আলমগীর মানিক, রাঙামাটি:
রাজনীতিতে দুই মেরুর দুই বাসিন্দা হলেও রাজনৈতিক নেতারাও মানুষ। তারা ওসমাজের অংশ এবং সামাজিকভাবে একেঅপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভ’তিপূর্ন। সাম্প্রতিক সময়ে ধারনাটি যদিও অনেকটাই পাল্টে গেছে, সেই ধারাবাহিকতাকে মিথ্যা প্রমান করে রাঙামাটির এক সময়ের ডাকসাইটে রাজনীতিবিদ আলহাজ নাজিম উদ্দিনকে এক নজর দেখতে সূদুর সিলেটে ছুটে গেলেন রাঙামাটি সাবেক প্রতিমন্ত্রী রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা দীপংকর তালুকদার। সিলেটের নিজ বাসভবনে দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন রাঙামাটি জেলা বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাগণের একজন আলহাজ নাজিম উদ্দিন। রাঙ্গামাটি থাকাকালীন সময়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও হতদরিদ্র মানুষের পাশে থেকে কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন পাহাড়ের সকল সম্প্রদায়ের অতিপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। যে ব্যক্তি সারা জীবন রাজনীতির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে সাধারণ মানুষের মনের কথা বলে বেড়িয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পাহাড়বাসীর অতিপ্রিয়ভাজন নাজিম চাচা সিলেটস্থ পৈতৃক ভিটায় দিনযাপন করছেন।
পাহাড়ের রাজনীতিতে গুরু-শিষ্য হিসেবে পরিচিত রাঙামাটি জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও রাঙামাটি জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদার। পাহাড়ে জাতীয় রাজনীতির অন্যতম দুই কর্ণদারের একজন আলহাজ্ব নাজিম উদ্দিন অসুস্থ হওয়ার পর থেকে রাজনীতি থেকে অবসরগ্রহণ করলেও এখনো রাজনীতির মাঠে বেশ সক্রিয়ই রয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা দীপংকার তালুকদার। তারই নির্দেশনায় এখনো সমানতালে চলছে পাহাড়ে আওয়ামীলীগের রাজনীতি। সারাদেশের যখন রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরমে ঠিক এমনইতর সময়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলের বর্ষিয়ান সহকর্মীকে রাঙামাটি থেকে সূদূর সিলেটে দেখতে গিয়ে রাজনৈতিক যে শিষ্টাচারের চর্চা করলেন দীপংকর তালুকদার। এধরনের নজির পাহাড়ের রাজনীতিতে তেমন একটা নজরে পড়েনি এখানে। দীপংকর তালুকদার এক নজর দেখতে সেই সূদুর সিলেটের বাসায় পৌছেই জড়িয়ে ধরলেন হুইল চেয়ারে বসে থাকা আলহাজ্ব নাজিম উদ্দিনকে। গলা জড়িয়ে বিনিময় করলেন কৌশলাদি।
আলহাজ্ব নাজিম উদ্দিনের বড় ছেলে রাঙামাটির তরুন রাজনীতিবীদ, একাধারে ক্রীড়াবিদ, সুশীল ব্যক্তিত্ব ও রাঙামাটি জেলা আইনজীবি সমিতির নেতা এ্যাডভোকেট মামুনুর রশিদ তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের টাইমলাইনে লেখেন, অসুস্থ বাবাকে দেখতে এলেন জনাব দীপঙ্কর তালুকদার। দুজন দুই রাজনৈতিক দলের নেতা। বাবা হলেন দীর্ঘকাল দায়িত্বে থাকা রাঙ্গামাটি জেলা বিএনপি’র সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, সাধারন সম্পাদক ও সভাপতি। আর জনাব দীপঙ্কর তালুকদার হলেন রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি, সাবেক সংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী। ৮৭সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে উভয়ে প্রায় প্রায় চার মাস জেল খেটেছেন। যে যার অবস্থানে রাজনীতি করলেও উভয়ের মধ্যে রাজনৈতিক সম্বোধন