জাকারিয়া আলফাজ, টেকনাফ :

২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের সাথে সেদেশের সেনা ও মগদের সহিংসতার এক বছর পূর্ণ হলো। গতবছর ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর শুরু হয়েছিল ইতিহাসের এক জঘন্যতম বর্বরতা।

রোহিঙ্গাদের ভাষ্যমতে, সহিংসতা শুরুর আলামত দেখা দিয়েছিল ২৫ আগস্টের আরো দু’তিন দিন আগে থেকেই। তাই রোহিঙ্গাদের সাথে সেনা ও মগদের অনাকাঙ্খিত সংঘাতের ঘটনা ঘটতে পারে এবং এরই প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমারের বর্বর সেনাদের পাশবিক নির্যাতনের সম্ভাব্যতা মাথায় রেখে অনেক রোহিঙ্গা ২২ আগস্ট থেকেই নাফ নদ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করেছিল।

আগে থেকে পালিয়ে আশ্রয়ের চেষ্টারত রোহিঙ্গাদের ধারণা , সংঘাত শুরু হলে বা রোহিঙ্গাদের উপর সেনা ও মগদের চূড়ান্ত নির্যাতনের খড়গ নেমে আসলে হয়তো পালাবার দরজাটুকুও রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই আগে ভাগে পালিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ। কিন্তু এপারে বাংলাদেশের সীমান্তে তখনও রোহিঙ্গাদের জন্য অনুপ্রবেশের কোন সুযোগই ছিলনা।

বিশেষ করে টেকনাফ সীমান্তে দায়িত্বরত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও নাফ নদে কোস্ট গার্ডের সতর্ক অবস্থানের কারণে ২২ আগস্ট থেকে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত কোন রোহিঙ্গা এদেশে অনুপ্রবেশ করতে পারেনি। এই ছ’দিনে প্রায় কয়েক শতাধিক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঠেকিয়ে দিয়েছিল বিজিবি ও কোস্টগার্ড।

বিশেষ করে ২৫ আগস্ট যখন ওপারে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর চূড়ান্ত নির্যাতন শুরু হলো, তখন বেশ কিছু রোহিঙ্গা অগ্নিদগ্ধ, গুলিবিদ্ধ ও মুমুর্ষ অবস্থায় বাংলাদেশে ঢুকে গিয়েছিল। এদের মধ্যে যারা বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের নজরদারি ফাঁকি দিতে পেরেছিল তারা অন্তত সুচিকিৎসার সুযোগ নিতে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল।

এখানেই একথা জানিয়ে রাখতে হয় যে, ২৬ আগস্ট পর্যন্ত যেকোন ধরনের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে ঢাকা কঠোর অবস্থানে ছিল। ঢাকার কঠোরতায় রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে কোন ধরনের ছাড় ছিলনা। তাই অনেক আহত রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফেরতের নামে পুশব্যাকের কবলে পড়তে হয়েছিল। পুশব্যাকের পরও ফের তারা অন্তত প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে ঢুকার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল।

সেদিন ২৫ আগস্ট। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত দিয়ে ভোররাতে ঢুকে পড়েছিল বেশ কয়েকজন আহত রোহিঙ্গা। এরা সবাই মিয়ানমারের সেনা ও মগদের হাতে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। কারো মুখমন্ডল পোড়া, কারো পায়ে গুলির চিহ্ন, কারো সারা গায়ে আগুনে পুড়ার দাগ। সবাই মুমূর্ষ হয়ে চিকিৎসার জন্য অনুপ্রবেশ করেছিল।

ভোররাতে আসা এমন রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগই শাহপরীর দ্বীপ ছেড়ে অন্যত্র চিকিৎসার উদ্দ্যেশে চলে যেতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু সকাল ১১ টার দিকে একজন গুলিবিদ্ধ ও অগ্নিদগ্ধ রোহিঙ্গা শাহপরীর দ্বীপ খালের ভাঙ্গা অংশ থেকে টেকনাফের দিকে যাওয়ার পথে স্থানীয় বিজিবির জোয়ানদের নজরে পড়ে যায়। ততক্ষণে আহত রোহিঙ্গাকে নিয়ে স্পীডবোটটি অলরেডি স্টার্ট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নাছোড়া বিজিবি সদস্যরা আরেকটি স্পীডবোট নিয়ে তাদেরকে ধাওয়া করে আটকে ফেলে। তবে তখনো বিজিবি সদস্যরা জানতেননা যে, ওই রোহিঙ্গার শরীরের কি যে কাহিল, কি যে মর্মান্তিক!

