সম্প্রতি মালয়েশিয়া সরকারের চালু করা ‘থ্রি প্লাস ওয়ান’ স্কিমের আওতাতেও যে কেউ ইমিগ্রেশনে ৪০০ রিঙ্গিত জমা দিয়ে সসম্মানে নিজ নিজ দেশে ফিরে যেতে গেলেও অনেকেই অভিযোগ করছেন, ৪০০ জায়গায় তাদের কাছে ৯০০ এর বেশি রিঙ্গিত দাবি করা হচ্ছে। এ পরিমাণ অর্থ জোগাড় করার ক্ষমতাই তাদের নেই।
খোজঁ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালে দেশটিতে কর্মরত অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতার ঘোষণা দেয় মালয়েশিয়া সরকার। ধাপে ধাপে সময় বাড়িয়ে দীর্ঘ আড়াইটি বছর চলে বৈধকরণ প্রক্রিয়া। শেষ হয় চলতি বছরের ৩০ জুন। এই সময়ের মধ্যে জন্ম নেয় অনেক প্রতারক চক্র। বৈধতা দূরের কথা বৈধ করার নাম করে খেটে খাওয়া অবৈধ কর্মীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারক চক্রটি।
বৈধ হওয়ার জন্য এসব প্রতারকদের হাতে টাকা-পয়সা আর পাসপোর্ট তুলে দিলেও তাদের কপালে জোটেনি বৈধতা। এসব অবৈধদের সংখ্যা প্রায় লাখ খানেকেরও বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারা এখন ইমিগ্রেশন এবং পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মালয়েশিয়া সরকার অবৈধ কর্মীদের বৈধ করার জন্য দুটি প্রোগ্রাম চালু রেখেছিল। একটি হচ্ছে রি-হিয়ারিং অন্যটি ই-কার্ড। এ দুটি প্রোগ্রামকে ঘিরে গড়ে উঠেছি শক্তিশালী একটি মিডিলম্যান চক্র। বৈধ হওয়া ও মালিকের কাছে কাজ পাওয়া, সব জায়গাতেই এ চক্রকে টাকা দিয়ে টিকে থাকতে হতো কর্মীদের। কর্মীদের বৈধ করে দেয়ার নামে ৫-১০ হাজার রিঙ্গিত জনপ্রতি হাতিয়ে নিয়েছে।
সরেজমিন ঘুরে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি প্রতারকদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা রীতিমতো নিজেদের নামে ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে প্রকাশ্যে এ ব্যবসা করেছেন। বাংলাদেশি অবৈধ কর্মীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন তাদের বৈধ করে দেয়ার জন্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্মীদের বৈধ করতে পারেননি। কর্মীদের টাকাও ফেরত দিচ্ছে না তারা। উল্টো কর্মীদের পুলিশের ভয় দেখানো হচ্ছে। এভাবে এ চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে থাকতে হচ্ছে কর্মীদের।
এছাড়া মালিক তাদের অর্ধেক মজুরিতে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। আবার বৈধতার নামে টাকা নিচ্ছে। ফলে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে মাস শেষে নিজে খেয়ে পরে বাঁচতেই কষ্ট হচ্ছে অবৈধ কর্মীদের। মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবাসী বলেন, ১০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি মিডিলম্যান দেশটিতে কর্মী কিনছে আর বিক্রি করছে। তারা যে যেভাবে পারে সেভাবেই কর্মীদের শোষণ করছে। কখনও হাইকমিশনের নামে, কখনও পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করে দেয়ার নামে আবার কখনও বৈধ করে দেয়ার নামে।
তিনি বলেন, কর্মীরা কোনোভাবেই মুক্তি পাচ্ছে না তাদের হাত থেকে। কর্মীরা বাধ্য হচ্ছে এ চক্রের কথামতো চলতে।
