আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সমন্বয়কারী সংস্থা ও রাখাইনের স্থানীয় প্রশাসনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মিয়ানমারের স্থানীয় দৈনিক দ্য ইরাবতি বিশেষ এক প্রতিবেদনে শনিবার এ তথ্য জানিয়েছে।
রাখাইনের মংডু, বুথিডং ও রাথেডং শহরের সাধারণ প্রশাসনিক বিভাগ (জিএডি) ও জাতিসংঘের শরণার্থী কল্যাণবিষয়ক সমন্বয়কারী সংস্থা ইউএনওসিএইচএ’র সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণে রাখাইনে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের পরিসংখ্যান তৈরি করেছে ইরাবতি। মিয়ানমারের সেনা নিয়ন্ত্রিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে জিএডি। স্থানীয় প্রশাসনের তৈরিকৃত রাখাইনের রোহিঙ্গা পরিসংখ্যানে ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত হিসেব রাখা হয়েছে।
ইউএনওসিএইচএ বলছে, গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে নতুন করে ৬ লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন করা হয়েছে। এছাড়া মিয়ানমারে সহিংসতার হাত থেকে বাঁচতে গত তিন দশকে প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়েছে। এ রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে বসবাস করছে।
রাখাইনে রয়েছে মাত্র ৭৯ হাজার রোহিঙ্গা
মংডু, বুথিডং ও রাথেডং শহরের সাধারণ প্রশাসনিক বিভাগ (জিএডি) বলছে, সর্বশেষ সঙ্কট শুরুর আগে রাখাইনে রোহিঙ্গা ছিল ৭ লাখ ৬৭ হাজার ৩৮ জন। মংডু জেলার জিএডি’র জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেছেন, রোহিঙ্গা ব্যাপারে এ পরিসংখ্যান ২০১৬ সালে সংগ্রহ করা হয়েছিল। গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি না থাকায় মংডুর এই কর্মকর্তা নাম প্রকাশে রাজি হননি।
জিএডি ও ইউএনওসিএইচএ’র রোহিঙ্গা পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রাখাইনের প্রায় ৯০ শতাংশ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়েছে। এছাড়া পশ্চিম মিয়ানমারের তিনটি শহরে বর্তমানে রয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ (৭৯ হাজার ৩৮ জন) রোহিঙ্গা।
তবে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা যে ৯০ শতাংশ রোহিঙ্গার পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে; তার মধ্যে নিহত, নিখোঁজ অথবা গ্রেতারকৃতদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এছাড়া দেশটির সেনা অথবা নিরাপত্তাবাহিনীর অভিযানে অভ্যন্তরীণ বাস্ত্যুচুত, নিহত রোহিঙ্গা, আহত হিন্দু অথবা রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর মানুষকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি এ পরিসংখ্যানে।
গত বছরের ৩১ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনী ঘোষণা দেয়, তারা বিদ্রোহীগোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সন্দেহভাজন ৩৭০ সদস্যকে হত্যা করেছে।
রাখাইনের সাধারণ প্রশাসনিক বিভাগের (জিএডি) পরিসংখ্যান বলছে, ‘মডু ও বুথিডংয়ের মোট জনগোষ্ঠীর যথাক্রমে ৯৩ ও ৮৪ শতাংশ রোহিঙ্গা। তবে রাথেডং শহরে মাত্র ৬ শতাংশ রোহিঙ্গার বাস।
রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলায় মংডু জেলার উপজাতি গোষ্ঠী ম্রো, থেট, হিন্দুসহ দেইঙ্গিত আরাকানিদের প্রায় ৩০ হাজার সদস্য গৃহহীন হয়েছে। তবে বৌদ্ধসহ বাস্ত্যুচুত অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা ইতোমধ্যে মংডু শহরে ফিরে গেছে। অন্যদিকে, বাস্ত্যুচুত হিন্দুরা এখনো সরকারি পুনর্বাসনের অপেক্ষায় রয়েছে।
পরিচয়হীন রোহিঙ্গারা
জিএডি’র প্রতিবেদনে বাঙালি অথবা রোহিঙ্গা শব্দ দুটির কোনোটিই ব্যবহার করা হয়নি। এমনকি প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের রাখাইনের সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী হিসেবেও উল্লেখ করেনি রাখাইনের এ স্থানীয় প্রশাসন। ২০১৬ সালে দেশটির নেত্রী অং সান সু চি রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের প্রতি আহ্বান জানান।
