মো. নুরুল করিম আরমান, লামা:
নারী মানে কেনা গোলাম। নারী যেন অন্যের করুনার পাত্র। নারীর প্রতি সমাজের এমন দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর পাশাপাশি ভাগ্যোন্নয়নে ‘নব জাগরণ মহিলা উন্নয়ন সমিতি’ মাধ্যমে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বান্দরবানের লামা উপজেলার নারীনেত্রী ফাতেমা পারুল। অসহায়, দরিদ্র, স্বামী পরিত্যক্ত, বিধবা, অস্বচ্ছল পরিবারের নারীদের স্বপ্নও দেখান তিনি। আবার এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলস কাজও করছেন এ নারী উদ্যোক্তা। সেলাই কাজ, পুতির তৈরি টিস্যু বক্স, নকশি কাঁথা, বল্ক-বাটিক, বাঁশ-বেত ও বিভিন্ন ফুলের টপ তৈরী নারীর ভাগ্য বদলের হাতিয়ার তার। ফাতেমা পারুলের মহতি উদ্যোগের কারণে এখন সমিতির প্রায় সদস্য আতœ কর্মসংস্থানের পথ খুঁজে পেয়েছে। অনেকে এখানের আয় দিয়ে সংসার চালাচ্ছে তারা।
ফাতেমা পারুল ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারী বান্দরবানের লামা পৌরসভার চাম্পাতলী গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। বাবা মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক ও মা আনোয়ারা বেগম। এক ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ১৯৯০ সালে লামা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা পাশের পর আর পড়ালেখা করার সৌভাগ্য হয়নি ফাতেমা পারুলের। ২০ বছর বয়সে পশ্চিম রাজবাড়ী আবদুল আজিজের সঙ্গে তাকে বিয়ে দেন মা-বাবা। স্বামী আবদুল আজিজ বাংলাদেশ আনসার ব্যাটালিয়নের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। বর্তমানে স্বামী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। বড় ছেলে আবদুল কাদের রাজু বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত আছেন। ছোট ছেলে তারিকুল ইসলাম মাতামুহুরী ডিগ্রী কলেজে এইচএসসিতে অধ্যয়নরত। মেয়ে খাদিজা আক্তার সীমুকে বিয়ে দেন। বর্তমানে তিনি বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের একজন সদস্য। রাজনৈতিক জীবনে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের উপজেলা সভানেত্রী। ২০১৭ সালে অর্থনৈতিকভাবে সফল নারী হওয়ায় উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর তাকে অনুুষ্ঠানিকভাবে জয়িতা সম্মাননা প্রদান করেন।
সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে আশপাশের অবহেলিত পিঁছিয়ে পড়া দরিদ্র নারীদের নিয়ে কিছু একটা করার কথা ভাবতেন ফাতেমা পারুল। তখন থেকে বিভিন্নভাবে অসহায় নারীদের সহায়তাও করতেন তিনি। এক পর্যায়ে ২০০১ সালে লামা পৌরসভার প্রথম নির্বাচনে অংশ গ্রহন করে ৪, ৫ ও ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হন ফাতেমা পারুল। কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর অবহেলিত নারীদের উন্নয়নে কাজ করার সুযোগ আরো প্রসারিত হয়। তিনি অবহেলিত দরিদ্র নারীদের আতœ-কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারী নিজের বাড়ীর উঠানে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নব জাগরণ মহিলা উন্নয়ন সমিতি’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। মাত্র ১৫ জন নারী নিয়ে শুরু করেন সংগঠনের কার্যক্রম। বর্তমানে দেড় শতাধিক অবহেলিত নারী এ সংগঠনের সদস্য রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নব জাগরণ মহিলা উন্নয়ন সমিতির উদ্যোগে শুরু থেকে বাল্য বিবাহ রোধ, নারী নির্যাতন, যৌতুক প্রথা, শিশু পাচার রোধে সচেতনতা মূলক সভা সেমিনারসহ জাতীয় দিবসের মধ্যে নারী দিবসসহ বিভিন্ন দিবস পালন করে আসছে যথাযথভাবে। এছাড়া এলাকার অবহেলিত দরিদ্র নারীদের আতœ-কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ইতিমধ্যে এই সমিতির মাধ্যমে বেশ কয়েক ধাপে দু শতাধিক বেকার নারীকে সেলাইসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষন গ্রহন করেন। তাদের মধ্যে কিছু নারী সেলাই, আর কিছু পুতির তৈরি টিস্যু বক্স, নকশি কাঁথা, বল্ক-বাটিক, বাঁশ-বেত