এম.আর মাহামুদ

প্রতিদিনই দেশ বিদেশে কোন না কোন সংবাদের জন্ম হয়। এসব সংবাদ সংবাদপত্রে বা প্রচার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আবার অনেক সংবাদ সংবাদপত্রের স্থান পায়না। কোন কোন ক্ষেত্রে মিথ্যা সংবাদে প্রকাশিত হতে দেখা যায়। এতে পাঠক বিভ্রান্ত হয় ওই সংবাদপত্র ও সাংবাদিক নিয়ে বাজে মন্তব্য করতেও অনেক পাঠক কৃপনতা করেনা। নানা কারণে ভুল সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে কর্তৃপক্ষ ভূল স্বীকার করে পাঠকের কাছে ক্ষমা চাওয়ার নজিরও কম নেই।

আমার সাংবাদিকতার হাতে খড়ি চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক নয়া বাংলার লামা মহকুমার প্রতিনিধি হিসেবে। তখনও আমি ছাত্র। লেখা পড়া করতাম চট্টগ্রাম মহানগরির হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে। থাকতাম ওই কলেজের ছাত্রাবাসে। সেকারণে বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সংবাদ থেকে বঞ্চিত হতাম (স্পট নিউজ)। তবে সে সময়ে লামা মহকুমার তিনটি থানা লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ির যোগাযোগ, স্বাস্থ্য সেবা, আইন শৃঙ্খলাসহ সবক্ষেত্রেই ছিল অনগ্রসর। এ অনগ্রসর জনপদে সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে প্রচুর প্রতিবেদন নয়া বাংলায় প্রকাশ করেছি। বর্ষার প্রবল বর্ষণে মাতামুহুরী নদীতে সৃষ্ট পাহাড়ী ঢলে লামা মহকুমা সদর গলা সমান পানিতে তলিয়ে যায়। জন জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। সংবাদটি নয়া বাংলার প্রথম পাতায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হওয়ার পর শুরু হল ত্রাণ তৎপরতা। ঘটনাটি ঘটেছিল এরশাদ জামানায়। পরিদর্শনে আসলেন একজন বড় সামরিক কর্মকর্তা। তিনি হলেন বর্তমানে আওয়ামীলীগের এমপি মেজর জেনারেল (অবঃ) সুবেদ আলী ভুঁইয়া। লামা পরিদর্শনে এসে দেখলেন কোথাও বন্যার পানি নেই। তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে সেই সময়ে লামা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (পরে উপজেলা চেয়ারম্যান) মরহুম আলী মিয়ার কাছে জানতে চাইলেন- বন্যার পানি কোথায়? বন্যা কারে কয়? ইউপি চেয়ারম্যান আলী মিয়া মাতামুহুরী নদীর বন্যার বাস্তব অবস্থা তুলে ধরার চেস্টা করেছেন। কিন্তু ওই সামরিক কর্মকর্তা আলী মিয়ার ব্যখ্যায় সন্তুষ্ট নয়। সামরিক কায়দায় বলে বসলেন ওই সংবাদ পত্রিকায় কে পাঠিয়েছে? তখন আমি হাটু ভাঙ্গা মুরগির মত সামরিক কর্মকর্তার সামনে হাজির হয়ে বিনয়ের সাথে বললাম বন্যা হয়েছে, তবে এটা পাহাড়ি বন্যা, অতি বর্ষন হলে মাতামুহুরীর পানিতে লোকালয় তলিয়ে যায়। আর বৃষ্টি কমলে পানি নেমে যায়। এ বন্যার স্থায়ীত্ব ৬ থেকে ৭ ঘন্টার বেশি হয়না। পরে বন্যার পানির আলামত দেখাতে গিয়ে লামা মহকুমা প্রশাসক কার্যালয়ের দেয়ালে পানির চিহ্ন দেখে তিনি বিশ্বাস করলেন সত্যিই লামায় বন্যা হয়েছে। না হয় সেদিন কিযে অবস্থা হত আল্লাহ্ ভাল জানে।

