স্মরণ : প্রয়াত মুহাম্মদ সলিমুল্লাহ

-কাফি আনোয়ার

বাংগালী কৃষ্টিকালচার ও ঐতিহ্যের সাথে জীবনঘনিষ্টভাবে মিশে আছে আম ফলের রসঘন বয়ান ও বর্ণিল বাহার । ইংরেজী ব্যাকরণের কাল (tense) পড়াতে পড়াতে হেডস্যারের আমের উপমা সংযুক্ত বহুমাত্রিক বিশ্লেষন ও আমবয়ান আমাদের শ্রেণীকক্ষে প্রাণবন্ত মনোসংযোগের খোরাক যোগাত।

আম থেকে আমাম, আমাম থেকে আওয়াম, আওয়াম থেকে আওয়ামবাদ, মুঘল থেকে ফরাসী, আরব, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ব্রিটিশ ও বাংলা নির্মোহ ইতিহাসের কালনির্ঘন্টে আমসাহিত্যের পরিভ্রমণ সময়ের ব্যস্থানুপাতে পরিপুষ্ট।

আম পাকলে মানুষ স্বভাবগতভাবেই আমগাছে ঢিঁলটি ছুঁড়ে। আম্রকাননের শাখা-প্রশাখায় গ্রীষ্মের দাবদাহ উপেক্ষা করে দাপাদাপি, ভৌঁ-দৌঁড়, লুকোচুরি সবই চলে আমকেন্দ্রিক ।

এই আম্রগামিতা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ আমের দিকে যায় man goes toward …….. । আম্রগামিতার এই প্রবণতার কারণেই আমের ইংরেজী প্রতিশব্দ man goes (মানুয যায় ) ।

বাংলায় আম, সংস্কৃতে আম্র, মালয় ভাষায় ম্যাঙ্গা, চীনা ভাষায় ম্যাং যার বৈজ্ঞানিক পরিভাষা mangofera indica . আমের আদি নিবাস কিন্তু বাংলাদেশ অর্থাৎ এই ভারতবর্ষে।

mango বা আমের ব্যুৎপত্তিগত পরিভাষা, প্রতিশব্দ পড়াতে পড়াতে স্যারের

রসজ্ঞ আমসাহিত্যের অবতারণা শিক্ষার্থীদের মানসলোকে স্বতঃশ্চল চিত্রকল্প সৃষ্টি করত নিমিষেই ।

গতানুগতিক শিক্ষাদানের পদ্ধতিতে তিনি কখনো তৃপ্ত ছিলেন না ।

যে কারণে অভিনব পন্থা অবলম্ন করে সহজ, প্রাঞ্জল, সুখপাঠ্যময় ধারায় সদা সৃষ্টিশীলতাকে ধারণ করতেন। এটা ছিল তাঁর সম্পূর্ণ নিজস্ব একটা ঢং।

চরিত্রগতভাবে তিনি ছিলেন প্রথাবিরোধী। পেলব মসৃন কোমলতা যেমন ছিল তাঁর স্বভাবে, তেমনি ছিল ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা। তাঁর বিনয়ের অলংকারে গড়া মনিহারের প্রতিটি ছড়ায় নিষ্ঠা, মূল্যবোধ আর আদর্শের দীপ্তি প্রতিভাত হতো অবলীলায়।

তিনি আমাদের সলিম স্যার। সবার প্রিয় হেডস্যার । হেডমাষ্টার বলতে আমাদের কৈশোরোত্তীর্ণ বয়ঃসন্ধিক্ষণের মানসলোকে যে কল্পচিত্র অবধারিতভাবে ভেসে বেডাত ,তার প্রতিটি নাড়িনক্ষত্রই যেনো স্যারের আপাদমস্তক কিলবিল করত।

শিক্ষার্থীর অন্তর্জগতে জ্ঞানতৃষ্ণা জাগানো, বুদ্ধিবৃত্তিবিকাশ, চরিত্রগঠন ও মূল্যবোধসৃষ্টির ইতিবাচক অভিপ্রায় শিক্ষকের থাকা বাঞ্চনীয়। তার অবিকল ছায়ামানব ছিলেন আমাদের সলিম স্যার ।

কী শিক্ষক ! কী শিক্ষার্থী! কী অভিভাবক !কী সাধারণ মানুষ ! প্রত্যেককেই স্বভাবসুলভ সালাম আর প্রফুল্লহাসি দিয়ে জয় করেছেন । তাঁর বিনম্র আত্মবিশ্বাস ও ইতিবাচক মানসিকতার কাছে পরাভুত হয়েছে সমস্ত প্রতিকুলতা।

কোন সিদ্ধান্ত, নিবেদন কিংবা আরজি কখনো নীতিবিরুদ্ধে বা অপ্রাসঙ্গিক বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হলে তা অগ্রাহ্য করার যে কৌশল ও দর্শন তিনি প্রয়োগ করতেন তার দৃষ্টান্ত সমসাময়িককালে বিরল। সদাহাস্যোজ্জ্বল বদনে নাজুক পেলব টোটকা দিয়ে এমন এক আবহ তৈরী করতেন তাতে কঠিন শত্রুরা হাসিমুখে সান্তনার ঠিকানা খুঁজে পেত।

১৯৯২ সালের কথা। আমরা তখন ১০ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। একটা আবেদন নিয়ে গেলাম স্যারের দপ্তরে। উদ্দেশ্য স্কুল থিয়েটার। হাতে দরখাস্ত দেখে মুখে ভূবন মনোহারী মুচকি হাসির রেখা টেনে তাঁর চোখে স্ফুরিত ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বার্তা ছড়িয়ে দিলেন।