সু চির আহ্বানের পর জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান নেতৃত্বাধীন রাখাইনের অ্যাডভাইসরি কমিশনের প্রতিবেদনেও রোহিঙ্গা শব্দটি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়।
জিএডি’র প্রতিবেদনে রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ‘বিদেশি’ এবং ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এছাড়া তাদের বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে পাড়ি জমানো অবৈধ অভিবাসী বলে চিহ্নিত করা হয়। মংডু এবং বুথিডংয়ের জিএডির কর্মকর্তারা ‘বাংলাদেশি’ বলে ‘রোহিঙ্গা’ জনগোষ্ঠীকে নির্দেশ করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন।
গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে মসজিদ
মংডু শহরে প্রায় ৮৩৬টি মুসলিম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাদরাসা এবং মসজিদ রয়েছে কি-না তা পরিষ্কার করেনি জিএডি। অন্যদিকে সেখানে বৌদ্ধদের ৮৪টি আশ্রম, ৬১টি প্যাগোডা এবং মন্দির রয়েছে।
এছাড়া বুথিডংয়ে মুসলমানদের ৪৪২টি, রাথেডংয়ে ৮৭টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে এ দুই শহরে বৌদ্ধদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫ শতাধিক। মংডু জেলায় হিন্দুদের ১৭টি মন্দির ও খ্রিষ্টানদের একটি চার্চ রয়েছে।
বিশ্বাস নেই কারো ওপর
গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করেছেন মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী লে. জেনারেল কিয়াও সোয়ে। বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিকভাবে তার হাতে ৮ হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার তালিকা তুলে দিয়েছে; যাদেরকে ফেরত নেয়া হতে পারে। তবে এ তালিকায় আরসার কোনো সদস্য আছে কি-না তা শনাক্ত করতে চিরুনি চালাচ্ছে মিয়ানমার সরকার।
বিপরীতে রাথেডং এবং বুথিডংয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো লড়াই চলছে। মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারির শুরুর দিকে থেকে গত ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মংডুর দক্ষিণাঞ্চলে নতুন করে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৩ হাজার ২০৬ জন। এছাড়া সমুদ্রের পাশে অপেক্ষা করছে আরো ৮০৪ জন।
রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী ঢল অব্যাহত রয়েছে; তারপরও রাখাইনের কিছু কিছু রোহিঙ্গা সেখানে অবস্থান করছেন। আব্দুল ওয়াহিদ তাদেরই একজন। রাখাইনের দুস্কৃতিকারীদের আগুনে তার বাড়ি-ঘর পুড়ে যাওয়ার পর বুথিডংয়ের দু ওও থ্যা মা গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। সরকারের তৈরি নতুন প্রকল্পে পুনর্বাসন মিলবে এমন আশায় এখনো সেখানে রয়েছেন এ রোহিঙ্গা।
তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাসঘাতক নই এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রাথেডংয়ে বসবাস করছি। আমরা নিজেদের গ্রামে ফিরে যেতে চাই।’
তার মতো আরো ১৬০ রোহিঙ্গা দু ওও থ্যা মা গ্রামে বাঁচার লড়াই করছেন। গ্রামটিতে ৭০০ বাড়ি-ঘর রয়েছে। গত কয়েকমাসে সেখানে নতুন করে আরো প্রায় ৪০০ রোহিঙ্গা পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। আব্দুল ওয়াহিদ বলছেন, তারা ছয়মাসে মাত্র দু’বার খাদ্য সহায়তা পান। এর মধ্যে একবার পান আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা রেডক্রস ও অন্যবার স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে।
বাঁচার আকুতি জানিয়ে রাখাইনের বাস্ত্যুচুত আব্দুল ওয়াহিদ নামের এ রোহিঙ্গা বলেন, ‘অামরা এখানে খুবই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। আপনি কি দয়া করে কর্তৃপক্ষকে একটু জানাবেন?
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।