চকরিয়া প্রেস ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এ উপজেলার প্রথম নির্বাহী কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান। তিনি চাঁদ পুরে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে একটি জাতীয় দৈনিক-এ সংবাদ ছাপানো হয়েছে “মেঘনায় লঞ্চ ডুবি, শতশত যাত্রি নিখোঁজ, লাশ ভাসছে”। এ সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর তোলপাড় শুরু হল। মহকুমা প্রশাসনের নেতৃত্বে লাশ উদ্ধারের জন্য মেঘনায় অভিযান চালানো হল। কিন্তু কোন লাশ পাওয়া গেলনা। পাওয়া গেল কয়েকশ কাঠাল। বাস্তবে ডুবে যাওয়া লঞ্চে কোন যাত্রী ছিলনা। ওঠা ছিল কাঠাল ভর্তি লঞ্চ। অনুমান নির্ভর সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে কাঠাল গুলোকেই মনে করা হয়েছিল মানুষের লাশ। সেক্ষেত্রে সত্যতা যাছাই করা হয়নি বলে একটি জাতীয় দৈনিকে বাস্তবতা বিবর্জিত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। সেকারনে সাংবাদিক ভাইয়েরা সব সময় সচেতনতার সাথে সত্যতা যাছাই করে সংবাদ প্রকাশ করবেন। কারণ, আপনাদের স্মরণ থাকা দরকার আজকের পত্রিকা আগামীকালের “লবনের টোঙ্গা”। কথাগুলো বলেছিলেন চকরিয়া উপজেলার প্রথম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান সাহেব। তিনি হয়তো এতদিন বেছে নেই। তবে ওনার কথাগুলো বার বার স্মরণ হয়। গত সোমবার রাত ৯ টার দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দেখা গেল, মহাসড়কের বানিয়ার ছড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় ১২ জন নিহত। এ সংবাদ দেখে যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা। কারণ ওই সময় আমি বাড়ীতে। যদি ঘটনা সত্য হয়ে থাকে চাকুরী থাকার কথা নয়। পরে খোজ খবর নিয়ে দেখলাম, এ সংবাদের কোন সত্যতা নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংবাদ যারা দেখেছে তারা বিভ্রান্ত হয়েছে। ওই ধরণের মিথ্যা স্ট্যাটাস দেয়া ব্যক্তিকে নিয়ে নানা মন্তব্য করতেও ভুল করেনি পাঠকরা। এ ধরণের গাজাখুরি সংবাদ পরিবেশন করায় প্রকৃত সাংবাদিকদের মান ক্ষুন্ন হয়েছে বলে মনে করি। লামায় মহকুমায় সাংবাদিকতা করাকালীন সময় নয়া বাংলায় একটি সংবাদ প্রকাশ করে বড় বেকায়দায় পড়েছিলাম। সংবাদটি হচ্ছে “আলীকদমের দূর্গম পাহাড়ী এলাকায় দুজন গরু ব্যবসায়ীকে খুন করেছিল পাহাড়ী দুর্বৃত্তরা, পরদিন এ সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর আলীকদম সেনানিবাসের অধিনায়ক আমাকে খুজতে শুরু করে। ওই রাতে আমি ছিলাম লামা বাজারস্থ রোকেয়া বোর্ডিংএর ৪নং কক্ষে। রাত ১২ টার দিকে দরজার কড়া নড়া শুরু করলেন, জানতে চাইলাম কে? বললেন- আমি আলী মিয়া, আমি ওঠে বললাম দাদা কি সমস্যা তিনি বললেন, তোকে নিয়ে এখনই আলীকদম সেনানিবাসে যেতে হবে। আমি ভয়ে কাতর হলেও তাদের সাথে সেনানিবাসে গেলাম। অধিনায়ক বলে বসলেন এ ধরণের মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করেছেন কেন, জিওসি চট্টগ্রামের চাপে আমরা অতিষ্ঠ। এ সংবাদ মিথ্যা হিসেবে কালকের পত্রিকায় প্রতিবাদ ছাপাতে হবে। আমি বাধ্য হয়ে বললাম কাল নয় পরশু প্রতিবাদ ছাপিয়ে দেব। হুমকি ধমকির পরেও অধিনায়ক মহোদয় আমাকে চট্টগ্রাম যাওয়ার গাড়ীভাড়া টুকু ব্যবস্থা করে দিলেন। আল্লাহর কি রহমত পরদিন আলীকদম থানা পুলিশের সহায়তায় দূর্গম পাহাড় থেকে লাশ দুটি উদ্ধার করে। তখন আমি টেলিফোনে অধিনায়ক মহোদয়কে বললাম লাশ দুটি উদ্ধার হয়েছে প্রতিবাদ ছাপাবো কিনা? তিনি বললেন ছোট ভাই তোমাকে কষ্ট দিয়েছি, অনেক হাকাবকা করেছি, ক্ষমা করে দিও। তোমার সংবাদই যথার্থ। এখন কি আর সেই জবাবদিহিতা আছে? এখন মফস্বলের সাংবাদিকেরা সাংবাদিকেতার নামে গকুলের সাঁড়ের মত ছুটেই চলছে, লাগাম টানার কেউই কি নেই।