স্পোর্টস ডেস্ক:
উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায়। বিশ্বকাপেও খুব একটা ভালো পারফম্যান্স দেখাতে পারেননি। তাতে কি! স্প্যানিশ লা লিগায় করেছিলেন ৩৪ গোল। ১২টি অ্যাসিস্ট। জিতেছিলেন ২টি শিরোপা (লা লিগা, কোপা ডেল রে)। তবুও, ফিফা বর্ষসেরার তালিকায় উঠলো না বার্সেলোনার আর্জেন্টাইন সুপারস্টার লিওনেল মেসির নাম।
১১ বছর পর এই তালিকায় নেই মেসির নাম। ফিফার পক্ষ থেকে সোমবার তিন জনের সংক্ষিপ্ত তালিকা ঘোষণা করার পর সবাই যারপরনাই অবাক। ক্রিশ্চিয়নো রোনালদো, লুকা মদ্রিচ কিংবা মোহামেদ সালাহরা না হয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল খেলেছেন। কেউ শিরোপা জিতেছেন, কেউ জিততে পারেননি। মদ্রিচ না হয় বিশ্বকাপের ফাইনালও খেলেছিলেন।
কিন্তু তাই বলে মেসি এই সংক্ষিপ্ত তালিকায় উঠে আসতে পারলেন না! এটা অবাক করেছে সবাইকে। ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে ফিফাকেও। কেন মেসির নাম আসলো না ফিফা বর্ষসেরার তালিকায় সেরা তিনে, এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন ইএসপিএনের বার্সেলোনা সংবাদদাতা স্যাম মার্সডেন।
২০০৬ সালে সর্বশেষ ফিফা বর্ষসেরার পুরস্কার উঠেছিল বিশ্বকাপজয়ী ইতালির অধিনায়ক, ডিফেন্ডার ফ্যাবিও ক্যানাভারোর হাতে। সেবার তিনি হারিয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের ফরাসি প্লে-মেকার জিনেদিন জিদান এবং বার্সেলোনার ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার রোনালদিনহোকে। লিওনেল মেসির আগমণবার্তা তখন মাত্র শোনা যাচ্ছিল ফুটবল দুনিয়ায়। ওই সময় মেসি ছিলেন ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো এক উদীয়মান ফুটবলার। সেবার সেরা ১০ জনের মধ্যেও ছিল না মেসির নাম।
ওইবারই সর্বশেষ, যেবার মেসির নাম সেরা তিনে ওঠেনি। এরপর গত ১১ বছর ফিফা বর্ষসেরা মানেই হলো মেসির উপস্থিতি অনিবার্য। সেরা তিন নয়, সেরা দুইয়ে ছিল তার নাম। ১১ বছর পর এসে এই প্রথম মেসিকে বাদ দিয়ে ফিফা বর্ষসেরার সংক্ষিপ্ত তালিকা ঘোষণা করলো। যেখানে নাম এসেছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, লুকা মডরিচ এবং মোহামেদ সালাহর।
ফ্যাবিও কানাভারোর পর প্রতি বছরই পোডিয়ামে উঠেছেন লিওনেল মেসি। যার মধ্যে ৫বার পুরস্কারটা উঠেছে তার হাতে। ৬বার জিততে পারেননি। এর মধ্যে একবার কাকা এবং অন্য পাঁচবার চির প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর কাছে হারেন তিনি। যে ৫ বার জিতেছেন, এর মধ্যে চারবারই ছিল একটানা।
মেসির এই ১১ বছরে ফিফা বর্ষসেরার ৮ বারের বিজয়ীই ছিলেন উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপাজয়ী। এসি মিলানের হয়ে কাকা ২০০৭ সালে, মেসি ২০০৯, ২০১১ এবং ২০১৫ সালে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ২০০৮ সালে ম্যানইউর হয়ে, ২০১৪, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে জিতেছেন রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে। এই ১১ বছরের মধ্যে মাত্র তিনবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ছাড়া ফিফা বর্ষসেরার পুরস্কার গেছে কোনো ফুটবলারের হাতে। ২০১০ ও ২০১২ সালে মেসি এবং ২০১৩ সালে রোনালদোর হাতে।
