সিবিএন ডেস্ক: কয়েকদিনের ছাত্র আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি চাকুরিতে সব ধরনের কোটা বাতিলের ঘোষণা দেয়ার পর আজই এ বিষয়ে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানানোর কথা রয়েছে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের।
আন্দোলনকারীরা চাইছিলো চাকুরিতে কোটার পরিমাণ কমিয়ে দশ শতাংশে আনা হোক কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সব ধরনের কোটাই বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জুর মতে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে।
“একই সাথে আন্দোলনকারীরা বিস্মিত এবং কিছু বিভ্রান্তির মধ্যেও পড়েছে”।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিশ্লেষণ করে মিস্টার হোসেন বলেন একদিকে সকল নাগরিকদের মধ্যে সমতা আবার অনগ্রসরদের জন্য ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে।
“সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ভিন্ন ব্যবস্থার কথা বলেছেন। এখন দেখার বিষয় হবে সরকার কিভাবে সেটি বাস্তবায়ন করে”।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কোন রাজনৈতিক ঝুঁকি নিলেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ঝুঁকি একটা বাড়লো সেটি হলো- মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে- কারণ আন্দোলনের দাবি ছিলো এ কোটা কমানো কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের নানা সংগঠনের পক্ষ থেকেও পাল্টা দাবি আছে”।
মোজাম্মেল হোসেন বলেন, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নিয়েছিলো সেই ছাত্রলীগ আনন্দ মিছিল করেছে অর্থাৎ ক্যাম্পাসটা আবার ছাত্রলীগের জমায়েতে নিয়ে আসা- প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় এ তাৎক্ষনিক কাজটা হয়েছে।
তবে বুধবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরপরই ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারীদের একজন জসিম উদ্দিন বিবিসিকে বলেন, “আমরা কোটা বাতিলের জন্য আন্দোলন করিনি, আমরা করেছি কোটা সংস্কারের জন্য”।
আরেকজন নারী শিক্ষার্থী বলেন, “কোটা বিলুপ্তির দাবি আমরা কখনোই করিনি”।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক এম এম আকাশ বিবিসিকে বলেন প্রধানমন্ত্রী পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে শল্য চিকিৎসার পথ বেছে নিয়েছেন।
“প্রধানমন্ত্রী পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে যে রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছেন সেটি সংকটকে আরও অবনতির দিকে যাওয়া থেকে ঠেকালো”।
আন্দোলন নিয়ে কী ঘটছে নেপথ্যে
একটি অরাজনৈতিক ইস্যুর আন্দোলনে ছাত্ররা কোন রাজনৈতিক নেতার ছবি নিয়ে মিছিল করছেন, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে এমন নজির সম্ভবত এটাই প্রথম।
গত ররোববার ঢাকার শাহবাগে ছাত্রদের যে বড় মিছিলটি সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার দাবি করছিল, তাতে অনেকের হাতেই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা এবং প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি।
শুধু তাই নয়, আন্দোলনকারীদের মুখে শোনা যাচ্ছিল ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান। যেটি আসলে সচরাচর বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের অনুসারী সংগঠনগুলোর সভা-সমাবেশেই শোনা যায়।
কিন্তু দুদিন পরে সোমবার পার্লামেন্টে সরকারের কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরি খুবই কড়া ভাষায় এই আন্দোলনকারীদের সমালোচনা করেন, এর পেছনে ‘জামায়াত-শিবির স্বাধীনতা বিরোধীদের’ এজেন্টরা ইন্ধন দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন।
তাঁর মন্তব্য আন্দোলনকারীদের এতটাই ক্ষুব্ধ করেছে যে, তারা মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটার মধ্যে মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরিকে ক্ষমা চাওয়ার সময় বেঁধে দিয়েছেন। নইলে তাদের ‘স্থগিত রাখা’ আন্দোলন আবার শুরু হবে বলে হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠার পর সরকার যেমন এই আন্দোলনের পেছনে রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি আছে বলে অভিযোগ করছে, তেমনি আন্দোলনকারীরা পাল্টা অভিযোগ করছেন যে তাদের আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য নানা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে।
ইতোমধ্যে সরকারের সঙ্গে এক আপোস আলোচনার জের ধরে বিভক্ত হয়ে গেছে আন্দোলনের নেতৃত্ব।
আন্দোলনের নেতৃত্বে আসলে কারা?
সরকারি চাকরিতে কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু থেকে যারা সংগঠিত করেছেন, তাদের একজন নুরুল হক। তিনি বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি হতে এই সংগঠনের ব্যানারেই চলছে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন।
যারা এই আন্দোলনের মূল সংগঠক, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কী?
নুরুল হক জানালেন, তাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বা আছেন, কিন্তু আন্দোলনটি সম্পূর্ণই অরাজনৈতিক।
“আমি আগে ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, এখন কোন দলের সঙ্গে নেই। অন্য অনেকে হয়তো কোন দলের সঙ্গে থাকতে পারেন। কিন্তু আমাদের আন্দোলন একেবারেই অরাজনৈতিক। এর পেছনে কোন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র নেই। যদি থাকতো আমরা অনেক আগেই সহিংসতার পথ বেছে নিতে পারতাম। কিন্তু আমরা শুরু থেকে একেবারে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্দোলন করেছি।”
নুরুল হক বললেন, যারা এই আন্দোলনের পেছনে জামায়াত-শিবিরের ষড়যন্ত্র খুঁজছেন, তারা আসলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছেন।
কিন্তু তাদের আন্দোলন যদি এতটাই অরাজনৈতিক হবে, তাহলে মিছিলে কেন তারা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বহন করছেন?
“বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন বাংলাদেশের স্থপতি। এটা যদি কেউ সামনা-সামনি স্বীকার নাও করে, মনে-প্রাণে কিন্তু বিশ্বাস করে। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তিনি বৈষম্যমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন, আমরাও বৈষম্য দূর করার আন্দোলন করছি। সেজন্যেই আমরা তাঁর ছবি নিয়ে মিছিল করেছি।”
কোটা সংস্কারের আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তাদের মনে কি এমন আশংকা আগে থেকেই ছিল যে এই আন্দোলনকে সরকার বিরোধী আন্দোলন বলে চিহ্নিত করা হতে পারে? সেজন্যেই তারা সচেতনভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ব্যবহার করেছেন? কিংবা ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান দিয়েছেন?
নুরুল হক তা স্বীকার করলেন না। তবে তিনি জানালেন, এই ছবি বহনের সিদ্ধান্তটি তাদের সংগঠনের বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবেই নেয়া হয়েছিল।
তবে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের এক ছাত্রী তাসনীম জাহান বললেন, শুরু থেকেই তাদের একটা সচেতন চেষ্টা ছিল এই আন্দোলনকে যেন কোনভাবেই সরকার বিরোধী বলে চিহ্ণিত করা না যায়। সেই চিন্তা এর পেছনে কাজ করেছে।
“আমরা কোনভাবেই সরকার বিরোধী নই। আমরা সরকারের প্রত্যেকটি সিদ্ধান্তকে সন্মান জানাই। অথচ মিডিয়া এটা এমনভাবে দেখানো হচ্ছিল যে আমরা একটা সরকার বিরোধী আন্দোলন করছি। এটা আসলে ভুল।”
কিন্তু আন্দোলনকারীরা যত চেষ্টাই করুন, তারা কি সরকারকে আশ্বস্ত করতে পেরেছেন যে এই আন্দোলন আসলে সরকারের বিরুদ্ধে নয় বা এর পেছনে কোন রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি নেই?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আশরাফুল আলম খোকন সোমবার বিকেলে ফেসবুকে যে স্ট্যাটাস দেন, তাতে স্পষ্ট যে, তারা এই আন্দোলনের পেছনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র দেখতে পাচ্ছেন।
তিনি লিখেন, “আন্দোলন করতে যারা এসেছে অধিকাংশের হাতেই দেখলাম বঙ্গবন্ধুর ছবি। সাধারণত আন্দোলন সংগ্রাম শ্লোগানে বঙ্গবন্ধুর হরেক রকমের ছবি নেতা কর্মীরা ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু অবাক করা বিষয় এইখানে সবগুলো ছবি একই রকম অর্থাৎ একই ছবি। রাজশাহী ,ময়মনসিংহ, ঢাকা সবখানে সরকারি অফিসে ব্যবহৃত ছবিগুলোই ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ ছবিগুলোর সরবরাহকারী গোষ্ঠী একটাই।”
আওয়ামী লীগের একেবারে উচ্চ পর্যায় থেকে ছাত্রলীগের নেতারাও এই আন্দোলনের পেছনে এখন একই ধরণের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন। ‘জামায়াত-শিবির’ এর পেছনে রয়েছে বলে অভিযোগ করছেন।
কিন্তু আন্দোলনের নেতা নুরুল হক কিংবা সংগঠক তাসনীম জাহান সরকার বা তাদের সমর্থকদের এরকম বক্তব্যে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করলেন।
তাসনীম জাহানের ভাষায়, “মতিয়া চৌধুরির মতো একজন নেত্রী এই কথা বলে আসলে নিজেকেই ছোট করলেন। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা, আর উনি আমাকে রাজাকার বলে দিলেন, এটা তো ঠিক হলো না। একজন মন্ত্রীর কাছ থেকে আমরা এটা আশা করি না।”
নুরুল হক বললেন, তাদের আন্দোলনে অনেক দলের নেতা-কর্মীরাই আছেন। কিন্তু তারা সচেতনভাবে একটি চেষ্টাই করেছেন, যাতে কোনভাবেই জামায়াত-শিবিরের কেউ এই আন্দোলনে থাকতে না পারে। একই সঙ্গে বামপন্থীরাও যাতে এত যোগ দিতে না পারে। “এই দুটি গোষ্ঠীকে আমরা এড়িয়ে চলতে চেয়েছি।”
নেতৃত্ব দখল নিয়ে দ্বন্দ্ব
কিন্তু সোমবার সরকারের এক মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দখলে রাখার জন্য দুটি গ্রুপের যে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে, সেখানেও উভয় গ্রুপ পরস্পরের বিরুদ্ধে ‘রাজনীতি’ করার অভিযোগ করছেন।
সোমবার সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বিশ জন ছাত্র প্রতিনিধি দেখা করতে যান, তারা ফিরে এসে আন্দোলন এক মাসের জন্য স্থগিত রাখার ঘোষণা দেন। সাংবাদিকদের সামনে ঘোষণাটি যিনি দিয়েছিলেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগের একজন নেতা।
আন্দোলনের নেতৃত্বে কার্যত ছাত্রলীগ ‘হাইজ্যাক’ করেছে কীনা সে প্রশ্ন তুলতে থাকেন অনেকে।
ছাত্র প্রতিনিধিরা যখন টিএসসির মোড়ে এসে সমাবেশে তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানান, তখন সেটি চিৎকার করে ‘না’ ‘না’ ধ্বনি দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেন বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা।
নুরুল হক অভিযোগ করছেন, কিছু বামপন্থী আসলে এই আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যেতে চাইছে। তারা এর সুযোগ নিতে চাইছে।
তবে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী বলছেন, এই আন্দোলনে তারা নৈতিক সমর্থন দিলেও এটিকে তারা সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন হিসেবে দেখেন। তারা সচেতনভাবেই এই আন্দোলনের মঞ্চ থেকে দূরে থাকছেন।
আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছেন, তারা অবশ্য দাবি করে যাচ্ছেন যে তাদের আন্দোলন অরাজনৈতিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্সের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মোহাম্মদ আরিফ হোসেন বললেন, “সরকার, বিরোধী দল অনেকেই আমাদের কাছে এসেছে, যারা এটাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমরা বলতে চাই, আমরা ছাত্ররা একটা দাবিতে রাস্তায় নেমেছি, এটা কোনভাবেই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র হতে পারে না। গুটিকয় হয়তো এর মধ্যে থাকতে পারে। কিন্তু আমরা সেটা দেখছি।”
শীর্ষনিউজ
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।