এইচ এম আবু ছিদ্দিক :

সাংবাদিকতা একটি মহান দায়িত্ব ও স্বতন্ত্র পেশা। যা অন্য সব পেশার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থ উপেক্ষা করে গণমানুষের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষা করা সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব ও কর্তব্য। গণতন্ত্র চর্চা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বঞ্চিত গণ-মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, সর্বোপরি মানবাধিকার রক্ষায় মুক্ত ও সুস্থ সংবাদ মাধ্যম অত্যাবশ্যক। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে প্রত্যেকেই ব্যক্তি স্বাধীনতায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। মৌলিক মানবাধিকার যাতে কোনভাবেই লঙ্ঘিত না হয়, সেদিকে সাংবাদিকদের সজাগ দৃষ্টি রাখা পেশাগত ও নৈতিক দায়িত্ব। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের মধ্যে সহনশীলতা ও আন্তরিকতার পাশাপাশি সহযোগিতার মনোভাব থাকা একান্তই প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সাংবাদিকদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, মানবাধিকার এবং সাংবাদিকতা এটির সাথে অন্যটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। গণমাধ্যম যদি রাজনৈতিক বা দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হয়, তাহলে সুন্দর সমৃদ্ধ জাতি গঠনে ফলাফল কখনোই ভালো হয় না। এতে সাধারণ মানুষের অধিকার খর্ব করা হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যারা দেশ পরিচালনা করেন অর্থাৎ রাজনীতিবিদ, এবং যারা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন সরকারি কর্মকর্তা বা আমলা। তাদের মধ্যে দেশপ্রেমিক আদর্শবান অনেকেই জাতির ভাগ্যে উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন, তবে সংখ্যায় অত্যন্ত নগণ্য। আর যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনগণের সম্পদ লুন্ঠন করে অথবা অবৈধ কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। তাদেরকে অতন্দ্র পাহারা দেয়া সাংবাদিকদের দায়িত্ব। ইমবেডেড জার্নালিজম (Embeded Journalism) বাকধারাটি সাংবাদিকতায় নতুন সংযোজন হয়ে আলোচনায় উঠে এসেছে মার্কিন নেতৃত্বে যৌথবাহিনী ইরাক অভিযানের সময়। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সংবাদ সরাসরি প্রচারের জন্য সামরিক ইউনিটের সাথে সাংবাদিকদের যুক্ত করে এই অভিনব পদ্ধতি চালু করেন। আসলে “ইমবেডেড জার্নালিজম” কি? পরাশ্রয়ের সাংবাদিকরা আশ্রয়দাতার মনোরঞ্জনের জন্য সত্যকে গোপন করে মিথ্যাকে বিচিত্র করে রচনা করাই হচ্ছে, ইমবেডেড জার্নালিজম। যে শুতে দেয়, খেতে দেয়, চলাফেরার যানবাহন দেয় তার সম্পর্কে সংবাদ রচনা করা তাঁর বিরুদ্ধে হতে পারেনা। তার সন্তুষ্টি বিধান করতে হলে মনোরঞ্জন করতে হবে। ইংরেজীতে আরেকটি কথা আছে “Strange bed fellow” বাংলায় দাঁড়ায় “অদ্ভূদ শয্যাসঙ্গী”। যাদের একই বিছানায় শোবার নয়, তারা যখন একত্রে বিছানায় গ্রহন করে, তখনই এই বাকধারাটি তৈরী হয়। শয্যাসঙ্গীরা কিন্তু সাধারণত হয়ে থাকে সমমানের বা প্রায় সমমর্যাদার। কিন্তু ইমবেডেড জার্নালিজমের ক্ষেত্রে মান-মর্যাদার প্রশ্ন অবান্তর। কারণ সে সাংবাদিকের শোবার জন্য একটা বিছানা চায়-ই। যুদ্ধক্ষেত্রে যোদ্ধা ব্যতিত কাউকে খাবার দেয়া সহজ হতে পারে, কিন্তু শোবার বিছানা দেয়া তুলনামূলকভাবে কষ্টকর। তাই অযোদ্ধা সাংবাদিকের ক্ষেত্রে খাবার কথা না বলে বিছানার ওপর অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মার্কিন ও বৃটিশ সশস্ত্র আগ্রাসী বাহিনী