬টি সুপারিশ প্রণয়ণ করে। সেই সুপারিশগুলো আজ পর্যন্ত স¤পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি।

সাম্প্রতিক সময়ে জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় জানানো হয়, নগরীতে ৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় রয়েছে। এর আগে ২০১৩ সালে ওই কমিটি জানিয়েছিল নগরীর ১১টি পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ৬৬৬টি পরিবার বসবাস করছে। এরপর চার বছরেও এই তালিকা হালনাগাদ করা হয়নি। প্রশাসনের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারের তালিকায় এখনও ৬৬৬টি পরিবারই রয়েছে। অথচ বাস্তবে এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পরিবার পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরীর মতিঝর্ণা, বাটালি হিল, খুলশী, লালখান বাজার, পাহাড়তলী, টাইগার পাস, আমবাগান, বাটালি হিল রেলওয়ে কলোনি, পাহাড়তলী রেল কলোনি, বায়েজিদ বোস্তামি, হাটহাজারী উপজেলার ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী সিটি কর্পোরেশন ওয়ার্ডের শাহ আমানত কলোনি, কাছিয়াঘোনা, লেবু বাগান, সীতাকুন্ডের সলিমপুর, লতিফপুর ও রাঙ্গুনিয়ার বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে লক্ষাধিক মানুষ। শুধু মতিঝর্ণা ও এ কে খান পাহাড়েই বসবাস করছে ৫ হাজারের অধিক পরিবার।

মতিঝর্ণার পাহাড়ি বস্তিতে বসবাসকারী রিকশাচালক কবির হোসেন, দিনমজুর নুর আলমসহ পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারী একাধিক বাসিন্দা জানান, তারা ভূমিহীন। যাওয়ার মতো স্থায়ী কোনও ঠিকানা তাদের নেই। আর নগরীর সাধারণ বাসা ভাড়ার তুলনায় এখানে বাসা ভাড়া অনেক কম। তাই বাধ্য হয়ে জেনেশুনেই তারা পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন।

তারা অভিযোগ করে বলেন, প্রশাসন বিভিন্ন সময় তাদের পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতি কখনও বাস্তবায়ন করা হয়নি।

এই ব্যাপারে জানতে চাইলে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সচিব ও চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক তাহমিলুর রহমান বলেন, পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করা পাহাড়গুলোর মালিক ভূমি মন্ত্রণালয়। ওইসব পাহাড়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের। আর এসব এলাকায় ঘরবাড়ি ও বস্তি নির্মাণের ব্যাপারে আপত্তি ও অনাপত্তি বিষয়টি দেখার দায়িত্ব গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু এই তিনটি মন্ত্রণালয় কখনও পাহাড়গুলোর খোঁজ খবর রাখেনি। তাদের উদাসিনতার সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু মহল পাহাড়গুলো দখল করে সেখানে ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে খেটে খাওয়া মানুষের কাছে ভাড়া দিচ্ছে।

পরিবেশ আন্দোলন কর্মীরাও বলছেন-প্রশাসনের উদাসীনতা, রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের লেজুড়বৃত্তি, তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না করাসহ সমন্বিত উদ্যোগ না থাকায় পাহাড় ধসে প্রাণহানির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগর অঞ্চলের পরিচালক মো. আজাদুর রহমান মল্লিক বলেন, পাহাড় কাটা ও পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসের বিষয়টি পুরোপুরিই জেলা প্রশাসনের এখতিয়ারে পড়ে। এখানে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজ সামান্যই।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ইলিয়াছ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, পাহাড় কাটা ও দখলের বিরুদ্ধে প্রভাবশালী দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বসতিদের স্থায়ী পুনর্বাসনের বিষয়টিও সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় রয়েছে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় স্থায়ী পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শিগগিরই শুরু করা হবে বলে জানান তিনি।