ও বিভিন্ন ফুলের টপ তৈরীকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে এ কাজ করে এখন সংসার চালায়। স্বামীর পাশাপাশি ছেলে মেয়েদের পড়া লেখার খরচও যোগান দেন প্রশিক্ষিত এ নারীরা। লামা পৌর এলাকার কলিঙ্গাবিলের কামাল উদ্দিনের স্ত্রী মুক্তা বেগম, কাটা পাহাড়ের মোশারফের স্ত্রী রোকসানা বেগম, চরোয়া বিলের রাশেদা বেগম, পশ্চিম রাজবাড়ীর শাহেনা বেগম, নুরজাহান বেগম, আনোয়ারা বেগম ও মধুঝিরি গ্রামের লায়লা বেগম উল্লেখযোগ্য। এ সমিতির মাধ্যমে গত দেড় বছরে প্রতি ব্যাচে ৩৫জন করে ১৭৫ জন নারী এ সমিতির উদ্যোগে নকশি কাঁথা, সেলাইসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষন গ্রহন করেছেন। বর্তমানেও নারীদের কারিগরিভাবে দক্ষ করে তুলতে পাপস বুনন, অ্যামব্রয়ডারী, বাটিক, বুটিকসহ মোট ৯টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীরা নিজেদের দক্ষ করে এসব কাজের মাধ্যমে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন।
প্রতিভাবান এ ফাতেমা পারুলের অক্লান্ত পরিশ্রম আর মেধার সমন্বয়ে ২০০০ সালে সমিতিটি মহিলা বিষয়ক ও যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর কর্তৃক রেজিষ্ট্রেশন লাভ করে আরো একধাপ এগিয়ে যায়। শুরুতে বাঁশের বেড়া ও ছনের ছাউনির ঘর দিয়ে সমিতির কার্যক্রম শুরু করা হয়। বহু আবেদন নিবেদনের পর ২০১২-১৩ অর্থ বছরে সরকারী ভাবে এডিবি’র অর্থায়নে একটি টিনের ছাউনি ও টিনের বেড়া ঘর নির্মান করে দেয়া হয়। তবে সমিতির ঘর থাকলেও নেই পর্যাপ্ত আসবাবপত্র ও প্রশিক্ষনের সরঞ্জমাদি। আসবাবপত্র না থাকার কারনে যেমন সমিতির দৈনন্দিন কাজে দারুন ব্যাঘাত ঘটছে, তেমনি প্রশিক্ষন সরঞ্জাম না থাকায় চাহিদা অনুযায়ী এলাকার অবহেলিত বেকার নারীদেরকে প্রশিক্ষন প্রদান করা সম্ভব হয়না।
সমিতির কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সারিবদ্ধ ভাবে বেঞ্চে বসে ৩৫-৩৫ জন নারী। পেশায় তারা গৃহবধূ। আর সমিতির সভানেত্রী ফাতেমা পারুল তাদেরকে বাল্য বিবাহ রোধ, নারী পাচার রোধ, নারী নির্যাতন ও যৌতুক প্রথা রোধসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর সচেতনতা বিষয়ক ধারনা দিচ্ছেন। এ সময় প্রশিক্ষণার্থী নুরজাহান বেগম, আনোয়ারা বেগম ও লায়লা বেগম বলেন, স্বামী মানুষের জমিতে শ্রমিকের কাজ করে। তার আয় দিয়ে সন্তানের লেখাপড়া ও সংসার চলেনা। নারীনেত্রী ফাতেমা পারুলের সহযোগিতায় আমরা নকশিকাঁথা, বল্কবাটিক, সেলাই কাজ করছি। আমাদের তৈরি জিনিসপত্র এখন সবার নজর কেড়েছে। এখান থেকে আমরা প্রতিমাসে তিন থেকে চার হাজার টাকা করে আয় করি।
সমিতির সভানেত্রী বেগম ফাতেমা পারুল বলেন, অবহেলিত অসহায় নারীদের প্রশিক্ষনের মাধ্যমে আতœ কর্মস্ংস্থানসহ ভাগ্য বদলানোর চেষ্টা করছি। আবার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীদের উৎপাদিত পণ্যসমূহ যেন সঠিক দামে ও ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারে সেজন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের সাথে সমন্বয় করছি। তিনি আরও বলেন, বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়ের মধ্যে একটি হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন। ডিজিটাল বাংলাদেশ বির্নিবান, ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্ত সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে এসকল অসহায় নারীদের এগিয়ে নিতে হবে। সেজন্যে পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারায় কৃজ্ঞতা জানাই।
এ বিষয়ে লামা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সুষ্মিতা খীসা বলেন, দেশকে উন্নতশীল করতে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও আয় বৃদ্ধিমূলক কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাহলে প্রতিটি পরিবারে অর্থের সংকট দূর হওয়ার পাশাপাশি পরিবার তথা সমাজে অর্থনৈতিক বিল্পব ঘটবে। তিনি আরও বলেন, সমিতির মাধ্যমে নারীদের আয় বৃদ্ধিমূলক কাজে সম্পৃক্ত করে জয়িতা ফাতেমা পারুল অনেক বড় কাজ করছেন।