ইরাক আক্রমনকালে বেশীরভাগ সাংবাদিক রণক্ষেত্র থেকে সংবাদ সংগ্রহকালে সত্য গোপন করে বহুবিধ অসত্য সংবাদ প্রচার করেন। বলা বাহুল্য, ঐসব সাংবাদিক ছিলেন প্রায় সবাই মার্কিন ও ইংরেজ সমর্থক। এসব সাংবাদিকের প্রেরিত মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদ ইঙ্গ মার্কিনিদের অন্যায় যুদ্ধকে সমর্থন দেয়ায় ছিল তাদের উদ্দেশ্য। যাদের স্বার্থে ওইসব উদ্দেশ্যমূলক নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ওই সময়ে যুক্তরাজ্যের উপ-প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা জন প্রেসকট শিকার করেছেন। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার ভুল তথ্যের ভিত্তিতে অবৈধ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল মার্কিন বাহিনী। ইরাক একটি স্বয়ং-সম্পন্ন ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশ ছিল। কিন্তু কিছু অসৎ সাংবাদিক ও সশস্ত্র আগ্রাসী বাহিনীর কারণে দেশটি আজ পঙ্গু হয়ে গেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ লাশের ধ্বংসস্তুুপে পরিণত হয়েছে। ইরাক যুদ্ধে বিনা অপরাধে ক্ষতিগ্রস্থরা প্রতিশোধের আগুনে এখনও জ্বলছে। এমনকি আইএস’র মতো সংগঠনে যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছে। এসব অবৈধ যুদ্ধ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলে নিশ্চিত বলা যায়। আই এস’র জন্মদাতা মার্কিন বাহিনী, এবং এমবেডেড জার্নালিজম জাতি হত্যার শামিল। তবে ইমবেডেড জার্নালিজম চলছে বহুকাল আগে থেকেই। বলা যায় সা¤্রাজ্যবাদীদের সা¤্রাজ্য পত্তন ও ধারণ কাল থেকে নয়া ঔপনিবেশিক যুগ এবং সর্বশেষ নব্য সা¤্রাজ্যবাদী কাল পর্যন্ত। অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকের শুরু থেকে হাল আমল পর্যন্ত। বলা বাহুল্য, ইমবেডেড জার্নালিজমের জন্ম সা¤্রাজ্যবাদীদের ঘরে এবং তার বিকাশ হয় তাদেরই হাতে। সা¤্রাজ্যবাদীদের হাতে সাংবাদিকতার যে কত জঘন্য বা নিন্দনীয় সত্য স্খলন হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই চীনের “আফিম যুদ্ধে” বৃটিশ ভারতের জালিয়ান ওয়ালাবাগের ইংরেজ জেনারেল কর্তৃক হত্যাকান্ডে (১৯১৯) এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে। বলা হয়ে থাকে, “যুদ্ধের প্রথম শিকার হচ্ছে সত্য”। সত্য হত্যার শিকার সাংবাদিকতাও। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আধুনিককালে যেমন: ১৯১৪-১৯ এবং ১৯৩৯-৪৫ সালে সংঘটিত দু’টি মহাযুদ্ধ। ২৫ বছরব্যাপী মার্কিনিদের ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং সর্বশেষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের আফগান যুদ্ধ (২০০১) ও ইরাক যুদ্ধ (২০০৩)। আরেক ধরণের চাটুকারিতার সাংবাদিকতা আছে, যেক্ষেত্রে একে অন্যকে তোষামোদ করে। যেমন কোন কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক নেতা সাংবাদিকদের অনেকভাবে তোষামোদ করে থাকে। যাকে করেন সাংবাদিক ও তার সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে কর্মকর্তাটির মনোরঞ্জ করেন। এ ধরনের সাংবাদিকতা যেমন ক্ষুদ্রাকারের হতে পারে, তেমনই বৃহদাকারেরও হয়ে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান তার ১০ বছরের শাসনকাল শেষে তথাকথিত “উন্নয়নের দশক” পালন করতে গিয়ে ১৯৬৮ সালে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের জন্য একটি সুসজ্জিত বিশেষ ট্রেনে বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের আয়োজন করেন। সে ট্রেনের নাম ছিল “পাক-জমহুড়িয়া ট্রেন” জমহুড়িয়ার অর্থ হচ্ছে রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র। স্বৈরশাসনের