বৈধ হওয়ার আবেদন করতে কোনো কর্মীকে ১ হাজার ২০০ রিঙ্গিত জমা দেয়া লাগলেও অনেকেই প্রতারকদের বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে বৈধ হওয়ার জন্য নিশ্চিত মনে বসে ছিলেন। এরা আর কেউ নন, তারা বাংলাদেশেরই মানুষ। তারাও একদিন কর্মী হিসেবেই মালয়েশিয়ায় এসেছেন। দীর্ঘদিন দেশটিতে বসবাস করে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। এমনকি তাদের পুলিশের সঙ্গেও ভালো সখ্যতা গড়ে উঠেছে।
এ ব্যাপারে বৃহস্পতিবার কথা হয় রি-হিয়ারিংয়ের আওতায় রেজিস্ট্রেশন করা সৈয়দপুর জেলার জাজিরা উপজেলার দক্ষিণ দবিকান্দি গ্রামের ফাইসালের সঙ্গে। ফাইসাল এ প্রতিবেদককে জানান, এনএস ওয়ান ডেভেলপমেন্ট এসডিএন বিএইচডির নামে বৈধ হওয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশি কামালকে আমার গ্রুপের ১৫ জন সবাই দেড় লাখ করে টাকা দেয়। দীর্ঘদিন ধরে ঘুরিয়ে এখন বলছে ভিসা হবে না। বর্তমানে তার ফোন বন্ধ করে দিয়েছে। জানি না কি করবো এখন। ইমিগ্রেশন বিভাগের কঠোর অবস্থানের কারণে ভিসা না পেয়ে এখন দেশে যাওয়ার জন্য ইমিগ্রেশন থেকে আউট পাস সংগ্রহ করার অপেক্ষায় রয়েছেন ফাসাছাল।
এদিকে বাংলাদেশ হাইকমিশন বরাবর ডিএমএ সার্ভিস এসডিএন বিএইচডির পক্ষ থেকে বাংলাদেশি নাগরিক মো. শহীদের বিরুদ্ধে ৫০ জন বাংলাদেশির কাছ থেকে প্রায় ৬৮ লাখ রিঙ্গিত হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ জমা পড়েছে।
অভিযোগে জানা যায়, জহুরবারুর ডিএমএ সার্ভিস এসডিএন বিএইচডির হয়ে বৈধ হওয়ার আবেদনকারী ৫০ জন বাংলাদেশির কাছ থেকে জনপ্রতি ৬/৭ হাজার রিঙ্গিত করে নিয়েও পারমিট না করে বিভিন্ন টালবাহানা করায় বাংলাদেশি প্রতারক মো. শহীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ হাইকমিশন ও পুলিশের কাছে অভিযোগ দাখিল করেন কোম্পানির মালিক মুজাহিতি বিনতে মোহাম্মদ।
এছাড়া প্রতারিত ৫৪ জন বাংলাদেশি কর্মী পৃথক পৃথক ৫৪টি মামলা দায়ের করেছেন প্রতারক শহীদের বিরুদ্ধে।
এদিকে মালয়েশিয়া সরকার ১ জুলাই থেকে শুরু করে মেগা-থ্রি নামে অভিযান। আর এ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যেখানেই অভিযান পরিচালিত হচ্ছে সেখানেই আটক হচ্ছেন অবৈধরা।
দেশটিতে বসবাসরত প্রবাসীরা অভিযোগ করে বলেন, যখনই একটা এলাকায় অভিযান চালানো হচ্ছে প্রথমেই বৈধ ও অবৈধ- সব বিদেশি শ্রমিককে ধরে এনে খোলা জায়গায় বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে। রোদ হোক বৃষ্টি হোক তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তারপর কাগজপত্র পরীক্ষা করে যারা বৈধ তাদের ছেড়ে দেয়া হলেও বাকিদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ক্যাম্পে। কিন্তু কাগজপত্র ঠিক থাকুক বা না-থাকুক, হেনস্থা হতে হচ্ছে সকলকেই।
অভিযোগ রয়েছে, ক্যাম্পে নেয়ার পরও অবৈধ শ্রমিকদের দুর্দশার শেষ হচ্ছে তা মোটেই নয়। ১৪ দিনের মধ্যে আদালতে পেশ করা হলে তাদের যে সাজা হয়, প্রথমে সেই মেয়াদটা জেলে কাটাতে হয়। তারপর যদি তারা দেশে ফেরার টাকা জোগাড় করতে পারেন, তাহলে নিজেকে বিমানের টিকিট কেটে ফেরার ব্যবস্থা করতে হয়।
আটকের পর অবৈধদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে এবং তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে বাংলাদেশি, পাকিস্তান, ইন্ডিয়া ও মালয়েশিয়ান প্রায় ১৫শ প্রতারক এজেন্টদের তালিকা তৈরি করেছে অভিবাসন বিভাগ। মেগা-থ্রি অভিযানের পাশাপাশি এসব প্রতারকদের আটকে কাজ করছে দেশটির স্পেশাল বিভাগ।
-জাগোনিউজ
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।