যখন তাদের আটকেই পেলেছে বিজিবি, এবার উর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে জানাতে হবে, তাই জানানো হলো টেকনাফ ব্যাটালিয়নে। টেকনাফ ব্যাটালিয়ন তখনো তাৎক্ষণিক কোন সিদ্ধান্ত জানাতে ব্যর্থ হয়। জানিয়ে দেয়া হয়, আপাততে বিজিবি হেফাজতে রাখতে, ঢাকা থেকে সিদ্ধান্ত দেয়া হবে। মুমুর্ষ অবস্থার গুলিবিদ্ধ ও অগ্নিদগ্ধ ওই রোহিঙ্গা ও তার তিন স্বজনসহ ৪ জনকে শাহপরীর দ্বীপ নিয়ে গিয়ে বিজিবি হেফাজতে রাখা হয়েছিল। বিজিবির ভাষ্যমতে, আহত ব্যক্তিটিকে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আহত রোহিঙ্গার আঘাতের যে অবস্থা তাতে স্থানীয় চিকিৎসা কোন ভাবে উন্নতি আনার মতো ছিলনা।

সেদিনের ঘটনাটির নিরব স্বাক্ষী ছিলাম আমি। ক্ষুদ্র সাংবাদিকতায় আমার রোহিঙ্গাদের সংবাদ ও ছবি সংগ্রহে যাওয়া সেখানে। তাই বেচারা রোহিঙ্গার মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে দেখে আমি কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। বিজিবি কর্তা পূর্ব পরিচিত ছিল বলে বেশ অনুনয় বিনয় করে অনুরোধ করলাম, অন্তত আহত রোহিঙ্গাকে চিকিৎসার্থে হলেও ছেড়ে দেয়া যায় কিনা বা একটু মানবিকতা সম্ভব কিনা ? তার যদি কোনটিই সম্ভব না হয়, তাহলে সিদ্ধান্ত আসার আগে অন্তত বিজিবি হেফাজতে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা যাবে কি ?

কিন্তু বিজিবি সদস্য যে স্বরে আমাকে উত্তর দিলেন তাতে আমার মনে হলো, এ আরেক বেচারা যে কিনা ওই রোহিঙ্গাদের আটকিয়ে নিজের বিবেকের কাছে লজ্জায় অবনত হয়ে পড়লেন। তার ভাষায়, “ ভাই এমন মানুষটাকে আটকিয়ে আমার নিজেরও খারাপ লাগতেছে এখন, আমরাতো মানুষ, কিন্তু উপরের স্যারদের নির্দেশ মানতে হবে। স্যারদের যেহেতু জানানো হয়েছে বিধায় ঘটনাটি উর্ধ্বতন পর্যন্ত গড়িয়েছে। উপরের অর্ডার যেমন আসে আমাদের তেমনটি করতে হবে, করার কিছু নেই।”

যেটা বাস্তবতা সেটা হলো, আগে থেকে আমি কিছুটা রোহিঙ্গা বিদ্ধেষী ছিলাম বটে, তারপরও মানবতার কাতিরে একজন গুলিবিদ্ধ ও অগ্নিদগ্ধ রোহিঙ্গা মানবকে বাঁচানোর আন্তরিক ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা ছিল। ভেবেছিলাম এটিই আমার কর্তব্য। কর্তব্যের কাছে আপন-পর কেহ নেই। তাই কর্তব্য পালনের চেষ্টা ছিল।

যখন বিজিবি ওই রোহিঙ্গা বেচারাদের ছেড়েই দিলনা , ততক্ষণে আমি আমার কাজে চলে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম হয়তো ঘন্টা দু’য়েক রেখে এমনিতেই ছেড়ে দেবে। দেবেনা কেন, সকাল থেকে এরকম আরো যারা আহত অবস্থায় এসেছিল সবাইতো চিকিৎসা নিতে চলে যেতে সক্ষম হয়েছিল।

