এইচ এম আবু ছিদ্দিক :
সাম্প্রতিক কুতুপালং শরনার্থী শিবিরে বিপন্ন রোহিঙ্গাদের খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলাম। সেখানে অবস্থানরত রোহিঙ্গা আব্দুল করিমের সাথে কথা হয়। তার ভাষায় সে রাখাইন রাজ্যে কাপড়ের ব্যবসাসহ প্রায় দুইশ’র মতো গবাদি পশু লালন-পালন করতেন। কর্মক্ষম ৪ সন্তানের সহযোগিতায় খুব ভালমতেই চলছিল তার জীবন। মিয়ানমার সেনাবাহিনী নামের নরপশুরা ধ্বংস করে দিয়েছে তাদের সাজানো-গোছানো সুখের সংসার। আকস্মিক এক রাতে সশস্ত্র হায়ওয়ানের দল সবাইকে হাত-পা বেঁধে তার দুই যুবতী মেয়েকে নির্যাতন চালায়। সেই রাতের ভয়ানক দৃশ্য দেখে কখন যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে, সে নিজেও জানেনা। পরদিন সকালে জ্ঞান ফিরে দেখে একমাত্র বৃদ্ধা স্ত্রী ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। দুই ছেলেসহ পরিবারের সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। একই শিবিরে থাকা অলি উল্লাহ (মাদ্রাসা শিক্ষক) জানান। তার যুবক ছেলেসহ দুই যুবতী মেয়েকেও অত্যাচার করে হত্যা করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তাদের অভিযোগ, এরকম শত শত যুবতী নারীদের ধর্ষণের পর হত্যা করেছে মিয়ানমার সশস্ত্র বৌদ্ধরা। আব্দুল করিমের প্রশ্ন, এতগুলো মানুষকে কি কারণে হত্যা করা হলো? রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাড়ীঘর পুঁড়িয়ে দেয়াসহ জাগয়া-জমি কেন কেড়ে নেয়া হলো? আমরা নির্যাতিত রোহিঙ্গারা কখনো কি ন্যায়বিচার ও হারানো বাড়ীঘর ফিরে পাব? আমাদের জীবনে যা হারিয়েছি, তা হয়তো আর কোনদিন ফিরে আসবে না। কিন্তু কখনও’কি গণধর্ষণ ও গণহত্যাকারী মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যথাযথ বিচার হবে? মিয়ানমার ইতিমধ্যেই তাদের কয়েকজন দোষী সেনাদের ১০ বছর করে সাজা দেয়ার কথা গণমাধ্যামে প্রচার চালাচ্ছে। এটা সরকারি সশস্ত্রবাহিনীকে ব্যাপক হত্যাকা-ের অপরাধ থেকে দায়মুক্তি দেয়ার নতুন কৌশল। আন্তর্জাতিক আদালত ছাড়া গণহত্যা ও গণধর্ষণসহ জাতি হত্যার যথার্থ বিচার হতে পারে না। বৃদ্ধ আব্দুল করিম বলেন, মিয়ানমার সশস্ত্র সেনাদের হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে যাদের অপমৃত্যু হয়েছে। আল্লাহ্পাক যেন, তাদের জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন। আর আমরা যারা প্রাণে বেঁচে গিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সেই ভয়ানক ধর্ষণের দৃশ্য নিজ চোখে দেখেছি, মানসিক যন্ত্রণায় প্রতিদিনই হত্যার শিকার হচ্ছি। অলি উল্লাহ ও আব্দুল করিমের মতো লক্ষ লক্ষ নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের শান্তনা দেয়ার মতো ভাষা লেখকের নেই। তবে লেখক অবশ্যয় গণধর্ষণ ও গণহত্যাকারী মিয়ানমার সেনাবাহিনী, এবং তাদের আশ্রয়দাতা শাসকগোষ্ঠীর খুঁটির জোর কোথায়। তা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে পরবর্তীতে যুদ্ধ ও সংঘাত প্রতিরোধসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইন, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক অগ্রগতি এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৪৫ সালে মাত্র ৫১টি রাষ্ট্র নিয়ে জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। বর্তমান বিশ্বে অধিকাংশ রাষ্ট্রই জাতিসংঘের সদস্য। মিয়ানমার যেহেতু এই সংগঠনের সক্রিয় সদস্য, সেহেতু সেই দেশের সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা গণহত্যা, গণধর্ষণ ও ঢালাওভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় এই সংস্থাটির উপর বর্তায়। কিন্তু সংগঠনটির দায়িত্বশীল নেতারা ফাঁকা বুলি ছাড়া কেন যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে, তা নিয়ে মৌলিক কিছু বিষয় আলোচনা অপরিহার্য। জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শাখার মধ্যে সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদ অন্যতম।