নাম দেয়া হয়, “প্রজাতন্ত্র”। এ যেন কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন। সেই পদ্মলোচনের শ্রæতি ও প্রশংসা গাইবার জন্য রাজকীয় ট্রেনে ভ্রমন করেন, এবং রাজকীয় আদর আপ্যায়ন ভোগ করেন। আবার সত্যাশ্রয়ীকে মিথ্যুক প্রমাণিত করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও সাংবাদিককে ব্যবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৫৪ সালে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বপ্রথম সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের একচেটিয়া ঐতিহাসিক বিজয়ের পর জনপ্রিয় জাতীয় নেতা এ.কে. ফজলুল হক পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, এবং যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠন করেন। পূর্বেকার শ্বাসরুদ্ধকর মুসলিম লীগের হাতে ছিল কেন্দ্রীয় শাসন ও সরকার। পাকিস্তানের রাজধানী তখন ছিল করাচি। পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রীসভা গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক যখন করাচি যান তখন করাচিস্থ “নিউইয়র্ক টাইমস্” এর সংবাদদাতা কেলাহান তার একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার গ্রহন করেন। এবং সে সাক্ষাৎকারে যে রিপোর্ট “নিউইয়র্ক টাইমস্” প্রকাশিত হয় তা ছিল বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। সে রিপোর্টে বলা হয় যে, ফজলুল হক বলেছেন যে, পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা করে নিয়ে যাওয়া হবে। পাকিস্তানের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী ও গভর্ণর জেনারেল সে রিপোর্ট হক সাহেবের সামনে তুলে ধরেন ও সেই রিপোর্টের ব্যাখ্যা দাবি করেন। হক সাহেব বলেন ওই রিপোর্ট সর্বৈব মিথ্যা। কিন্তু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বলেন, ফজলুল হক মিথ্যুক এবং দিন কয়েকের ভেতর পূর্ব পাকিস্তানের তাঁর সরকারকে বরখাস্ত করে গভর্নরের শাসন জারি করেন। এক কথায় মিথ্যা সাংবাদিক সত্যকে আড়াল করে মিথ্যা রূপ দিয়ে বিশ্বখ্যাত জাতীয় নেতা এ.কে. ফজলুল হকের বিরুদ্ধে অসত্য বানোয়াট অভিযোগের দরজা খুলে দেন। বর্তমানে বাংলাদেশেও অর্থ ও ক্ষমতা লোভী কিছু স্বার্থপর অপসাংবাদিকের কারণে সৎ-সাংবাদিকতার মতো মহান পেশায় কলঙ্কের দাগ পড়া শুরু হয়েছে। তাদের দলবাজি ও দলীয় ক্ষমতার দাপটে এখন সাধারণ সৎ-সাংবাদিকরা অনেকটা হতাশ ও ক্ষতবিক্ষত। আর একশ্রেনীর মাঠ কাঁপানো কথিত সাংবাদিকের চাঁদাবাজি ও অপকর্মের ফলে বেশীরভাগ মানুষ এখন আগের মতো সাংবাদিকদের সম্মান ও বিশ্বাস করতে দ্বিধাদ্ব›েদ্ব ভোগেন। এসব সাংবাদিকদের অনেকেই সাংঘাতিক বলেও হেয়পন্ন করার চেষ্টা করেন। শুধু এদের কারণেই “সমাজের দর্পণ” সংবাদপত্রের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি কিছুটা লক্ষণীয়। যা সত্যানুসন্ধানী আদর্শবান সম্মানীত কলম সৈনিকের জন্য সু-সংবাদতো নই, বরং আতঙ্কের বিষয়। তবে আশার কথা হলো যে যাই বলুক, শেষ পর্যন্ত সর্বস্তরের মানুষের আশ্রয়স্থল কিন্তু সংবাদ মাধ্যম। সচেতন মানুষ প্রতিদিন (অনলাইন অথবা খবরের কাগজ) একটু সংবাদ না পড়লে অনেকের ঠিকমত রাত্রে ঘুম হয় না। উপরে উল্লেখিত কয়েকটি বিষয় পর্যালোচনা থেকে নিশ্চিত বলা যায়। সাংবাদিক বা সংবাদপত্রের সুনাম অক্ষুণœ রাখার দায়িত্ব কিন্তু সাংবাদিকদের। সুতরাং-এই মহান পেশাকে ইমবেডেড জার্নালিজম ও অপসাংবাদিকতা থেকে মুক্ত রাখতে সচেতন সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া আবশ্যক। গণমাধ্যমকর্মীরা কোন রাজনৈতিক দলের পরিচয় দেয়ার