যখন বেলা গড়িয়ে এলো তখনো আমার ভাবনায় ছিল ওই বেচারাদের হয়তো এতক্ষণে বিজিবি ছেড়েই দিয়েছে। এভাবে রাত প্রায় সাড়ে সাতটা সময় আমাকে স্থানীয় ক্যাম্পের এক বিজিবি সদস্য জানালেন, কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাকে পুশব্যক করা হবে। ততক্ষণে আমার আর সকালের ওই অভাগা রোহিঙ্গা ভাইদের কথা মনে নেই।

রাত সাড়ে সাতটার দিকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে আমি নাফ নদের ধারে যেখান দিয়ে পুশব্যাক করা হবে সে স্পটে গেলাম, সংবাদ সংগ্রহে বেশ আগ্রহ নিয়ে ছবি তুলব বলে। কিন্তু সেখানে গিয়ে যা দেখলাম, তাতে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন থরথর করে কাঁপছিল। পুশব্যাক করা হচ্ছিল সকালের ওই বেচারাদের , যে কিনা গুলিবিদ্ধ ও অগ্নিদগ্ধ ! ততক্ষণে মনে হচ্ছিল আকাশটা যেন আমার মাথার উপর ভেঙ্গে পড়ছিল। আমি নিস্তব্ধ, নিরব হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। ভাবছিলাম, কত হাজার হাজার রোহিঙ্গা হাঁসি মুখে এমনিতেই ঢুকে পড়ছিল আর এই অভাগা আগুনে পুড়া মানুষটির জন্য আইনের যতো মারপ্যাঁচ !

সকালে যখন তাকে দেখেছিলাম, তখনো সে কিছুটা শক্তিধর ছিল। কিন্তু এখন যখন দেখলাম তার শারিরীক অবস্থার খুব্ই অবনতি ঘটল। সারা গায়ের এক তৃতীয়াংশ পুড়ে গেছে, সাথে পায়ে গুলি ! এমন একজন আহত মানুষ কতক্ষণ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে পারে। বেচারা তখন লুটিয়ে পড়েছিলেন মাঠিতে, দু’জনে ভার করে তাকে নৌকায় তুললেন পুশব্যাক দেয়ার জন্য। আমি তখন নিউজ , ছবি সব বাদ রেখে মুখভার করে দাঁড়িয়ে সব দেখলাম আর নাফের জলে নিজের চোখের অশ্রু বিসর্জন দিলাম।

সারাটি রাত আমার ওই রোহিঙ্গা ভাইটির জন্য আপসোস হয়েছিল আর মনে মনে ভাবছিলাম, আমরা এপার-ওপার, রোহিঙ্গা-বাঙ্গালী এভাবে কত ভেদাভেদে মানবতাকে অচিরেই হারিয়ে ফেলতে চলেছি। মনে যেটুকু অনুভব করেছিলাম, ওই রোহিঙ্গা ভাই গুলো না হয়তো চিৎকার দিয়ে প্রাণে বাঁচার আকুতি করতে পারেনি, কিন্তু হৃদয়ের গহীন থেকে তো তার সৃষ্টিকর্তাকে কতই না আকুতি করে যেন বলছিল; “ প্রভু ওরা মগ বলে হয়তো আমাদের মেরেছে, দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু এরা স্বজাতি হয়েও কেন আমাদের এভাবে আটকিয়ে রেখেছে ? কেন আমাদের প্রাণে বাঁচার চেষ্টা টুকুও করতে দিচ্ছেনা ?”

হয়তো ওই রোহিঙ্গাদের শেষ আকুতি এমনটিই ছিল “ প্রভু মুসলিম বা রোহিঙ্গা হয়ে হয়তো আমরা আজ বড় অপরাধীই হলাম, তাই এপার – ওপার দু’পারই হারাতে যাচ্ছি, কিন্ত ফরিয়াদ করছি আরেক পার এখনো বাকি, সেটি তোমার রহমতের দরবার, তুমি আমাদের মতো হতভাগা রোহিঙ্গাদের তোমার দরবারে অন্তত ঠাঁই দিও।”

শেষ টুকু কি হয়েছিল আমার আর জানা ছিলনা। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওই হতভাগা দেশ ছাড়া গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গাদের ঠাঁই নিশ্চয় মহান প্রভুর দরবারে হবেই। এটিই বিশ্বাস, এটিই সান্তনা।