> মান্নাকে নিয়ে ড. কামালের ঘোর আপত্তি >জামায়াতকে বি চৌধুরীর নাকচ
কালের কণ্ঠ:
উদারপন্থী দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির ঐক্য শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। কারণ বিএনপির সঙ্গে ওই দলগুলোর যেমন কিছু ইস্যুতে সমস্যা রয়েছে, তেমনি ওই দলগুলোর অভ্যন্তরেও নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতার পাশাপাশি রয়েছে কিছু ব্যক্তিগত ইস্যু। এ কারণেই দফায় দফায় বৈঠক হওয়া সত্ত্বেও বেশ কিছুদিন ধরেই একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে বৃহত্তর ঐক্য।
যদিও সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের ব্যাপারে ঐকমত্য হওয়ার প্রশ্নে বিএনপিসহ ওই দলগুলো একমত, এমনকি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে উত্থাপিত তাদের দাবিগুলোও প্রায় কাছাকাছি; কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু ইস্যুতে নেতাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা প্রশ্নে বিকল্পধারার সভাপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের মধ্যে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ চলছে বলে অনেকে মনে করছে। আবার শুরু থেকেই ড. কামাল হোসেন রাজনৈতিকভাবে গ্রহণ করতে পারছেন না নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে। এমন পরিস্থিতিতে বৃহত্তর ঐক্য প্রশ্নে বিএনপি তাদের তৎপরতা কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে। জানা গেছে, উদারপন্থী দলগুলো শেষ পর্যন্ত কী করে তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে দলটি।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, উদারপন্থী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার পর বিএনপির সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্য একটি জায়গায় গিয়ে রূপ নেবে। তাঁর মতে, এ ধরনের বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠার আগে অনেক ইস্যু সামনে চলে আসে, যা নিষ্পত্তি হতে সময় লাগে। তাই এটিকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখলে চলবে না।
বিএনপির কাছে দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে গণফোরামের চেয়ে বিকল্পধারা ইদানীং বেশি সোচ্চার বলে মনে করা হচ্ছে। ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য দেড় শ আসন ছাড়াও এ দলটি জামায়াত প্রশ্নে এখন সবচেয়ে বেশি সরব।
অন্যদিকে, জামায়াত প্রশ্নে গণফোরাম প্রথম দিকে শক্ত অবস্থান নিলেও এখন কিছুটা কৌশলী। সরকারের বিরুদ্ধেও এখন অনেক বেশি সোচ্চার ড. কামাল হোসেন। এ কারণে বিকল্প ধারা মনে করে, ‘প্রধানমন্ত্রিত্ব’ ছেড়ে দেওয়া প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে ড. কামালের কোনো গোপন সমঝোতা হয়ে থাকতে পারে। যদিও বিষয়টি দায়িত্বশীল কোনো সূত্র থেকে দলটি নিশ্চিত করতে পারেনি।
সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী অবশ্য এ প্রশ্নে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। বিদেশ থেকে কেউ কেউ অফার দিয়েছে বলে গুজব শোনা যাচ্ছে। তা ছাড়া কারো ইচ্ছা থাকতেই পারে। কিন্তু আমার নেই।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবারের বৈঠকে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য প্রশ্নে কোনো আলোচনা হয়নি। আর জামায়াত যেখানে থাকবে সেখানে বিকল্পধারা ঐক্য করবে না—এটিও জানিয়ে দিয়েছি।’
ঐক্য প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতাকারী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্বীকার করেন যে বৃহত্তর ঐক্য প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট দলগুলোর মধ্যে কিছু সমস্যা আছে। তাঁর মতে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব সব সময়ই ছিল, এখনো আছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঐক্যের ব্যাপারে বি. চৌধুরীর বেশি সোচ্চার হওয়া উচিত। কারণ তিনি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু কেন জানি মনে হয় কিছু ঘাটতি আছে—যোগ করেন গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট এই মুক্তিযোদ্ধা।
