ইমাম খাইর, সিবিএন:
বই লিখে নতুন করে আলোচনায় আসা সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার জন্য আফসোস ও তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার বিচার করে আলোচনায় আসা চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান।
নিজ ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি সাবেক প্রধান বিচারপতিকে তাঁর দায়িত্ব পালনকালে অধীনস্থদের প্রতি একচোখা নীতি অবলম্বনের অভিযোগ এনেছেন। বিচার বিভাগকে আর রাজনৈতিক বিতর্কে না জড়ানোর জন্যও অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
বিচারক মাহাবুবুর রহমান নির্বাচনের আগে সাবেক প্রধান বিচারপতির বই লেখার উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলে বলেন, ‘আপনার উদ্দেশ্য আসলে কী? নির্বাচনের আগে এই বই লেখার উদ্দেশ্য কী? এটা একটা খেলা। খেলোয়াগণ সুনির্দিষ্ট। রেফারিও আছে। বিচার বিভাগকে কেন জড়াচ্ছেন? আপনি সাবেক মাননীয় প্রধান বিচারপতি হলেও আপনার বক্তব্যের ঢেউ রাজনৈতিক স্রোতধারায় গিয়ে পড়বে। দয়া করে বিচার বিভাগকে আর রাজনৈতিক বিতর্কে জড়াবেন না।’
সাবেক প্রধান বিচারপতির উদ্দেশ্য করে বিচারক মাহাবুবুর রহমান আরো বলেন, ‘যিনি আজ আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের কথা বলছেন, তাঁর কাছেই আমার মানবাধিকার ভুলুণ্ঠিত হয়। বদদোয়া দেয়া আল্লাহর রসুলের (স:) সুন্নতের খেলাফ। না হয় আপনাকে অভিশাপই দিতাম।আমি না দিলেও কারো না কারো না অভিশাপ তো লেগেছে। না হয় স্বপ্ন ভাঙ্গবে কেন? সবাই জানে-মঙ্গলের উদ্দেশ্যে যে স্বপ্ন দেখা হয় সে স্বপ্ন কখনো ভাঙ্গে না। আপনার স্বপ্নের উদ্দেশ্য কী ছিল তা কেবল আপনি জানেন আর যাঁদের নিয়ে সংসার করেছেন হয়তো তাঁরাই জানেন।’
সাবেক প্রধান বিচারপতির লেখা বই ও নিজের কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এক পর্যায়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েই বিচারক মাহাবুবুর রহমান লিখেছেন, ‘আপনার বইটি এখনো পড়িনি। আশা করি-আপনার ত্রুটিগুলোও আপনি সেখানে উল্লেখ করেছেন। এ ধরণের বইতে পশ্চিমারা কোন কিছুই গোপন করেন না। অনেকেই বলেন এবং বিশ্বাসও করেন- আপনার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা আছে। আমি সেটা বিশ্বাস না করলেও যাঁরা বিশ্বাস করে তাঁদের অকাট্য প্রমাণের কাছে হার মেনেছি। সদাশয় সরকার তো অনেক বড় ব্যাপার। আমার মত নগণ্য একজন অফিসারের হৃদয়ের সংশয় আপনি দূর করুন কিংবা আমার অনুযোগগুলির সঠিক প্রতি উত্তর দিন। যদি চ্যালেঞ্জ মনে করেন তো চ্যালেঞ্জই। গ্রহণ করলে খুশি হব।’
সনামধন্য বিচারক মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান সাবেক এই প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে আরো বলেছেন, সম্মানিত মানুষদেরকে অপমান করলে তাঁরা সেটা প্রকাশ করাটা অপমানজনক মনে করেন। এই বোধটুকু আপনার নেই। লজ্জা লাগছে আপনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির প্রধান বিচারপতি ছিলেন। আফসোস্ মাননীয় সিনহা স্যার!’
