ইমাম খাইর, সিবিএন:
‘আমি আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে বিচারকার্য পরিচালনা করেছি। আইনতঃ বিচারপ্রার্থীর যতটুকু পাওনা ততটুকু দিয়েছি। জ্ঞাতসারে অবিচার করিনি।’
নিজের ‘বদলী জনিত বিদায় সংবর্ধনা’ অনুষ্ঠানে আবেগতাড়িত ভাষায় কথাগুলো বলেছেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মীর শফিকুল আলম।
মঙ্গলবার (১১ সেপ্টেম্বর) রাতে জেলা জজের সম্মেলন কক্ষে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা কর্মচারীরা এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
সভার মধ্যমনি মীর শফিকুল আলম বলেন, ‘আমি সব কিছু উদারতা দিয়ে দেখি। সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান দিয়েছি। বার ও বেঞ্চের মধ্যে সমন্বয় করেছি। কর্মের খাতিরে কখনো শাসন, আবার কখনো আদর স্নেহ দিয়েছি। সবাইকে ছোট ভেবে স্নেহ দিয়ে কাজ আদায় করেছি। সবসময় কঠিন মনোভাবে থাকিনি।’
তিনি বলেন, ‘অনেক আদালতে বার ও বেঞ্চের সমন্বয় না থাকায় বিচারকার্যে ব্যাঘাত ঘটে। আদালতের শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়। ২ বছর আগেও কক্সবাজার আদালতে কঠিন সমস্যা ছিল। ২০১৬ সালের ১৬ জুলাই আমি দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকে কোন সমস্যা হয়নি। সমস্যাকে সমাধানের চোখে দেখেছি। আইনজীবীদের সাথে সমন্বয় করেছি। পদোন্নতিযোগ্য কর্মচারীদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করেছি।’
বিদায়ী জেলা জজ মীর শফিকুল আলম বলেন, ‘যে যার অবস্থান থেকে আরেকজনের সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় রেখে কাজ করতে হবে। একটু উদার মনে চললে কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা থাকা বাঞ্চনীয়।’
তার বক্তব্যকালে পুরো অনুষ্ঠানস্থলে নেমে আসে আবেগঘন নিরবতা। মীর শফিকুল আলম নিজেও কিছুক্ষণের জন্য আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। এ সময় সবার চোখে মুখে লক্ষ করা গেছে হারানোর ছাপ।
কক্সবাজার আদালতের দুর্যোগমুহুর্তে ত্রাণকর্তা হিসেবে যোগদান করেন মীর শফিকুল আলম। অল্প সময়েই বিচারাঙ্গনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। প্রকৃত বিচারকে সবগুণে সমৃদ্ধ ছিলেন তিনি। অকুতোভয়, সততা ও নিষ্টার সঙ্গে নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন। বিদায়ের দিনে যার প্রমাণ মেলেছে।

আল্লাহর আরশের ছায়াতলে সাত শ্রেণীর লোক আশ্রয় পাবে। সেখানে ন্যায় পরায়ন বিচারকও রয়েছে। হাদিস وَعَن أَبي هُرَيرَةَ رضي الله عنه، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ:« سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ في ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إلاَّ ظِلُّهُ: إمَامٌ عَادِلٌ، وَشَابٌّ نَشَأ في عِبَادَةِ الله تَعَالَى، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ بِالمَسَاجِدِ، وَرَجُلاَنِ تَحَابّا في اللهِ اجْتَمَعَا عَلَيهِ وتَفَرَّقَا عَلَيهِ، وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأةٌ ذَاتُ مَنصَبٍ وَجَمَالٍ، فَقَالَ: إنِّي أخَافُ الله، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ، فَأخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ الله خَالِياً فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ
অর্থাৎ হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ৭ ব্যক্তিকে আল্লাহ (কিয়ামত দিবসে) তার (আরশের) ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া অন্য কোন ছায়া থাকবে না।
(১) ন্যায় পরায়ন বিচারক।
(২) ঐ যুবক যে আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে বড় হয়েছে।
(৩) ঐ ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে লেগে আছে (জামায়াতের প্রতি যে উম্মুখ থাকে)।
(৪) ঐ দু’ ব্যক্তি যারা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একে অন্যকে ভালবেসেছে এবং তাতে অবিচল রয়েছে, কিংবা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ( তাও আল্লাহর উদ্দেশ্যে)।
(৫) ঐ ব্যক্তি যাকে কোন অভিজাত শ্রেনীর সুন্দরী মহিলা (ব্যাভিচারের দিকে) আহবান করে আর (তদুত্তরে) সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি।