সম্পর্ক ছিল ওস্তাদ বলে। তারই ধারাবাহিকতায় সেই সুদুর রাঙ্গামাটি থেকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ৩৬০ আউলিয়ার পূন্যভূমী সিলেটে ছুটে এসেছেন বাকবিহীন, শয্যাশায়ী অসুস্থ বাবাকে দেখতে। যে ব্যাক্তি সারা জীবন পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন রাজনীতির জন্য-আর আজ তিনি দুই চাক্কার হুইলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। জনাব দীপংকর তালুকদার বাবার চিকিৎসা ও অসুস্থতার ভালো-মন্দ খবর নিয়েছেন এবং তিনি স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে পরিবারের সকলের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছেন। ধন্যবাদ দাদা কে। নিজের টাইম লাইনে লেখার শেষে এ্যাডভোকেট মামুনুর রশিদ মামুন লিখেন, “আমাদের সারা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যদি এভাবে গড়ে উঠতো…।
উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন এই পাবর্ত্য এলাকায় সকল দল-মত ও সম্প্রদায়ের উর্দ্বে উঠে জনগনের সাথে সম্পৃক্ত থেকে রাজনীতি করে গেছেন আলহাজ্ব নাজিম উদ্দিন আহম্মেদ। ৩০ বছরের রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ সেই ১৯৭৮ সালে শহীদ জিয়ার হাত ধরে দলের জেলা প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদক, পরবর্তিতে সাধারন সম্পাদক এবং ১৯৮৮ সাল হতে ২০০৮ সাল পযর্ন্ত জেলা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সেই বৈরী সময়ে শুধু রাঙ্গামাটি নয়-বেগম জিয়ার নির্দেশে সমগ্র পাবর্ত্য চট্টগ্রামে (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) দলের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন। যার ফলে এরশাদ সরকারের আমলে রাজবন্দী হিসাবে দীর্ঘ ৪ মাস কারাবরণ করতে হয়েছে। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী শূন্যতার মাঝেও দলকে সুসংগঠিত রাখতে এবং নেতা কর্মীদের মনোবল বাড়াতে পরাজয় জেনেও দলীয় প্রার্থী হয়েছেন ২৯৯ আসনে।
আলহাজ্ব নাজিম উদ্দিন তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে দল ও সকল সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্বে উঠে বিভিন্ন সামাজিক সংস্থার (সহ-সভাপতি: শাহ উচ্চ বিদ্যালয়, রাঙ্গামাটি সিনিয়র মাদ্রাসা, কেন্দ্রীয় জামে মসজীদ, কেন্দ্রীয় কবরস্থান, কেন্দ্রীয় ঈদগাহ, রাঙ্গামাটি মাজার-সভাপতি:-মোহামেডাম স্পোর্ট্ং ক্লাব, শাহ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ বিভিন্ন প্রতিষ্টান) সাথে জড়িত থেকে নিজেকে জনসেবায় সম্পৃক্ত রেখেছেন। যার ফলে সমগ্র জেলায় সকলের কাছে “চাচা” হিসাবে সম্বোধিত হতেন। আজ বয়সের ভারে ও অসুস্থতার কারনে অনেকটা দুর্বল হয়ে হুইল চেয়ারেই কাটছে বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ আলহাজ্ব নাজিম উদ্দিন তথা নাজিম চাচা’র দিনগুলো।
সারাদেশে যখন বিএনপি-আওয়ামীলীগের রাজনীতি সাপে-নেউলে অবস্থা, পাহাড়ের দাদা দীপংকর তালুকদার সম্প্রীতির রাজনীতির যে নজির রাঙামাটি ছাড়িয়ে সুদুর সিলেটে নাজিম চাচাকে দেখতে গিয়ে স্থাপন করলেন। বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে অনন্য অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে। এমনটাই মন্তব্য এখানকার রাজনীতিবীদদের।
অসুস্থ বিএনপি নেতা নাজিম উদ্দিনকে দেখতে গেলেন আওয়ামী লীগের দীপংকর তালুকদার
পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে