মহসীন শেখ

সম্প্রতি কক্সবাজার জেলায় কিছু সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে(প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কোচিং সেন্টার) শিক্ষকদের হাতে কোমলমতী শিক্ষার্থী প্রহারের ঘটনা বেড়েই চলছে। এ ঘটনার ধারাবাহিকতায় ০৮ অক্টোবর কক্সবাজার শহরের শহরে কোচিং সেন্টারে এক শিক্ষার্থীকে বেধড়ক পিটানোর ঘটনায় হেলাল উদ্দিন নামের এক শিক্ষক আটকের মতো ঘটনাও ঘটেছে। আনাড়ি ওসব শিক্ষকরা এতই বেপরোয়া যে, চলতি বছরের ০৬ জানুয়ারী কক্সবাজার সদর উপজেলার খরুলিয়া এলাকায় আয়াত উল্লাহ নামে এক অভিভাবককে হাত-পা বেঁধে মধ্যযুগীয় কায়দায় স্থানীয় খরুলিয়া কেজি অ্যান্ড প্রি-ক্যাডেট স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে শিক্ষকসহ একদল লোক বর্বর নির্যাতন চালিয়েছিলো।

ওসব ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবী জানিয়ে আসছেন সচেতন অভিভাবক মহল।

আলাপ করলে একাধিক অভিভাবকরা তাদের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের কাছে তারা অনেকটা জিম্মি। কোননা কোন ভাবে তাদের সন্তানরা না বৈশম্য এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। একইভাবে ক্লাসের শিক্ষকদের কাছে কোচিং না করলেও রোষানলে পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের। যদি ওসব বিষয়ে প্রতিবাদ করা হয় তাহলে সেই শিক্ষার্থীকে অবশ্যই পরিক্ষার রেজাল্ট ভালো না হওয়ার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। শুধু তাই নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রীকে নিয়ে শিক্ষকের পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও কম নয়। যার কারণে ওসব অন্যায় অনিয়মের বিষয় মিডিয়াতেও আসেনা। এসব অন্যায় অনিয়মের কারণে বকে যাচ্ছে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী বলতে গেলে অধিকাংশ শিক্ষকই নির্দিষ্ট আইন-কানুন মেনে চলেনা। সেই মান্দাত আমলের কায়দায় শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিচালিত করতে চায় শিক্ষকরা। এভাবে চলতে থাকলে বর্তমান সরকারের ভিশন ও মিশন বাস্তবায়নে ঘরে ঘরে শিক্ষার পৌছানো কঠিন হবে বলে মনে করছেন সচেতন অভিভাবক মহল।

সম্প্রতি কক্সবাজার শহরে কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীকে প্রহারের ঘটনায় শিক্ষক আটকের বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা আসলেও নিশ্চয় সকলেই অবগত যে এটি কোন মারামারি অথবা জমিজমা নিয়ে প্রতিপক্ষের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা নয়। ঘটনাটি শুধু মাত্র একজন কোমলমতি শিক্ষার্থীকে প্রহারের ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে সঠিক আইনটি প্রয়োগ করা হয়েছে মাত্র।

এক কথায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী প্রহার-লাঞ্ছনা-অপমান আজও বন্ধ হয় নি। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের দ্বারা এমনি বর্বরতা এখনও অব্যাহত আছে। সর্বোচ্চ আদালত শিক্ষার্থী প্রহার নিষিদ্ধ করলেও তা কার্যকর হয় নি। বরং নতুনরূপে নতুন মাত্রায় এই বর্বরতা অব্যাহত আছে। সম্প্রতি শিক্ষকের অপমান সহ্য করতে না পেরে অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে চাঁদপুরে। পরীক্ষার ফি বিশ টাকা কম দেয়ায় শিক্ষক তাকে কান ধরে উঠবস করায় এবং পরীক্ষা দিতে চাইলে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। এই অপমান সহ্য করতে না পেরে ওই ছাত্রী আত্মহত্যা করে। ঘটনাটি স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থী, অভিভাবক তথা শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যই বেশ উদ্বেগজনক।

এখানে শিক্ষকের অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে শিক্ষার্থী। এছাড়াও শিক্ষকের প্রহারে শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে প্রায় সময়ই। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঘটছে শিক্ষার্থী প্রহারের ঘটনা। শুধু প্রহার নয়; সেইসঙ্গে ছাত্র ছাত্রীদের নানাভাবে অপমানও করা হয়। আর এই প্রহার বা অপমানের জন্য বড় কোনো অজুহাত লাগে না। কাসে পড়া না পারলে বা হোমওয়ার্ক না করলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অমানবিক প্রহার করা হয়। কখনও হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তা-ই ছুড়ে মারা হয় শিশু কিশোরদের ওপর। কখনও রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় বা সহপাঠীদের সামনে কানে ধরে উঠবস করানো হয়। এতে শিক্ষার্থীদের অপমানবোধ হয়, আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। ফলে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় অনেকে।

কারণ যেটাই হোক, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের প্রহার করা কিংবা কোনোভাবে অপমান করা কোনো অবস্থাতেই মেনে নেয়া যায় না। প্রহার করে, নির্যাতন করে বা অপমানজনক আচরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আর যাই হোক, লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগী করে তোলা যাবে না। বরং এতে শিশু কিশোরদের মনে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়ে; যা পরবর্তী জীবনেও তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। আর সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, প্রহার নির্যাতনসহ নানা ধরনের শাস্তি প্রদানের ফলে শিক্ষার্থীদের কাসে মনোযোগ বিঘিœত হয়। এতে সৃষ্টি হয় বিদ্যালয় ভীতি। আর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্র ছাত্রীদের ঝরে পড়ার এটাও একটা কারণ।

বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন বা যেকোনোভাবেই শাস্তি প্রদানের এই ধারাবাহিকতা বন্ধ করতে হবে। আমাদের সমাজে একটা ধারণা প্রচলিত ছিলো এক সময় যে, শিশুদের প্রহার না করলে তারা লেখাপড়া শেখে না। সেই ধারণায় বদ্ধমূল হয়ে পিতামাতা তাদের সন্তানদের ‘পেটানোর’ জন্য বলেও দিতেন শিক্ষক বা ওস্তাদদের। সেটা ছিলো বর্বরতা। কিন্তু সময় এখন পাল্টেছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। প্রহার করে কিংবা শাস্তি দিয়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় মনোযোগী করা যাবে না; এটাই বাস্তবতা। শুধু লেখাপড়ার জন্য নয়, অন্য যেকোনো কারণেই শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করা অপমান করা বন্ধ করতে হবে। যেসব শিক্ষক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই ন্যাক্কারজনক কাজে লিপ্ত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এই সংক্রান্ত আদালতের নির্দেশনা কার্যকর করা জরুরি।

পাশাপাশি আপনার মহান পেশাকে কলংক মুক্ত রাখতে সম্মানিত মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকলো।

লেখকঃ

নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক সকালের কক্সবাজার।

মোবাইল: ০১৬১৯০৭০৫১৩