এই তিনবারই ফিফা ভোটিং সিস্টেমে জিতলেও তাদের দল কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ আট থেকেই ছিটকে পড়েছিল। এবারও চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ আট থেকেও ছিটকে যেতে হয়েছে মেসির বার্সেলোনাকে। তাহলে শুধু কি এই একটি কারণেই ফিফা বর্ষসেরার সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে বাদ পড়লেন তিনি? যে পুরস্কারটি দেয়া হবে চলতি মাসের শেষের দিকে লন্ডনে অনুষ্ঠিতব্য এক জমকালো অনুষ্ঠানে।
তবে শুধু চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বাজে পারফরম্যান্স কিংবা বার্সার শেষ আট থেকে বিদায় নেয়াই নয়, মেসির নামের পাশে ব্যর্থতা রয়েছে আরও অনেক বেশি। রাশিয়া বিশ্বকাপে তার যারপরনাই ব্যর্থতাই মূলতঃ এখানে মূখ্য ভুমিকা রেখেছে সেরার তালিকা থেকে বাদ দিতে।
ফিফা সেরার তালিকা ঘোষণার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জানিয়েছে, ‘সবগুলো ক্যাটাগরিতে সেরা বাছাই করা হয় সব ধরনের টুর্নামেন্ট বিবেচনা করেই। সেটা হতে পারে চ্যাম্পিয়নশিপ কিংবা জাতীয় দলের হয়ে কোনো সাফল্য। ২০১৭ সালের ৩ জুলাই থেকে ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই পর্যন্ত সময়ের মধ্যে অর্জনকে সামনে এনেই এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে।’
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং বিশ্বকাপসহ আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টগুলোর বিচারে এই সময়ের মধ্যে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের কেউ সুযোগ করে নিতে পারেনি এই তালিকায়। চলতি বছরের তিন ফাইনালিস্ট হলেন রিয়াল মাদ্রিদের লুকা মদ্রিচ, জুভেন্টাসের (নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিয়ালে) রোনালদো এবং লিভারপুলের মোহামেদ সালাহ। তিনজনই কিন্তু খেলেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল।
এখানেই একটা ব্যবধান কিন্তু মেসির সঙ্গে বাকি তিন ফাইনালিস্টের সঙ্গে গড়ে উঠেছে। ব্যাক্তিগত অনেক অর্জন হয়তো রয়েছে মেসির। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জিততে না পারা কিংবা ফাইনাল খেলতে না পারাটাই হচ্ছে তার বড় অযোগ্যতা।
৩১ বছর বয়সী বার্সেলোনার এই সুপারস্টার কিন্তু নতুন মৌসুমের শুরুতেই ক্লাবের নেতৃত্বের দায়িত্ব নিয়ে, বোকা জুনিয়র্সের বিপক্ষে হুয়ান গাম্পার ট্রফিতে মাঠে নামার আগে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, ‘এবার আমাদের মূল দায়িত্ব ইউরোপ সেরার ট্রফিটা ন্যু ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনা।’ এটা মেসির প্রতিশ্রুতি। মেসি স্পেনে কি করছেন, সেটা কিন্তু কোনো বিষয়ই নয়। সেরার পুরস্কার জিততে হলে ইউরোপিয়ান পর্যায়ে ভালো কিছু করতে হবে- এটাই যেন এখন স্বতঃসিদ্ধ বিষয়।
গত মৌসুমে বার্সার হয়ে লা লিগায় ৩৪ গোলের সঙ্গে ১২ অ্যাসিস্ট। যে কারও চেয়ে গোল বেশি। লা লিগা এবং কোপা ডেল রে জয়েরও কোনো মূল্যায়ন হলো না। এমনকি টানা দ্বিতীয় বছর ইউরোপিয়ান গোল্ডেন স্যু জেতার পরও সেরা তিনে জায়গা হলো না তার।