সর্বশেষ মঙ্গলবার রাতে ড. কামাল হোসেনের বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে উদারপন্থী তিন দলের (বিকল্পধারা, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্য) সমন্বয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরাম উভয়ে সাত দফা প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং ওই দফা নিয়ে কেউ কোনো আপত্তি তোলেনি। কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে মতবিরোধ বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বৈঠকে বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান পুরো সময় জুড়ে বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলেন। তাঁর ভাষায় ‘এক স্বৈরাচারকে (সরকার) বাদ দিয়ে আরেক স্বৈরাচারকে (বিএনপি) আনব কি না তা ভেবে দেখতে হবে’। বিএনপি ক্ষমতার ভারসাম্য চায় না বলেও তিনি অভিযোগ তোলেন।
যুক্তফ্রন্টের একাধিক নেতা কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন যে মেজর মান্নান বিএনপির নামই শুনতে পারেন না। এমনকি বিএনপির নেতৃত্বে বৃহত্তর ঐক্য হোক—এটিও তিনি মানতে চান না।
অন্যদিকে বিকল্পধারার সভাপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী মঙ্গলবারের বৈঠকে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রশ্নেই বেশি কথা বলেছেন। অর্থাৎ, বিএনপিকে কিছুতেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেওয়া যাবে না—এটি বোঝানোর চেষ্টা করেন তিনি। পাশাপাশি যুক্তফ্রন্টের সাত দফায় উল্লেখ না থাকলেও জোট করতে হলে বিএনপিকে দেড় শ আসন ছাড়তে হবে এমন প্রস্তাবের প্রতি ইঙ্গিত করেন। যদিও এ প্রশ্নে অন্য দলগুলো তেমন গুরুত্ব দেয়নি বলে জানা যায়। ঐক্য প্রক্রিয়ার মধ্যস্থতাকারী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তখন মত দেন যে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি যাতে চোখ ওল্টাতে না পারে সে ব্যবস্থা করা উচিত। তবে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ করে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য এনে নানাভাবে করা যায়। বাইরে থেকে একজনকে সরকারপ্রধান করেও করা যায়।
এদিকে বৈঠক শেষে বি. চৌধুরীর সাংবাদিকদের ব্রিফ করার সময় মাহমুদুর রহমান মান্না তা এড়িয়ে যান। সুলতান মোহম্মদ মনসুর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ২২ সেপ্টেম্বরের সমাবেশে সবাই উপস্থিত থাকবে। এ সময় মাহী বি. চৌধুরী এর বিরোধিতা করে বলেন, এ বিষয়ে কোনো আলাপই হয়নি।
নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, জামায়াত থাকলে কারো সঙ্গে ঐক্য হবে না এ কথা বৈঠকে বারবার একাই বলেন বি. চৌধুরী। তবে উপস্থিত অন্য দলগুলোর নেতারা এ প্রশ্নে বেশি জোর দেননি। তাঁরা বলেন, জামায়াত ছাড়া সব দলকে জোটে ওয়েলকাম করা হবে। কিন্তু এই ইস্যুতে হৈচৈ করা এখনি ঠিক হবে না। তাঁরা আগে রাজপথে নেমে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায়ে জোর দেওয়ার কথা বলেন।
এদিকে একসঙ্গে কাজ করার জন্য যে যৌথ ঘোষণা বা রূপরেখার প্রয়োজন হবে তা তৈরিতে একটি সাব-কমিটি গঠন নিয়ে বচসা হয় ড. কামাল ও মান্নার মধ্যে। ড. কামাল প্রথমে কমিটি গঠনেই রাজি হননি। এরপর অন্য দলের চাপের মুখে রাজি হন। এরপর প্রত্যেক দল থেকে দুজন ওই কমিটিতে থাকবেন বলে প্রস্তাব করে ড. কামাল গণফোরামের সঙ্গে ‘ঐক্য প্রক্রিয়া’ থেকেও দুজনের নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু ঐক্য প্রক্রিয়া কোনো দল নয় বলে বৈঠকে আলোচনা উঠলে পরে ড. কামাল একজন করে নাম দেওয়ার কথা বলেন। এ পর্যায়ে মান্না তাঁর দল থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ডা. জাহিদুর রহমানের নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন ড. কামাল। তিনি বলেন, এ ধরনের নাম দিলে তো আরো ১০ নেতার নাম যোগ করতে হবে। ড. কামাল এ পর্যায়ে বলেন, ‘আমি নাম নিলাম না।’ আর ‘আমি নাম দিলাম’ বলে জবাব দেন মান্না। এ পর্যায়ে ড. কামাল রেগে গিয়ে বলেন ‘মিটিং আজ শেষ।’
মান্না তখন কাউকে কিছু না বলে চলে যান। কিন্তু বৈঠকের ইতিবাচক ভাবমূর্তি রক্ষায় কৌশলে অধ্যাপক বি চৌধুরী তখন সাবকমিটির নাম ঘোষণা করে দেন, যেখানে জাহিদুর রহমানের নামও ছিল।
ড. কামালের বাসায় বৈঠকের আগে বি চৌধুরীর বাসায় অনুষ্ঠিত যুক্তফ্রন্টের বৈঠকে ড. কামালের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয় এবং নেতারা একমত হন যে ড. কামাল সব কিছু একা করতে চান এবং ‘ক্রেডিট’ও তিনি একাই নিতে চান। ড. কামালের বাসায় যাওয়ার আগে দু-এক নেতা এমন মন্তব্যও করেন যে তাঁর সঙ্গে বৈঠকে যাওয়ার অর্থ ফাঁদে পড়া।
এদিকে যুক্তফ্রন্টের বদলে বি চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেন একসঙ্গে জোট বেঁধেছেন এবং কাজ করতে রাজি হয়েছেন বেশির ভাগ গণমাধ্যমে—এ ধরনের খবর প্রকাশিত হওয়ায় কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েছেন অন্য দুটি দলের নেতারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুক্তফ্রন্টের একটি দলের শীর্ষ এক নেতা গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বি চৌধুরী ও ড. কামাল গত কয়েক বছরে মোট ২৩ বার মিটিং করেছেন। তাঁরা আমাদের ছাড়া পারলে কিছু করে দেখান।’
মাহমুদুর রহমান মান্না অবশ্য মনে করেন, দেশের যে পরিস্থিতি তাতে বি চৌধুরী ও কামাল হোসেনের মধ্যে দ্বন্দ্বের কোনো সুযোগ নেই। সুষ্ঠু নির্বাচন আদায়ের লড়াইয়ে তাঁরা এক হবেনই।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুক্তফ্রন্টের একটি দলের নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, সত্যি কথা বলতে গেলে উদারপন্থী দলগুলোর দু-একটি দলের নেতাদের মনোভাব দেখে মনে হয় ঐক্যপ্রক্রিয়া দশ কদমও এগোবে না। অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, গণফোরামের শীর্ষ পর্যায়ের দু-এক নেতার সংকীর্ণতা সীমার বাইরে।
এ প্রসঙ্গে যুক্তফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত একটি দলের নেতা সাম্প্রতিককালে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরীর তিন দফা শর্তের পরও বিএনপি গণফোরামের সঙ্গে ঐক্য করলে বলার কী আছে!
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ঐক্য না করা, জোটগতভাবে খালেদা জিয়ার মুক্তি চাওয়া যাবে না এবং তারেক রহমানকে দেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া যাবে না—ড. কামালের পক্ষে বিএনপির উদ্দেশে এমন তিন শর্তের কথা গত ১৯ আগস্ট এক সাক্ষাৎকারে বলেন সুব্রত চৌধুরী। সূত্র মতে, এ ঘটনা নিয়ে লন্ডনে ও ঢাকায় বিএনপিতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তারেক রহমান বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের কাছে এর সত্যতা জানতে চান। এদিকে এ ঘটনায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন ঐক্যপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিএনপি নেতারা। তাঁরা এমন শর্তের ব্যাপারে সংশোধনী দেওয়ার জন্য গণফোরামের কাছে বার্তাও পাঠান। তবে গণফোরাম এখন পর্যন্ত এ প্রশ্নে কোনো অবস্থান বদলায়নি।
জানতে চাইলে সুব্রত চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওই তিন শর্ত আসলে আমি ব্যক্তিগত চিন্তা থেকে দিয়েছি, আনুষ্ঠানিক শর্ত নয়। তবে সমস্যা হয়ে থাকলে এটি আলাপ-আলোচনা করে নিষ্পত্তি করা যাবে।’
ঐক্যপ্রক্রিয়া নিয়ে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে ড. কামালের কোনো শর্ত ছিল না। তিনি গণতন্ত্রের স্বার্থে যেকোনো ঐক্য প্রচেষ্টায় জোরালো ভূমিকার কথা বলেছেন। ফলে ওই তিন শর্তে ভুল-বোঝাবুঝির সুযোগ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।