সাথে সাথে কর্পুরের মত উবে গেলো নবতারুণ্যের দোলায়িত হেডস্যার সন্ত্রস্ততা। আমাদের মুখেও সংক্রমিত হলো স্যারের ছড়ানো মুচকি হাসির রেখা। দরখাস্ত গ্রহণ না করেই তিনি তার শানে নুজুল জানতে চাইলেন। কিঞ্চিত ভয়, কিঞ্চিত জড়তার মিশেল আমাদের চোখে মুখে টুইটুম্বর।

আমি কিঞ্চিত আত্মবিশ্বাসের আনকোড়া চপলতায় বললাম, স্যার, আমরা একটা মঞ্চ নাটক করতে চাই।

অবশিষ্টাংশ স্যারের আত্মস্থ। আমাকে থামিয়ে স্যার আমাদের প্রিয় অসিতবাবু স্যারকে ডাকলেন। একটু তফাতে গোপাল বাবু স্যার দাঁড়িয়ে ছিলেন। হেডস্যার নিমিষেই বুঝে নিলেন সবই গোপাল বাবু স্যারের কলকাঠি। সংগে সংগে গোপাল বাবু স্যারকে তলব করে পরদিন থেকে শচীনসেন গুপ্তের ঐতিহাসিক নাটক ‘নবাব সিরাজদ্দৌলা ’র রিহার্সেল শুরু করার নির্দেশ দিলেন।

তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা, দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা, দুরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, সর্বগুণে গ্রাহ্য সার্বজনীনতা প্রত্যয়দীপ্ত অভিব্যক্তি, পরিশীলিত পরিমিতিবোধ, বিনম্র কোমলতায় চারিত্রিক দৃঢ়তায় তিনি স্বমহিমায় ছিলেন একজন আলোকিত মানুষ।

নেতৃত্বগুণের সুষম সমন্নয় তাঁকে অবিসংবাদিত শিক্ষাপ্রশাসক পরিণত করেছিল। শিক্ষার্থীদের অর্ন্তজগতে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, নৈতিক মূল্যবোধ ও আদর্শিক চেতনার বিজারন ঘটানোর প্রাণান্ত প্রয়াসের কারণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এতদাঞ্চলের একজন সংশপ্তক হেডমাষ্টার।

ঈদগাহ হাই স্কুলের পশ্চাতপদ এই জনপদের শুধু বিদ্যাপীঠই শুধু, এটার সমস্ত আশা আকাংখার ছায়াবৃক্ষ। যে কারণে সমস্ত শ্রেণীপেশা গণমানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিল্পসাহিত্যক্রীড়ার একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু। সলিম স্যারের মত কিছু ক্ষণজন্মা প্রবাদপুরুষের সংস্পর্শে এই স্কুল বিদ্যাচর্চার বাইরেও একটি প্রতিভাবিকাশের তীর্থস্থানের

রূপ পরিগ্রহ করে।

১৯৪৫ সালে রামু উপজেলার বর্তমান রশিদনগর ইউয়িনের মাছুয়াখালী গ্রামের সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা ছিলেন মাছুয়াখালীর বিশিষ্ট জমিদার নুরুল হক সিকাদার।

তিনি ছিলেন বৃহত্তর ঈদগাও, রামু, কক্সবাজার সদর সর্বপ্রথম এমএ, এমএড ডিগ্রী অর্জন করা প্রধান শিক্ষক।

১৯৮৯ সালে তিনি ঈদগাহ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। আমাদের চারপাশে মুখোশধারী কতিপয় হীনস্বার্থবিলাসী ব্যক্তির বিকৃতমানসিকতার রাজনীতির শিকার হয়ে দায়িত্বকালীন অবস্থায় ২০০৬ সালে অনৈমিত্তিক অবসরগ্রহণ করেন।

ব্যক্তিত্বের অনুধ্যানে অনুরণিত নির্মোহ এক অনির্বচনীয় ও সম্মোহনী সরলতা তাঁকে তাঁর অনতিম দিনগুলিতে প্রতিনিয়ত দাহ করেছে।

১৯৮৭-১৯৮৯ সাল পর্যন্ত অবৈতনিকভাবে তিনি ছিলেন ঈদগাহ কলেজ প্রতিষ্ঠাতা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ।

শত শত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের পদভারে মুখরিত হবে এই বিদ্যাবতীর মালঞ্চ। নতুনের আবাহন, পুরানো জীর্ণতায় স্মৃতিবিস্মৃতির ক্যানভাসে উদ্বেলিত হবে প্রাণস্পন্দন। পুনমির্লন কিংবা পারষ্পারিক সমবন্ধনে চিরতারুণ্যের ঐকতানে সুরসপ্তক হয়ে বেঁচে থাকবে আমাদের হেড স্যার। অবিনাশী চেতনার অয়োময়

২০১৭ সালের ৩ মে রাত সাড়ে ৯ টায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আমসাহিত্যের বয়ানে পুষ্পসুধাগন্ধময় সুখপাঠ সৃষ্টির মাধ্যমে হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের মানসলোকে যে অধিষ্ঠান তিনি গড়ে তুলেছে তাঁর ইতিহাস এই স্রোতস্বিনী ফুলেশ্বরী নদীর কুলকুল ধবনিব্যঞ্জনায় বাংময় হয়ে থাকবে অবিভাজ্য মহাকাল ।