রিয়ার মাদ্রিদ যখন ইউরোপিয়ান পর্যায়ে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, সেখানে বার্সেলোনার গত এক দশকে নজর যেন বেশি ঘরোয়া ফুটবলেই। ব্যাক্তিগত পুরস্কারের কথা আসলে, মেসিই হচ্ছে বার্সার প্রতীক। বার্সার মুখশ্রী। কিন্তু তার সেই চেহারাই আবার টানা তিনবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায়ের বড় বিজ্ঞাপনও।
কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে সেরা খেলোয়াড় হয়তো বা সব সময় সব কিছু জিততে পারে না। ফুটবল হচ্ছে একটি দলীয় খেলা। এখানে দলীয় অর্জনের সঙ্গে ব্যক্তির অর্জন মূল্যায়ন হয়। যেমন গত রোববারের ম্যাচ। নবাগত হুয়েস্কাকে মেসির দল বার্সা গোল বন্যায় ভাসিয়েছে। জিতেছে ৮-২ ব্যবধানে। যার মধ্যে ২টি দিয়েছেন মেসি নিজে। ২টি ছিল অ্যাসিস্ট এবং একটিতে ছিল হ্যাটিট্রকের সম্ভাবনা। সেটাও তিনি ঠেলে দিলেন সুয়ারেজের কোর্টে। তাকে দিলেন পেনাল্টি শট নিতে।
তার এই অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখে বিখ্যাত এক সাংবাদিক লিখেছেন, ‘ইতিহাসে মেসির পারফরম্যান্স কখনোই নিচের দিকে যাবে না। এমনকি কোনো খেলোয়াড়ই পারবে না তার মত এমন কোনো পারফরম্যান্স দেখাতে। সে সত্যিকার একজন অসাধারণ প্রতিভা।’
এটাও একটা বড় সমস্যা হয়তো। কারণ, নিয়মিতই তো মেসি এমন পারফরম্যান্স করে যান। যা মানুষের চোখে এখন সহনীয় হয়ে গেছে। মানুষ মনে করে, এটা তো একেবারেই স্বাভাবিক। তারা ভাবে, মেসিদের প্রয়োজন আরও বেশি কিছু করা। ইতিমধ্যে যা করে ফেলেছে, তার চেয়ে বেশি কিছু। প্রতিটি ম্যাচেই অসাধারণ কিছু করে দেখাবে। ১০ ম্যাচের মধ্যে ৯টি তে নয়, ১০টিতেই। তাদের উচিৎ, প্রতিটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে খেলতে হবে। তারা মনে করে, মেসি প্রশ্নাতীতভাবে আর্জেন্টিনার হয়ে খেলে বিশ্বকাপটা হাতে তুলে নেবে।
মেসির পক্ষে এখন একটাই সম্ভব, আগামী বছর ৬ষ্ঠবারের মত ফিফা বর্ষসেরার পুরস্কার জেতার চেষ্টা করা। তার সামনে হয়তো সে সুযোগ তৈরি হয়েও যাবে। আলাভেস এবং হুয়েস্কার বিপক্ষে যা করেছেন, তার ধারাবাহিকতা যদি ধরে রাখতে পারেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগে যদি টটেনহ্যাম এবং ইন্টার মিলানের বিপক্ষে। সে সঙ্গে ২০১৩ সালে বায়ার্ন, ২০১১ সালে রিয়াল মাদ্রিদ এবং ২০১৭ সালে নকআউট স্টেজে জুভেন্টাসকে যেভাবে বিদায় করেছিলেন, সেভাবে করতে পারেন। তাহলে একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে মেসির সামনে।
স্প্যানিশ লিগ এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগে এই পারফরম্যান্সের সঙ্গে আরও জোরালো একটা দাবি মেসি তোলার সুযোগ পাবেন। জাতীয় দল থেকে যদি অবসর নিয়ে না থেকে থাকেন তাহলে আগামী কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনার হয়ে খেলে দলকে চ্যাম্পিয়ন করাতে পারলে, হয়তো ৬ষ্ঠবার ফিফা বর্ষসেরার পুরস্কার উঠতে পারে মেসির হাতে।
যদিও এসবে কিছুই আসে যায় না মেসির জন্য। কারণ, তিনি এমনিতেই সেরা। জেরার্ড পিকে যেমন টুইট করেছিলেন। যেটাতে রি টুইট হয়েছিল ৭০ হাজার। সেখানে পিকে লিখেছেন, ‘যদি ব্যালন ডি’অর পৃথিবীর সেরা ফুটবলারের হাতে তুলে দেয়া হতো, তাহলে ২০০৯ সালের পর থেকে লিওনেল মেসিই হতেন তার একমাত্র বিজেতা। কারণ, সে তো ভিন্ন গ্রহের এক ফুটবলার।’
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।