হারুনর রশিদ,মহেশখালী :
সাগর পাহাড়ের সাথে মিতালী কক্সবাজার জেলার দূর্গম জনপদ মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে নির্মিত হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প মাতারবাড়ী আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র এর আলোতেই আলোকিত হবে সারা বাংলাদেশ। গত ২৮ শে জানুয়ারি ২০১৮খ্রি: প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের মূল কাজের ফলক উন্মোচন করেছেন। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের কিছু মেগা প্রকল্প সুবিধা বঞ্ছিত মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে। অবহেলিত মহেশখালীতে অপার সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের তলদেশে লুকিয়ে থাকা নীল অর্থনীতিকে ছাঁকিয়ে তুলতে মহেশখালীতে নির্মিত হচ্ছে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, গভীর সমুদ্র বন্দর, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) টার্মিনাল স্থাপন ও অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ পরিকল্পিত নগর। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অর্থনীতির প্রসার ঘটবে। শুধু সাগরের তলদেশের ‘নীল অর্থনীতি’ পাল্টে দেবে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির চিত্র।
সরকারের মহাপরিকল্পনা হিসেবে দ্বীপ উপজেলা মাতারবাড়িকে ‘বিদ্যুৎ হাব’ হিসাবে গড়ে তোলার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের আওতায় নির্মিতব্য বন্দরটি পরবর্তীতে গভীর সমুদ্র বন্দরে রূপান্তর করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। গভীর সমুন্দ্র বন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে স্থায়ী চ্যানেল ড্রেজিং কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র ও দেশের প্রথম সমুন্দ্র বন্দর নির্মাণ করে মাতারবাড়িতে অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার ও পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। মহেশখালীর মাতারবাড়ি ও ধলঘাটায় ১৪১৪. একর জমিতে এই প্রকল্পটি নির্মাণের কাজ ইতিমধ্যে ১৮ শতাংশ শেষ হয়েছে জানান কতৃপক্ষ।
মহেশখালী চ্যানেলের সাগর থেকে প্রাপ্ত বায়ু, তরঙ্গ বা ঢেউ, জোয়ার-ভাটা, জৈব-তাপীয় পরিবর্তন, লবণাক্ততার মাত্রা ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যাপক পরিমাণে নবায়নযোগ্য শক্তির জোগান পাওয়া সম্ভব
সমুন্দ্র বন্দর চালু এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সম্পন্ন হলে পাল্টে যাবে দেশের অর্থনীতি। কারণ সমুন্দ্র ব্যবহার করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। সাগর থেকে প্রাপ্ত বায়ু, তরঙ্গ বা ঢেউ, জোয়ার-ভাটা, জৈব-তাপীয় পরিবর্তন, লবণাক্ততার মাত্রা ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যাপক পরিমাণে নবায়নযোগ্য শক্তির যোগান পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়াও বঙ্গোপসাগরে রয়েছে ৪শ ৭৫ প্রজাতির মাছ। প্রতি বছর সেখান থেকে ৬৬ লাখ টন মৎস্য আহরণ করা সম্ভব; কিন্তু বাস্তবে জেলেরা সেখান থেকে খুব কমই মৎস্য আহরণ করে। মহেশখালীর উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। মৎস্য সম্পদ ছাড়াও সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে বহু খনিজ সম্পদ। বাংলাদেশ বঙ্গপোসাগরের তলদেশ থেকে যেসব সম্পদ পেতে পারে তা হলো বিভিন্ন খনিজ পদার্থ যেমন- গ্যাস, তেল, কপার, ম্যাগনেশিয়াম, নিকেল, কোবাল্ট ইত্যাদি।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা কোল-পাওয়ার জেনারেশন অব বাংলাদেশ লি:-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম কক্সবাজার নিউজকে সিবিএন জানান, ইতিমধ্যে মাতারবাড়ি প্রকল্পের জন্য ৪০০ জন দক্ষ শ্রমিক বিদেশ থেকে এসেছে এবং ১১০০ দেশী-বিদেশী শ্রমিক কাজ করছে। গুলশান হামলার প্রভাব পড়েছিল মাতারবাড়ি প্রকল্পেও। তার অবসান ঘটিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে বিগত বছরের জুলাইয়ে তিনটি প্রতিষ্ঠানের একটি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চুক্তি করে কোল পাওয়ার জেনারেশন অব বাংলাদেশ (সিপিজিসিবিএল)। তিনি আরো জানান, পরিবেশ-পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই এই বিদ্যুৎ প্রকল্পটি নির্মাণ কাজ শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে। তবে জাপানী কনসোর্টিয়ামের অন্যতম কোম্পানী তোশিবা কর্পোরেশন আরও সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন। প্রকল্প খরচের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি বলে জানান তারা। ২০১৫ সালের আগস্টে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ৩৬ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। একনেকে অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পের কার্যপত্রে বলা হয়- জাইকা এ প্রকল্পে ২৯ হাজার কোটি টাকা দেবে। দরপত্র প্রক্রিয়া চলার মধ্যেই গুলশান হামলায় ১৭ জন বিদেশী নিহত হওয়ার পরদিন মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প দরপত্র প্রক্রিয়া স্থগিত করার কথা জানান সরকার। এরপর জাইকার সবচেয়ে বড় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে তৈরী হয় সংশয়। কিন্তু সব সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে গত ২৭ জুলাই কনসোর্টিয়াম সুমিতুমো কর্পোরেশন, তোশিবা কর্পোরেশন ও আইএইচআই কর্পোরেশনের সাথে চুক্তি করে কোল পাওয়ার জেনারেশন অব বাংলাদেশ (সিপিজিসিবিএল)। ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও আমদানী-রপ্তানী বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রয়োজনীয়তা অনেকদিন থেকেই দেখা দিয়েছে। বর্তমান সরকার মহেশখালীর সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের প্রকল্প অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর মধ্যে রাখলেও তার কোন অগ্রগতি হয়নি। গত সাত বছরে বাংলাদেশে আমদা-রপ্তানী ২ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। দু’টি বন্দর দিয়ে ক্রমবর্ধমান এই বাণিজ্য সামাল দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠেছে। তাই গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে সরকারের পক্ষ থেকে জোরেশোরে কাজ শুরু করতে হচ্ছে। মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র আমদানী করা কয়লা নির্ভর হওয়ায় কয়লা আনার জন্য এ বন্দর করা হচ্ছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। ৫৯ ফুট গভীর এ বন্দরে ৮০ হাজার মেট্রিকটন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ নোঙর করতে পারবে। জাপানের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে যে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মিত হবে সেটি হবে জাপানের কাশিমা বন্দরের আদলে। গভীর সমুদ্র বন্দরটি নির্মিত হলে কয়লা পরিবহন ছাড়াও অন্য কি কি কাজে ব্যবহার করা যাবে- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপাতত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কথা মাথায় রেখে আমরা কাজ করছি। তবে এ বন্দরকে বহুমূখি কাজে ব্যবহার করা যাবে। এ ব্যাপারে সরকারই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কোল পাওয়ার জেনারেশন এর মাতারবাড়ি প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক ইঞ্জিনিয়ার মুনির জানান, কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা পাচ্ছি। সম্প্রতি মাতারবাড়ি প্রকল্প পরিদর্শনকালে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এম.পি বলেন, মাতারবাড়িতে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের আওতায় নির্মিত বন্দরটি পরবর্তীতে গভীর সমুদ্র বন্দরে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার জন্য বঙ্গোপসাগরের তীরঘেষে মহেশখালীর ৬টি মৌজায় যেসব জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে সেসব জমিতে লবণ ও চিংড়ি চাষ হয়। মহেশখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, গভীর সমুদ্র বন্দর, তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল স্থাপন করে বিশেষ অথনৈতিক অঞ্চল ও নগর গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছে সরকার।
উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলছে দেশ। তারই ধারবাহিকতায় কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে জাইকার অর্থায়নে কোল-পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানী বাংলাদেশ লিমিটেডের বাস্তবায়নাধীন ১২শ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে ২০১৪ সালের ১৪ আগস্ট ওই সংস্থার কাছে মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ি মৌজার ১৪১৪. একর ভূমি হস্তন্তর করা হয়। এ পর্যন্ত ৯০ শতাংশ জমির মালিকদের মধ্যে ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদান করা হয়েছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান পেন্টা-ওশান প্রাথমিক পর্যায়ে নির্মাণ কাজসমূহ (টেম্পোরালী চ্যানেল, বাঁধ, ল্যান্ডিং, জেটি ও অফিস বিল্ডিং) প্রায় কাজ শেষ পর্যায়ে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মহেশখালী-কুতুবদিয়ার এমপি অলহাজ্ব আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোকে পুণর্বাসন করা হচ্ছে। কাজের অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়েছে। অপরদিকে গভীর সমুদ্র বন্দর, এলএনজি টার্মিনাল ও অথনৈতিক অঞ্চল এবং পরিকল্পিত নগর গড়ার কাজ সরকার হাতে নিয়েছে । যাতে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। প্রধানমন্ত্রী মহেশখালীকে নিয়ে অনেক আশাবাদী। এ অঞ্চলের দু:খ-দুর্দশা তিনি বুঝেন এবং এ অঞ্চলের মানুষের জন্য কাজ করবেন। তিনি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সর্বস্তরের জনগণের সহযোগিতা চেয়েছেন। মাতারবাড়ীর চেয়ারম্যান মাষ্টার মোহাম্মদ উল্লাহ জানান, মহেশখালীর এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে মাতারবাড়ীর জনগণ সবসময় আন্তরিকভাবে সহযোগিতা দিয়ে আসছেন এবং আওয়ামীলীগের দলীয় নেতাকর্মীরা নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখছেন। মাতারবাড়ীর মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আস্থাশীল ।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।