(৬) ঐ ব্যক্তি যে কিছু দান করল এবং তা এতটা গোপনভাবে করল যে, তার বাম হাত জানতে পারল না তার ডান হাত কি দান করেছে।
(৭) ঐ ব্যক্তি যে একাকী বসে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার চোখ দু’টো (আল্লাহর ভয়ে) অশ্রুপাত করে।
(বুখারী, ২য় খন্ড, যাকাত অধ্যায়, হাদীস নং- ৫০৪) ।
সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সদর) তামান্না ফারাহর সঞ্চালনায় বিদায় সংবর্ধনায় বক্তব্য রাখেন- জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এএইচএম মাহমুদুর রহমান, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক জেবুন্নাহার আয়শা, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিচারক মোঃ নুর ইসলাম, পুলিশ সুপার (সদ্য বদলী) ড. একেএম ইকবাল হোসেন, ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ ছৈয়দ মুহাম্মদ ফখরুল আবেদীন, ভারপ্রাপ্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব কুমার বিশ্বাস, যুগ্ম-জেলা ও দায়রা জজ (সদর) মাহমুদুল হাসান, সহকারী সিভিল সার্জন ডা. মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর, সিনিয়র সহকারী জজ আলাউল আকবর, বেগম খাইরুন্নেছা, মোহাম্মদ আবুল মনসুর সিদ্দিকী, সহকারী জজ মোছাম্মৎ নুসরাত জামান, জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার শ্রীমতি মৈত্রী ভট্টাচার্য্য, সাজ্জাতুন নেছা, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাং হেলাল উদ্দিন, রাজীব কুমার দেব, মোঃ তারেক আজিজ, সুশান্ত প্রসাদ চাকমা, মোহাম্মদ রেজাউল হক, জেলা বারের সাবেক সভাপতি এডভোকেট মো. ইছহাক (জিপি), জেলা বারের সাধারণ সম্পাদক ইকবালুর রশীদ আমিন (সোহেল), জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এস.এম আব্বাস উদ্দিন, নাজির মোহাং হেফাজুর রহমান, চতুর্থ শ্রেনী কর্মচারী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মুঃ শাহজাহান এবং বেঞ্চ সহকারী মোঃ নুরুল হুদা।
সকল বক্তার একটাই উচ্চারণ, ‘স্যার (মীর শফিকুল আলম) আদর্শের উজ্জল দৃষ্টান্ত, ন্যায় বিচারের প্রতীক ও উদার প্রকৃতির মানুষ। তার মন ছিল সাগরের মতো বিশাল, আকাশের মতো বিস্তীর্ণ। তাকে হারিয়ে আমরা একটা বটবৃক্ষ হারালাম।’
সবার কামনা, বিদায়ী জেলা জজ মীর শফিকুল আলম যেন দেশের সর্বোচ্চ বিচারকের পদ অলংকৃত করেন। নিজ কর্ম ও গুণে পুরো দেশের জন্য তিনি যাতে অনন্য দৃষ্টান্ত হন।
সভা শেষে বিদায়ী জেলা ও দায়রা জজ মীর শফিকুল আলমকে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন কক্সবাজার জেলা কারাগারের সুপার মোঃ বজলুর রশীদ আখন্দ। জেলা জজশীপে কর্মরতদের পক্ষ থেকেও সম্মাননা ক্রেস্ট ও উপহার সামগ্রী দেয়া হয়। এ সময় জজশীপসহ কক্সবাজার আদালতের বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরতরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে বিদায়ী কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মীর শফিকুল আলমের কর্মকালের উপর সচিত্র স্লাইডশো প্রদর্শন ও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়।
এদিকে, কক্সবাজারের বিদায়ী জেলা ও দায়রা জজ মীর শফিকুল আলম মঙ্গলবার (১১ সেপ্টেম্বর) কক্সবাজার জজশীপে শেষ কর্মদিবস পালন করেছেন। শেষে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ -১ সৈয়দ মুহাম্মদ ফখরুল আবেদীনকে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।
কক্সবাজারে নতুন নিয়োগ দেয়া জেলা ও দায়রা জজ খন্দকার হাসান মোঃ ফিরোজ কক্সবাজারে এখনো যোগদান না করায় এবং কক্সবাজারে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজের পদ গত ৬মাস ধরে শুন্য থাকায় কক্সবাজার জজশীপের তৃতীয় শীর্ষ দায়িত্বশীল বিচারক যুগ্ম জেলা জজ-১ কে বিদায়ী জেলা জজ দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন।
নতুন নিয়োগ পাওয়া জেলা জজ খন্দকার হাসান মোঃ ফিরোজ আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারে যোগদান করবেন বলে জানা গেছে। বিদায়ী জেলা জজ মীর শফিকুল আলমকে রাজশাহীর জেলা জজ হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
মীর শফিকুল আলম ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই কক্সবাজার জেলা জজ হিসাবে যোগদান করেন। তিনি অত্যন্ত সততা, নিষ্ঠা, দক্ষতার সাথে দায়িত্বপালন করেন।