সাধারণ পরিষদ: এটিই একমাত্র পরিষদ যেখানে জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত সকল রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। জাতিসংঘ সনদের ৯ থেকে ২২নং অনুচ্ছেদ পর্যন্ত সাধারণ পরিষদের গঠন, ক্ষমতা, কার্যাবলী ইত্যাদি নিয়ে বহু আলোচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি তুলে ধরা অত্যাবশ্যক। (ক) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বিতর্ক সভা হিসাবে বিশ্ব মতামত প্রকাশ করতে পারে। (খ) জাতিসংঘ সনদের অন্তর্ভুক্ত যে-কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তীতে বিভিন্ন শাখায় সুপারিশ করতে পারে। (গ) এ পরিষদ যে কোন সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক শান্তি ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদে সুপারিশ করতে পারে। (ঘ) সাধারণ পরিষদ জাতিসংঘের বার্ষিক আয়-ব্যয় বাজেট অনুমোদনসহ প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্র জাতিসংঘ পরিচালনার জন্য যতটুকু অর্থ প্রদান করবে, তাও সিদ্ধান্ত গ্রহন করে থাকে।
নিরাপত্তা পরিষদ: আগেই বলেছি এটি জাতিসংঘের প্রধান শাখাগুলোর অন্যতম। আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এ পরিষদের দায়িত্ব। নিরাপত্তা পরিষদের শান্তি রক্ষা অপারেশন, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এবং নিরাপত্তা পরিষদ রেজুলেশনের মাধ্যমে সামরিক অভিযানের ক্ষমতা আছে। এটি জাতিসংঘের এমন একটি অঙ্গ, যেটি থেকে জারি করা রেজুলেশন সদস্য দেশগুলোর জন্য মানা বাধ্যতামূলক। স্থায়ী-অস্থায়ী ১৫ সদস্য নিয়ে গঠিত নিরাপত্তা পরিষদে- চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র স্থায়ী সদস্য। এরা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী পাঁচ মিত্রশক্তি ও ভেটো ক্ষমতার অধীশ্বর। ভেটো শব্দের অভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘মানিনা’।
উপরোল্লেখিত জাতিসংঘের দু’টি শাখার কার্যাবলী এবং ক্ষমতা পর্যালোচনা করলে ফলাফল যা দাঁড়ায়। যাদের টাকায় জাতিসংঘ চলে, অর্থাৎ “সাধারণ পরিষদ”। তারা শুধু জাতিসংঘ পরিচালনার জন্য বার্ষিক চাঁদা, আয়-ব্যয় বাজেট অনুমোদন, নিরাপত্তা পরিষদে সুপারিশ প্রেরণ ছাড়া কার্যনিষ্পত্তি ভুমিকা তাদের নেই। পক্ষান্তরে, “নিরাপত্তা পরিষদ” রেজুলেশনের মাধ্যমে যে কোন দেশের অভ্যন্তরে সরাসরি সামারিক অভিযান চালাতে পারে। তাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত প্রতিটি রাষ্ট্রই মানতে বাধ্য। তাছাড়া এ পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের স্পেশাল “ভেটো ক্ষমতা” থাকায় পুরো জাতিসংঘকেই বিব্রত অবস্থায় ফেলে দিতে পারে। এক কথায়, এই স্বার্থান্বেষণকারী নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যের মোড়লদের হাতে সারা বিশ্বের মানুষ বন্দি। তারা ভেটো ক্ষমতা বলে যখন যাকে ইচ্ছা, তখনই তাকে ভক্ষণ করতে পারে। আজ থেকে প্রায় ৭০বছর আগে গঠিত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বহু বিতর্কিত ভেটো ক্ষমতা এখন বিশ্ববাসির বিষবৃক্ষ। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও মিয়ানমারসহ যেসব দেশে নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিক হত্যাযজ্ঞের শিকার ও অভিবাসী হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। এর নেপথ্যে ভেটো রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার আধিপত্য ও ধনতৃষ্ণা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাক যুদ্ধে হাজার হাজার বেসামরিক নর-নারী নিহত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি। রাশিয়া ও চীনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতা ও ভেটো হস্তক্ষেপের কারণে গণধর্ষণ ও গণহত্যাকারী মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে যথার্থ শাস্তি দিতে পারছেনা জাতিসংঘ নামের সংস্থাটি। বর্তমান নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলো বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দেয়া’তো দুরের কথা। তারা নিজেরাই আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ভিয়েতনাম, ইরাক, সিরিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ গঠনের পর ধারাবাহিক ভেটো ক্ষমতার অপব্যবহার হয়ে আসছে। জাতিসংঘের সদস্য কোন রাষ্ট্রই সাধারণ পরিষদে “ভেটো ক্ষমতা” বাতিল বা সংস্কারের প্রস্তাব দেয়নি। মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনী রোহিঙ্গাদের গণহত্যাসহ নিপীড়নের পর বিশ্বব্যাপী ভেটো ক্ষমতার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে কয়েকটি রাষ্ট্র ছাড়া, সব রাষ্ট্রই রোহিঙ্গা গণহত্যাকারী মিয়ানমার সশস্ত্রবাহিনীসহ দোষী ব্যক্তিদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহনে মতামত দিয়েছে। কিন্তু রাশিয়া ও চীন মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বন করায় তা সম্ভব হয়নি। যার ফলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় ১২ লাখ বিপন্ন রোহিঙ্গা এখনো মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। তাদের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে (একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া) সঠিক ধারণা কেউ দিতে পারছে না। মিয়ানমার ছাড়াও যেসব দেশে শসস্ত্র বাহিনী কর্তৃক নিষ্পাপ শিশুসহ নিরপরাধ মানুষ হত্যার প্রতিযোগিতা চলছে। সেই সব অপরাধীদের মদদ ও সুরক্ষা দেয়ার পিছনে ভেটো রাষ্ট্রের মোড়লেরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার প্রমাণ এখন দৃশ্যমান। বর্তমান জাতিসংঘ বা রাষ্ট্র সঙ্ঘের সদস্য সংখ্যা- ১৯৩, এর মধ্যে ১৯২টি রাষ্ট্র যে কোন সিদ্ধান্তের বিষয়ে একতাবদ্ধ হলেও, মাত্র একটি ভেটো রাষ্ট্র ‘মানিনা’ বললেই সব পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্ত ভেস্তে যায়। এমনকি ভেটো ক্ষমতার অধিকারী ৪টি ভেটো রাষ্ট্রও একটি ভেটো রাষ্ট্রের কাছে জিম্মি। এটা পরাশক্তি ভেটো রাষ্ট্রসহ বিশ্বমোড়লদের ভেটোর লজ্জা নয় কি? এছাড়া যে কোন ধর্মীয় গ্রন্থ বা প্রচলিত আইন এই অসভ্য ভেটো সংস্কৃতি সমর্থন করে কিনা আমার জানা নেই। তবে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু জানি এবং বুঝি, তা হলো ভেটো ক্ষমতা বিপন্ন রোহিঙ্গা ও মানবতার শত্রু। ভেটো ক্ষমতা কোন অবস্থাতেই কেউ গ্রহনযোগ্য মনে করার আদর্শিক বা আইনগত যুক্তি নেই। লেখক চ্যালেঞ্জ করে বলছে, ভেটো ক্ষমতা যতদিন বহাল থাকবে। ততদিন বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকারের আশা করা বোকার স্বর্গে বসবাসের সমতুল্য। সুতরাং- মানব বিধ্বস্তি ভেটো ক্ষমতা বাতিলের পক্ষে সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব পাশ করা সময়ের দাবী। তাছাড়া জাতিসংঘ বা রাষ্ট্র সঙ্ঘকে যুগোপযোগী পুনংগঠন বা সংস্কার করা একান্তই প্রয়োজন। যাতে করে মানবাধিকার রক্ষায় সংস্থাটি যথাযথ কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রিয় পাঠক, গুটি কয়েক জ্ঞানপাপী শাসকগোষ্ঠির ক্ষমতার লড়াই ও ধনতৃষ্ণার কারণে আজ গোটা বিশ্ব সংকটাপন্ন। এই সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হলে, আমাদেরকে নতুন কিছু ভাবতে হবে। তামাম দুনিয়ার নিরপরাধ মানুষের সুখ-শান্তি ও জান-মালের নিরাপত্তার স্বার্থে, ‘বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদ’ গঠনের প্রস্তাব করছি। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের আদলে কিভাবে ‘বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদ’ গঠন করা যায়। তা নিয়ে প্রত্যেক দেশের জ্ঞানীগুণীদের সমন্বয়ে সাধারণ পরিষদে ব্যাপক আলোচনা হতে পারে। বিশ্ব মানবের নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠাসহ উন্নত বিশ্বের স্বপ্ন সর্ব ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে চাইলে, কোন না কোন শ্রেনীর মানুষের ওপর আস্থা রাখতেই হবে। পৃথিবীর প্রত্যেক দেশে অনেকাংশে মান্যবর বিচারপতিরাই সবচেয়ে বেশী গ্রহনযোগ্য, ন্যায়পরায়ণ ও বিশ্বাসযোগ্য বলে সমাদৃত। বিধায়, জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যেক দেশের ৩জন করে বিচারপতির সমন্বয়ে একটি কার্যকর ‘বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদ’ গঠন করা যায়। আন্তর্জাতিক আদালত, জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা কমিশন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলো বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদ’র নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে। এছাড়াও ২/১টি বিষয় অবতারণ অতীব জরুরী। প্রসঙ্গ-১.(ক) যুদ্ধে যারা জেতে তাদের ভাবা হয়না যুদ্ধাপরাধী। যারা হেরে যায় কেবল তাদেরই বিচার হতে দেখা যায়। এর ফলে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো খামাখা ইতরামি করে যুদ্ধে জড়াতে চায়। ভবিষ্যতে ‘বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদ’ ও সাধারণ পরিষদের অনুমোদন ব্যতীত কোন দেশ বোমা হামলা বা সামরিক অভিযান বা যুদ্ধে জড়াতে পারবে না। (খ) শাসকগোষ্ঠী বা কোন জাতিগোষ্ঠী বা কোন স্বার্থন্বেষী মহল কর্তৃক ঢালাওভাবে কোন দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে ‘বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদ’ বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। প্রয়োজনে যেসব দেশে ঢালাওভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। সেসব দেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সহায়তায় দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের ক্ষমতাও তাদের থাকতে পারে। (গ) আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদের প্রত্যেক সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে দুই তৃতীয়াংশ ভোটে প্রস্তাবটি পাশ হতে হবে, নচেৎ না। (ঘ) বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্ত প্রতিটি রাষ্ট্রকেই মানতে হবে। যদি কোন দেশের শাসকগোষ্ঠী ‘বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদ’ ও সাধারণ পরিষদের অবাধ্য হয়। তাহলে বিশেষ প্রয়োজনে সামরিক হস্তক্ষেপের ক্ষমতাও তাদের হাতে ন্যাস্ত থাকবে! (ঙ) মহামান্য বিচারপতিরা যদি মনে করেন, বিভিন্ন দেশের হতদরিদ্র মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে অর্থের প্রয়োজন। তাহলে জাতিসংঘ সদস্য রাষ্টগুলো থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী চাঁদা নির্ধারণসহ অর্থ তহবিল সংগ্রহের ক্ষমতাও তাদের এখতিয়ারে থাকতে পারে। তবে যে-কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ও বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদ সমন্বয় সাধনের বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। আজকের সংক্ষিপ্ত লেখায় ‘বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদ’ গঠন নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। পরবর্তী লেখায় আরও কিছু সংযোজন করার চেষ্টা করব। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে কোন রাষ্ট্রের বীরপুরুষ মানব বিধ্বস্তি ভেটো ক্ষমতা বাতিল ও মাননীয় বিচারপতিদের সমন্বয়ে ‘বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদ’ গঠনের প্রস্তাবটি উপাস্থাপন করবেন কিনা জানিনা। আমার বিশ্বাস, সাধারণ পরিষদে বিষয়টি আলোচনা হলে মানবজাতির কল্যাণের স্বার্থে, অধিকাংশ দেশ সম্মতিজ্ঞাপন করতে পারে। কিন্তু সেখানেও ভেটো রাষ্ট্রগুলো বাধা হয়ে দাঁড়াবে না, তার নিশ্চিয়তা দেয়া মুশকিল। তবে সব বাধা অতিক্রম করেই সাধারণ পরিষদকে মানবাধিকারের আওয়াজ তুলতে হবে। প্রয়োজনে বিশ্ব জনমত জরিপ করা যেতে পারে। তাছাড়া পরাশক্তি ভেটো রাষ্ট্রগুলোর নেতাদেরও বোধোদয় হওয়া উচিত। ভেটোর অন্তরালে ক্ষতবিক্ষত কোটি কোটি মানুষের অভিশাপে তারাও একদিন শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং- সময় থাকতে জাতিসংঘকে যুগোপযোগী সংস্কারের উদ্যোগ নিলে ভেটো ক্ষমতার মালিকদের সম্মান কমবে না, বরং বাড়বে। জাতিসংঘের মতো এতবড় প্রতিষ্ঠান সংস্কারসহ বিচারপতিদের নিয়ে বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদ গঠনের প্রস্তাব উপস্থাপন করা চাট্টিখানি কথা নয়। বিষয়টি লিখতে গিয়ে বহু আলোচনা-সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। সমালোচনাকারীদের পিছনে রেখে আলোচনার বিষয়ে কাজ করাই হচ্ছে, একজন সৎসাহসী লেখকের গুণ বা বৈশিষ্ট্য। এর পরও একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। লেখক ওয়াকিবহাল, বিশাল সমুদ্রে বিন্দুপাত হলে যেমন গণনার মধ্যে আসেনা। তেমনি যেখানে প্রয়োজন বিপুল পরিমানের সেখানে অতি অল্প সরবরাহ মূল্যহীন। তা সত্ত্বেও, বিন্দু থেকে যেমন সিন্ধুর জন্ম হয়। তেমনি অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও আত্মবিশ্বাসই লেখকের অনুপ্রেরণার উৎস। যাদের ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান আছে। তাদের অস্বীকার করার জো নেই। পৃথিবী সৃষ্টিলগ্ন থেকে যুগে যুগে মানবজাতির প্রয়োজনে বহু ন্যায়পরায়ণ শাসক আইন-কানুন পরিবর্তন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে। আবার পথভ্রষ্ট কিছু জ্ঞানপ্যাপী শাসক ক্ষমতা চিরস্থায়ী ও অঢেল সম্পদের বশবর্তী হয়ে প্রজাভক্ষণ শাসন চালিয়েছে। তাদের অপশাসন যখনই পুরো জাতিকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। তখনই পৃথিবীতে কিছু আদর্শবাদ নির্লোভ আত্মত্যাগী মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। তারা সময়োপযোগী বিভিন্ন দিক-নির্দেশনাসহ শাসকগোষ্ঠীর অপশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। মানবজাতির শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য নিজ স্বত্বত্যাগ করে গণমানুষের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছে। তাদের জ্ঞানগর্ভভিত্তিক চিন্তা-চেতনা সমগ্র মানবজাতিকে যুগোপযোগী সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অনুপ্রাণিত করেছে। যেসব মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বিশ্ববাসী আজ কিছুটা হলেও স্বস্তিতে। সেই সৌভাগ্যবান বীর মানুষদের ইতিহাস বর্তমান স্বার্থপরায়ণ ও হিংসাত্মক সমাজকে বদলে দিতে ক্ষমতাপরায়ণ শাসকদের যেন কিছুটা হলেও অনুপ্রাণিত করে। এই প্রত্যাশা রেখেই পুনরায় “ভেটো ক্ষমতা” বাতিল ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে যুগোপযোগী সংস্কারের প্রস্তাবটি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। এবং ‘বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদ’ গঠনের প্রস্তাবটি যেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আলোচনায় স্থান পায়, এটাই লেখকের শেষ আবেদন। ‘বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদ’ গঠন সভ্যযুগের বাস্তব সূচনা: আজ থেকে প্রক্রিয়া শুরু।
লেখক: কলামিস্ট, সাংবাদিক ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, দৈনিক কক্সবাজার বাণী।
মোবাইল- ০১৫৫৮৩৬৩৩৪৩,