এম.আর. মাহামুদ

চকরিয়ার মাতামুহুরী নদীর ব্রিজ সংলগ্ন পয়েন্টে ডুবে ৫ জন মেধাবী ছাত্রের মৃত্যুর পর থেকে মনটা ভেঙ্গে গেছে। চেষ্টা করেও একটা লেখা তৈরী করতে গিয়ে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ জনিত কারণে বার বার হোচড় খেয়েছি। গত ১৪ জুলাই বিকালে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটলেও রাত সাড়ে ১২ টার মধ্যে সব ক’জন ছাত্রের মৃত দেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪ জনের জানাযা নদীতে জেগে উঠা চরে নামাযে জানাযা অংশ গ্রহণের সৌভাগ্যও হয়েছে। তবে জানাযার দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে এই জানাযায় চকরিয়ার স্মরণ কালের স্মরণীয় জানাযা। জানাযায় অনেকেই সরবে ও নিরবে কান্নাকাটি করতে দেখেছি। মহান আল্লাহ্ শোকাহত পরিবারকে শোক সইবার তওফিক দিয়েছে বলে তারা এখনো বেচে আছেন। নাড়ি ছাড়া ধন, হারানো মা ও জন্মদাতা বাবারা এখনো শোকে পাথর। কথায় আছে “অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর”। তবে ১৪ জুলাইয়ের এ মর্মান্তিক ঘটনাকে মাতামুহুরী ট্রাজেডী হিসেবে ঘোষনা করার দাবী চকরিয়াবাসীর। এ দাবী বাস্তবায়ন হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ দিনের মর্মান্তিক ঘটনা সারাজীবন স্মরণ রাখবে। এছাড়া মর্মান্তিক ভাবে মৃত্যুর শিকার পাঁচ ছাত্রের স্মৃতি স্তম্ভ বা শোক স্তম্ভ ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় স্থাপন করা সময়ের দাবী। এতে আগামী প্রজন্ম অনেকটা সচেতন হবে বলে মনে হয়। যেসব পরিবার তাদের আদরের সন্তানদের হারিয়েছে তারা কোনদিন তাদের সেই প্রিয় ৫ সন্তানকে ফিরিয়ে পাবেনা।

যাক, বিপদ কাউকে বলে-কয়ে আসেনা। তবে সব ক্ষেত্রে সচেতন থাকা ভাল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা সফরে গিয়ে সমুদ্র সৈকতে বা বড় বড় নদীতে প্রাণ হারাচ্ছে। তার মুল কারণ সচেতনতা ও সাঁতার না জানা। দুঃখ করে বলতে হয় আজকাল নদীর পাড়ের ছেলেরাও সাঁতার জানেনা। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ থাকার কথা। কিন্তু অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ নেই। দেশে ভূমি সংকট রয়েছে, ফলে ইচ্ছা করলেই খেলার মাঠ করাও যাচ্ছেনা। তবে চকরিয়ার বেশ ক’টি প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ রয়েছে। তাও ব্যবহার অনুপযোগী। বিশেষ করে চকরিয়ার উপজেলা সদরের চকরিয়া কলেজ মাঠ, কমিউনিটি সেন্টার মাঠ, চকরিয়া সরকারী পাইলট হাই স্কুল মাঠ উল্লেখযোগ্য। এসব মাঠ ছাড়া আরো অনেক মাঠ রয়েছে। প্রতি বছর সরকারী ভাবে কাবিখা ও টাবিখা প্রকল্পের আওতায় উপজেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা ইচ্ছা করলে এসব মাঠ ভরাট করে খেলার উপযোগী করতে পারে। এসব মাঠ সংস্কার করা হলে চকরিয়া সদরের শিক্ষার্থীরা নদী সংলগ্ন চরে খেলতে না গিয়ে মাঠে খেলার অব্যস্থ হয়ে পড়বে। দুঃখ জনক হলেও সত্য প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন করে ক্রীড়া ও শরীর চর্চা শিক্ষক রয়েছে। তারা ক্রীড়া নিয়ে তেমন একটা তৎপরতা চালায় বলে মনে হয়না। শুধুমাত্র ফুটবল, ক্রিকেট, বেডমিন্টন, ভলিবল নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। কিন্তু এসব খেলা আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত হলেও আমাদের দেশীয় হাডুডু, কাবাডি, কানামাছি, দাড়িয়াবাধা, নৌকা বাইচ ও সাঁতার প্রতিযোগিতা এখন বিলুপ্ত প্রায়। নতুন প্রজন্ম এসব খেলা ভুলেই গেছে। আমাদের দেশ নদী মাতৃক দেশ। তাই সাঁতার জানাটা আমাদের জন্য অতি জরুরী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাতার শিখানো বাধ্যতামূলক করতে শরীর চর্চা ও ক্রীড়া শিক্ষকদের নির্দেশনা দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তাই নয় চকরিয়া উপজেলার দুটি অংশ দু ভাগেই বিভক্ত। একদিকে মাতামুহুরী নদী অপরদিকে উপকূলীয় এলাকা। দু অংশের মানুষই নানাভাবে প্রাকৃতিক দূর্যোগের শিকার হয়ে থাকে। এ সময় সাঁতার না জানা লোকজন নানাভাবে বিপর্যস্ত হয়। প্রশাসনের কাছে বিনীত আবেদন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সাঁতার শিখা বাধ্যতামুলক করার পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসে অগ্নি নির্বাপক দলের সাথে ডুবুরী রাখা প্রয়োজন। মাতামুহুরী নদীর ট্রাজেডীতে ডুবুরী না থাকায় নিখোজ ছাত্রদের মরদেহ উদ্ধারে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে ডুবুরী দল এসে দু’জন ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করেছে ৮ ঘন্টা পরে। ছাত্র জীবনে পড়া কবি সুকুমার রায়ের “ষোল আনাই মিছে” কবিতাটি বার বার মনে পড়ে। তৎমধ্যে কয়েক লাইন পাঠকের সুবিধার্থে তুলে ধরলাম-

বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে,
মাঝিরে কন, ”বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?”
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে হাসে।
বাবু বলেন, ”সারা জীবন মরলিরে তুই খাটি,
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি।”

খানিক বাদে কহেন বাবু, ”বলতো দেখি ভেবে
নদীর ধারা কেমনে আসে পাহাড় থেকে নেবে?
বলতো কেন লবণ পোরা সাগর ভরা পানি?”
মাঝি সে কয়, ”আরে মশাই অত কি আর জানি?”
বাবু বলেন, ”এই বয়সে জানিসনেও তা কি
জীবনটা তোর নেহাৎ খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি!”

আবার ভেবে কহেন বাবু, ” বলতো ওরে বুড়ো,
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চুড়ো?
বলতো দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন?”
বৃদ্ধ বলে, ”আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন?”
বাবু বলেন, ”বলব কি আর বলব তোরে কি তা,-
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।”

খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন, নৌকাখানি ডুবলো বুঝি দুলে!
মাঝিরে কন, ” একি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি,
ডুবলো নাকি নৌকা এবার? মরব নাকি আজি?”
মাঝি শুধায়, ”সাঁতার জানো?”- মাথা নাড়েন বাবু,
মূর্খ মাঝি বলে, ”মশাই, এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে!”