তিনি লিখেছেন, ‘সবচেয়ে বিপদজনক বিষয় হলো সাধারণ জনগণ যখন জানবে প্রধান বিচারপতিকে (সত্য হোক কিংবা মিথ্যা হোক) হুমকি দেয়া যায়। তখন তাঁদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়বে। মানুষ বিচার বিভাগকে দুর্বল ভাববে। হুমকি-ধমকি দিতে থাকবে যে কেউ। বিচারপ্রার্থী মানুষ আত্মবিশ্বাস ও আস্থাহীনতায় ভুগবে।’
মাননীয় সিনহা স্যার, আপনি বোধ হয় সত্যিকার দেশপ্রেমিকের মত কাজ করেননি। কি দেয়নি আপনাকে এই জাতি! সম্মান, পদমর্যাদা সব পেয়েছেন। সদাশয় সরকারের সাথে এতটুকু বনিবনা হলো না। এতে পুরো জাতির পিছনে লাগতে হবে? নানা প্রেক্ষাপটে বনিবনা নাও হতে পারে। গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে এটা নতুন বিষয় নয়। কিন্তু আপনি যেভাবে অধৈর্য প্রদর্শন করেছেন, তাতে নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, বিচার বিভাগকে কমপক্ষে শত বছরের নীরবতার জগতে নিক্ষেপ করে পিছিয়ে দিয়ে গেছেন। যে গতিতে এগুচ্ছিল তাতে বিশাল ছন্দপতন হয়ে গেছে। সংশয়, সন্দেহ, অবিশ্বাস ও ষড়যন্ত্রের ঘূর্ণিপাকে ফেলে দিয়েছেন পুরো জাতিকে।’
কর্মক্ষেত্রে সাবেক প্রধান বিচারপতির সময়কালে অধীনস্থ হিসেবে নিজের দুঃসময়ের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে মাহাবুবুর রহমান এও বলেন, ‘আমার সরকার সাইডের কর্তৃপক্ষ আমার প্রতি সব সময় সদয়, সহানুভূতিশীল ও ন্যায়পর আচরণ করেছেন। কিন্তু উনার কারণে (সাবেক প্রধান বিচারপতি) আমি কষ্ট পেয়েছি। বিচারবিভাগের অভিভাবক হিসেবে উনার কাছে আশ্রয় চেয়ে পাইনি। কিছু অফিসারই কেবল উনার নেক নজরে ছিল। ওদের জন্য অন্যরা সাফার করেছে।’
মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘আমার বাবা ছিল মৃত্যু পথযাত্রী, মরণব্যাধি ক্যান্সার আক্রান্ত শ্বশুর, আমার চারজন শিশু সন্তান, আমি নিজে অসুস্থ। এই অবস্থায় একটি মিথ্যা অভিযোগের বিরুদ্ধে উনার হস্তক্ষেপ কামনা করে আবেদন করেছি। উনার পক্ষ থেকে লিখিতভাবে জানানো হলো-কিছু করার নাই। আল্লাহর রহমতে সত্য ভেসে উঠেছে। সদাশয় মন্ত্রণালয় ও মহামান্য সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার ও রেজিস্ট্রার-জেনারেল অফিসে পরবর্তীতে নিয়োগ পাওয়া অফিসারদের আন্তরিক সহায়তা ও পবিত্র ভালোবাসার কারণে এখন স্বস্তিকর অবস্থায় আছি।’
মাহাবুবুর বলেন, ‘আপনার সময়ে যাঁরা মহামান্য সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার ও রেজিস্ট্রার-জেনারেল অফিসে ছিলেন, উনারা ‘দেখব’ বলে উল্টা করে দিতেন (দুই- একজন ব্যতিক্রম ছিলেন)। কোন অফিসারের দুঃখ-কষ্ট-অশ্রুবিন্দু আপনার আপনার কাছে পৌঁছতো কিনা জানি না। আর পৌঁছলেও তা আপনার হৃদয়ে কোন অনুভূতি সৃষ্টি করতো কিনা জানি না। অবশ্য আপনার পছন্দের অফিসারদের কথা ভিন্ন।’
প্রতিক্রিয়ার শেষ অংশে বিচারক মাহাবুবুর রহমান লেখেন, ‘আমার লজ্জা লাগছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি হিসেবে এখনো কিছু শ্রদ্ধা আপনার প্রতি অটুট আছে। অনুগ্রহ করে সেইটুকু অবশিষ্ট রাখতে দিন।’ তবে তিনি এও লিখেছেন-এটা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পোস্ট নয়।
বিচারক মাহাবুবুর রহমানের পিতা যখন মৃত্যু শয্যায়, তখন উর্ধতন এক কর্তার মিথ্যে অভিযোগের বিষয়ে বিচার চাইতে গেলে সাবেক প্রধান বিচারপতি তাঁর প্রতি সুবিচার করেননি উল্লেখ করে খোদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেন। এসব কথা অবলিলায় লিখে নিজেজ সততা, সাহসিকতা ও ঈমানদারিত্বের প্রমাণ দেন।
মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান বর্তমানে অতিরিক্ত জেলা জজ পদ মর্যাদায় চট্টগ্রাম কাস্টমস-এর আইন কর্মকর্তা। চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের কাছে আস্থা তৈরি করে অত্যন্ত সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দ্রুত ও রেকর্ড সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি করেও প্রশংসিত হন। চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় বিকেল হতে রাত গড়িয়ে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত স্মরণকালের সবচে দীর্ঘ জবানবন্দিও নেন তিনি ।
এনএসআই পরিচালক সাহাবুদ্দিন আহমেদের কাছ থেকে নেয়া এই জবানবন্দিটি ছিল চাঞ্চল্যকর দশট্রাক অস্ত্র চোরা চালান মামলার টার্নিং পয়েন্ট। এছাড়া ঘন্টা হিসেবে রিমান্ডে নেয়া, প্রচলিত আইনেই ইভটিজিংয়ের সাজা প্রদানের নজির সৃষ্টি করেও আলোচিত হন বিচারক মাহাবুবুর রহমান।
এক বছরে ১৩৪২ মামলা নিষ্পত্তি করে কক্সবাজার আদালতে দৃষ্টান্ত দেখালেন মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান
কক্সবাজার আদালতঙ্গনের ইতিহাসে অনেক পুরনো ও জটিল মামলা নিষ্পত্তি করে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন যুগ্ম-জেলা জজ-১ম আদালতের বিচারক (তৎকালীন) মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান। ৩০ বছরেরও বেশী সময় ধরে চলে আসা অনেক মামলা তার হাত দিয়েই শেষ হয়েছে বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারী কক্সবাজার আদালতে যুগ্ম-জেলা জজ পদে যোগদান করেন। ২০১৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী কক্সবাজার থেকে অন্যত্র বদলি হন তিনি। দায়িত্ব পালনকালে যুগ্ম-জেলা জজ মাহাবুব ৫৩৪ দেওয়ানী ও ৮০৮ টি ফৌজদারী মামলাসহ মোট ১ হাজার ৩৪২টি মামলা নিষ্পত্তি করেন। এতেকরে আদালতে বিচারক শুন্যতা থাকলেও বিচার কাজে তিনি অনেকটা গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন বলে জানান আইনজীবীরা।
আদালত সুত্রে জানা গেছে, মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান যেগদানের বিচারক হিসাবে যোগদানের পর প্রথমে পুরনো ও জটিল মামলাগুলো নিষ্পত্তিতে হাত দেন। ১৯৮৮ সাল থেকে পরিচালিত হয়ে আসা অনেক দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলা তিনি নিষ্পত্তি করেন। মামলা স্টাডি করে দ্রুত নিষ্পত্তি করতে তিনি সার্বক্ষণিক তৎপর ছিলেন। দায়িত্ব পালনে তার গাফিলতি কোন দিন ছিলনা। আইন ও নীতির বাইরে তিনি এক চুলও যাননি। এ কারণে কোন বিচার ফাইল আটকে থাকেনি। জেলায় জজশীপ শুরুর পর থেকে মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন বলে আদালতের বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত লোকজনের মুখে ওঠে আসে।
কক্সবাজারের আগে তিনি নোয়াখালী, পার্বত্যজেলা খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটনে দায়িত্ব পালন। বিশেষ করে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটনে থাকালে বিশ্বের আলোচিত দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার অধিকাংশ সাক্ষির জবানবন্দি গ্রহণ করেন বিচারক মাহাবুবুর রহমান নিজেই। এ মামলার অন্যতম আসামী উইং কমান্ডার সাহাব উদ্দিনের একটানা ১৪ ঘন্টা জবানবন্দি গ্রহণ করে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অন্তত ২৫ হাজার মামলা নিষ্পত্তি করেছেন।
মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমানের গ্রামের বাড়ী চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার পুকুরিয়ায়। তিনি ছাত্র জীবনে চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থান লাভ করেন। এলএলবি (অনার্স) ও এলএলএম ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১ম শ্রেণিতে ১ম স্থান অধিকার করেন। শিক্ষাজীবন শেষে ২০০৬ সালের ১৫ জানুয়ারী গাইবান্দা আদালতের সহকারী জজ হিসাবে যোগদানের মাধ্যমে বিচারকের ভূবনে প্রবেশ করেন মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান।
এসকে সিনহাকে চ্যালেঞ্জ বিচারকের
পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে
