ডেস্ক নিউজ:
শীত যেতে না যেতেই ঢাকায় হঠাৎ করে মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে। এরইমধ্যে গত সোমবার রাতে বৃষ্টি হয়েছে। মশা বৃদ্ধি ও বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে জনমনে গত বছরের চিকুনগুনিয়া রোগের ভয়াবহতা ও আতঙ্ক ফিরে এসেছে। তাই মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু ইত্যাদি প্রতিরোধে মশা নিয়ন্ত্রণ ও সতর্কতার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা নিজেদের বাড়ি ও এর আশপাশ, অফিস নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং শহর পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থার দায়িত্বকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
বুধবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) উদ্যোগে মশক নিধন অভিযান শুরু হয়েছে। ডিএসসিসির ৫৭টি ওয়ার্ডে ২৭৮ জন মশক নিধনকর্মী ৩১৮টি ফগার মেশিনের সাহায্যে মশক নিধনে কাজ করছেন।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ৯ এপ্রিল থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে প্রতিষ্ঠানটিতে রক্ত পরীক্ষায় এক হাজার ৩ জন চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ১২ মে থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চার হাজার ৮৬৪ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে দুই হাজার ৩৪৮ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দুই হাজার ৫৫৮ জন, শহীদ মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৯ জন, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৩১ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৯৩ জন, ইউনাইটেড হাসপাতালে ৫২২ জন, অ্যাপোলো হাসপাতালে ১৯৭ জন, ডেল্টা হাসপাতালে ২৫৫ জন এবং অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতাল/চিকিৎসকের কাছে ৫৪৭ জন, আইইডিসিআরে দুই হাজার ২৯০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। সবমিলিয়ে ১৩ হাজার ৮১৪ জন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হন।
এছাড়া, দেশের ১৭টি জেলা থেকে ১৮৫ জনের চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়ার পর ৫২ জনকে রোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ঢাকা থেকে ওইসব জেলায় গেছেন এবং পোস্ট চিকুনগুনিয়ায় আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘মশা বাড়লে মশাবাহিত রোগ বাড়ার ভয় তো আছেই। মশা বাড়লে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এগুলো বাড়ে। তবে একবার আক্রান্ত হলে এই রোগ সাধারণত দ্বিতীয়বার হয় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই রোগ প্রতিরোধে মশা নিধন করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কারণ, গতবারের মতো চিকুনগুনিয়া হয়ে গেলে হৈ-হুল্লোড় হবে। মশা যেন না কামড়ায় তা খেয়াল রাখতে হবে। নিজের ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখা, ঘরের আনাচে কানাচে, আঙিনা বা বারান্দায় ফুলের টব থাকে, ঘরের পাশে যেন কোনও বালতির মধ্যে পানি না থাকে। নিজের ঘরের প্রটেকশন নিজেকেই নিতে হবে। শোয়ার সময় মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে, এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যেন মশা না কামড়ায়। শিশুরা যারা হাফপ্যান্ট পরে ঘুরে, তারা ফুলপ্যান্ট পরবে। মোটকথা, মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য যা যা করা দরকার, তা করতে হবে। কর্তৃপক্ষকে ঘরের বাইরে মশা মারার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘চিকুনগুনিয়া ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে মশার মাধ্যমে বিশেষ করে এডিস ইজেপ্টি ও এডিস অ্যালবোপিকটাস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীর মধ্যে সাধারণত উচ্চমাত্রার জ্বর ও গিঁটে ব্যথা দেখা যায়। এছাড়াও মাথাব্যথা, মাংশপেশীতে ব্যথা, গিঁট ফুলে যাওয়া অথবা দানা দানা র্যাশ দেখা যেতে পারে। চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের কোনও ভ্যাকসিন নেই। লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। শুধুমাত্র জনসচেতনতা ও মশক নিয়ন্ত্রণই পারে চিকুনগুনিয়ার বিস্তার রোধ করতে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়া সাধারণত বর্ষাকালে হয়। কিন্তু এখন তো আর বর্ষাকাল বলে আলাদা কিছু নেই। যেহেতু সারাবছর বৃষ্টি হচ্ছে, তাই এডিস মশা বিস্তারের সুযোগও তৈরি হচ্ছে। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে এমন কোনও মাস নেই যে মাসে চিকুনগুনিয়া হয়নি! এখন যেহেতু বৃষ্টি হয়ে গেল, তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’ এ বছর সারাদেশে এই রোগ ছড়িয়ে পড়লে তা ভয়াবহ হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিএসএমএমইউ’র পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহ আল হারুণ বলেন, ‘আমাদের এখানে চিকুনগুনিয়া বা মশাবাহিত রোগের জন্য আলাদা কোনও ক্লিনিক নেই। এই ধরনের রোগের চিকিৎসায় আমরা সবসময় প্রস্তুত, এই ধরনের ঘটনা ঘটলে আমরা সাপোর্ট দেওয়ার মতো অবস্থা রাখি।’
ঢাকা জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. এহসানুল করিম বলেন, ‘মশাবাহিত রোগ থেকে রক্ষা পেতে মশা নিয়ন্ত্রণের কাজ সিটি করপোরেশনের। আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বারবার বিভিন্ন মিটিং করে মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য বলা হচ্ছে। আমরা তাদের বলেছি, মশা নিয়ন্ত্রণ করাটা আপনাদের দায়িত্ব। এটি করা দরকার। তা না হলে গতবারের মতো পরিস্থিতি হতে পারে। মশা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই চিকুনগুনিয়াসহ মশাবাহিত রোগগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশন সহযোগিতা করতে পারে। এরপরও যদি কেউ এই রোগে আক্রান্ত হয় তখন তাকে সারিয়ে তোলা আমাদের দায়িত্ব। কেউ আক্রান্ত হলে তাকে চিকিৎসা দেওয়ার মতো প্রস্তুতি, সেই ধরনের ওষুধ আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে।’