অর্থই হচ্ছে, সে সাংবাদিকতাই অযোগ্য। সাংবাদিকদের দল হবে একটাই সত্যানুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরীর দল। এখন নিজেই ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেবেন, দলবাজি করবেন? নাকি মানবাধিকার ও সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ে প্রকৃত সাংবাদিক হবেন। এক সময় ইমবেডেড জার্নালিজম (ঊসনবফবফ ঔড়ঁৎহধষরংস) যুদ্ধক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও এখন রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে যখন যেইদল রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। কিছু ইলেট্রোনিক্স মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়াকে সরকার ইচ্ছানুযায়ী ব্যবহার করছে। এরমধ্যে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) উল্লেখযোগ্য। চ্যানেলটির সংবাদকর্মীরা সরকারের গুণ-গান ছাড়া জনগণের দূর্ভোগ বা প্রশ্নপত্র ফাঁস বা সাগর চুরির মতো জগণ্য অপরাধগুলো কখনো চোখে দেখেন না, বা দেখলেও কৌশলে এড়িয়ে চলেন। অথচ জনগণের করের টাকায় তাদের বেতন-ভাতাসহ সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। আমরা গুণীজনের মূখে প্রায় শুনি দেশের উন্নয়নে সংবাদপত্রের ভূমিকা অপরিসীম। সম্মানীত লেখক, কলামিস্ট ও সাংবাদিক ভাই-বোনেরা রাষ্ট্রের সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা জাতির কাছে তুলে ধরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের কৌশলী ধারা ৫৭ গণমাধ্যমকর্মীদের অনেকাংশে বাকরোদ্ধ করেছে। তবে কিছু দায়িত্ববান সচেতন সাংবাদিকদের প্রতিবাদে সেই ধারা বিলুপ্ত করে তার পরিবর্তে ৩২ ধারা যোগ করে সাংবাদিকদের গুপ্তচর সাজানোর প্রক্রিয়া মন্ত্রীসভা অনুমোদন দিয়েছে। সাম্প্রতিক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ৩২ ধারা বিষয়ে আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করে বলেছেন। এই ধারা সাংবাদিকদের জন্য নয়, তাদের কোন ক্ষতি হবেনা। স্পেশাল শান্তনা দেয়ার জন্য তিনি আরও সাথে যোগ করেছেন, বত্রিশ ধারায় সাংবাদিকরা গ্রেপ্তার হলে তার পক্ষে বিজ্ঞ আদালতে দাঁড়াবেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যায়। সারাদেশে শত শত সত্যানুসন্ধানী প্রতিবেদক রয়েছে, তিনি কয়জনের পক্ষে দাঁড়াবেন? বা বিজ্ঞ আদালত তাঁর কথায় জেল-জরিমানা মাফ করে দেবেন কিনা? বা এ আইন সংসদে পাশ হলে যতদিন কার্যকর থাকবে, ততদিন তিনি ক্ষমতায় থাকবে কিনা? এছাড়া শারীরিকভাবে সুস্থ বা জীবিত থাকার কোন গ্যারান্টি আছে কিনা? এসব মনগড়া বক্তব্য শুধু ক্ষমতাসীন আইনমন্ত্রী ছাড়া কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ দিতে পারবে বলে আমার মনে হয়না। এমনিতেই দেশে দূর্নীতির মহড়া চলছে। এই আইনের ধারাটি বহাল থাকলে ওপেন ধাক্কাবাজি চলবে। সরকার সাংবাদিকদের অধিকার হরণে যতই ফাঁদ বসায় না কেন। বহু সত্যানুসন্ধানী সাহসী কলম সৈনিক জেল-জুলুমের ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে পেশাগত দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর। ইতিমধ্যেই অনেক সাংবাদকর্মী পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সংবাদপত্রের গুরুত্ব পার্লামেন্টের পরেই স্থান দখল করেছে। প্রকৃত পক্ষে পার্লামেন্ট ও সংবাদপত্র হচ্ছে গণতন্ত্রের দুটি স্তম্ভস্বরূপ। মার্কিন তৎকালিন প্রেসিডেন্ট ফ্যাংডিন লিলানো রুজভেন্ট বলেছিলেন, যদি কখনো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। তবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শিক্ষার স্বাধীনতা, বক্তব্য রাখার ও জনসমাবেশের অধিকার প্রভৃতি মৌলিক অধিকারগুলো অর্থহীন হয়ে পড়বে। ফ্রান্সের স¤্রাট নেপোলিয়ান সংবাদপত্রের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন। এক লক্ষ সৈনিকের চেয়ে আমি তিনটি সংবাদপত্রকে বেশী ভয় করি। প্রেসিডেন্ট রুজ ভেন্টের উদ্বৃতি থেকেই বোঝা যায়, সংবাদপত্র কতোটা গুরুত্ববহন করে। এখানে একটি ছোট উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা স্পষ্ট করা যায়। একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্যের কাজ হচ্ছে সরকার ও জনগণের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করা। তিনি তাঁর এলাকার জনসাধারণের সুখ-দুঃখ ও সমস্যাদি তুলে ধরেন, এবং তা সমাধানের সম্ভাব্য উপায় সম্পর্কে মতামত দেন। অর্থাৎ তিনি নির্বাচিত এলাকার জনগণের মুখপাত্র হিসাবে কাজ করেন। আর সংবাদপত্র ঐ রাজনীতিকের দায়িত্ব পালন করে। অর্থাৎ সংবাদপত্র হচ্ছে গণতন্ত্রের মূল অবয়ব। আধুনিক বিশ্বে সংবাদপত্রহীন কোনো দেশ কল্পনাও করা যায় না। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের নাগরিক জানতে চান তার দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাসহ প্রতœতাত্তি¡ক ভূ-সম্পদ আবিষ্কারের খবর। কি রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক সব ধরনের পরিবর্তন সম্পর্কেও জানতে চান, কোথায় কি হচ্ছে বা ঘটছে। প্রকাশ করতে চান তার নিজস্ব মতামত। সংবাদপত্র সম্পর্কে দার্শনিক হেনরী ওয়ার্ড মন্তব্য করেছেন যে, সংবাদপত্র হচ্ছে সাধারণ মানুষের স্কুল শিক্ষক। এই সমাপ্তবিহীন পুস্তক প্রতিটি দেশের গৌরব। আমেরিকান এক প্রখ্যাত দার্শনিক সেই দেশের একটি সংবাদপত্রে তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন। যে দেশে সরকার নেই সে দেশে আমি বাস করতে পারি-তবে যে দেশে সংবাদপত্র নেই সেই দেশে আমি কিছুতেই থাকতে পারিনা। সংবাদপত্র আমাদের সচেতন করে এবং নতুন করে ভাবতে শেখায়। সুতরাং-আমাদের দৈনন্দিন ও জাতীয় জীবনে সংবাদপত্র ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশেষ করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন শহর কক্সবাজারের সাংবাদিকদের অধিকার আদায় ও পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে সংবাদকর্মীদের একতাবদ্ধ হওয়া অত্যাবশ্যক। সাম্প্রতিক সময়ে সাংগঠনিক পদ-পদবী নিয়ে বিভিন্ন ইলেকট্রোনিক্স মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়ায় যেসব খবরাখবর প্রচারিত হয়েছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। লেখক ব্যক্তিগতভাবে মনে করে, সিনিয়র সাংবাদিকরা পদ-পদবী নিয়ে অযথা ব্যথিত হওয়া সমীচীন নয়। তরুণ মেধাবী সাংবাদিকদের যথাযত মূল্যায়নসহ সুযোগ-সুবিধা দিলে, প্রবীণেরা আরও বেশী সম্মানীত হবে। পরিশেষে বলব, সাংবাদিকতা হচ্ছে একটি সত্য অনুসন্ধানীদের পেশা। সাংবাদিকেরা সমাজ ও জাতির কল্যাণে সত্য খুঁজে খুঁজে উদঘাটন করবে, এবং সংবাদ ও মন্তব্য পরিবেশনে তা তুলে ধরবে। যে সাংবাদিকের কলমের জোর আছে, সে সত্য পরিবেশন করেও বাস্তব চিত্র বা অবস্থার ন্যায়ধর্মী বিশ্লেষণ করে জাতির মঙ্গল ও মানব কল্যাণের পথ রচনা করতে পারে। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে একজন সাংবাদিকের ধর্ম ও কর্ম। যে দেশে বা যে সমাজে এমনই সাংবাদিকের সংখ্যাধিক্য আছে, সেখানে সমাজ প্রগতি সহজতর হয়ে আসে। কিন্তু যেখানে কলমের চেয়ে বাহুবল বেশী, সেখানে প্রগতির বদলে অবনতির পথ রচিত হয় সহজে।

লেখক: কলামিস্ট, সাংবাদিক ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, দৈনিক কক্সবাজার বাণী।

মোবাইল:-০১৫৫৮৩৬৩৩৪৩