সিবিএন ডেস্ক:
মিয়ানমারের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী ২২ জানুয়ারি থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা। প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৫০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে চেয়েছে মিয়ানমার। আর এ প্রক্রিয়া দুই বছরের মধ্যে শেষ হবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, রোহিঙ্গারা আদৌ কি রাখাইনে ফিরে যাবে?

আন্তর্জাতিক ও দেশীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, ৫টি দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গারা দেশে ফিরবে না। রোহিঙ্গা নেতারা এসব দাবি তুলেছেন।

দাবিগুলো হলো-
১. রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সরকারি ঘোষণা আসতে হবে। মিয়ানমারের স্বীকৃত জাতিগোষ্ঠীর তালিকাতে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
২. বাড়িঘর, জায়গা-জমি ফিরিয়ে দিতে হবে।
৩. হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের বিচার করতে হবে।
৪. কারাগারে আটক ‘নিরপরাধ’ রোহিঙ্গাদের মুক্তি দিতে হবে।
৫. রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী আখ্যা দেয়া তালিকা সরিয়ে নিতে হবে।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে, সেখানে এসব বিষয়ে কোনো কিছুই উল্লেখ নেই। অর্থাৎ চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরলে তাদের সেনা নিয়ন্ত্রিত ক্যাম্পে থাকতে হবে। সেনাবাহিনীর অধীনে তারা নিরাপদ থাকবে কি না তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

রোহিঙ্গারা বলছেন, অনিরাপদ পরিবেশে রাখাইনে ফেরা মানে নিশ্চিত মৃত্যু। সেখানে ফিরে মরার চেয়ে এই দেশে মরাই ভালো। আর বাংলাদেশ যদি থাকতে না দেয়, তাহলে আমরা সাগরে ঝাঁপ দিয়ে মরে যাব।

এ অবস্থায় বিশ্লেষক ও শরণার্থী ক্যাম্প ঘুরে আসা সাংবাদিকরা বলছেন, বিরাজমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে না। আর যেহেতু চুক্তি অনুযায়ী স্বেচ্ছায় না গেলে জোর করে পাঠানো যাবে না, তাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বড় ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে।

এদিকে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর মতো পরিবেশ এখনও সৃষ্টি হয়নি। কারণ এখনও সেখানে সেনাবাহিনীর হাতে রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হচ্ছেন।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় তৃতীয় কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থাকে রাখা হয়নি। মিয়ানমার চায় না এর মধ্যে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা আসুক। তবে তারা বলেছে রেডক্রসকে রাখা যেতে পারে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় তৃতীয় পক্ষ না থাকায় সমালোচনার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। তাছাড়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মিয়ানমার যেভাবে চেয়েছে, সেভাবেই চুক্তি হয়েছে- এ নিয়েও সমালোচনা চলছে।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থাকে পাশ কাটিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘ মহাসিচবও। গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, “আমরা মনে করি, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থাকে (ইউএনএইচসিআর) এই চুক্তির সময় সাথে রাখাটা জরুরি ছিল।”

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের এই অস্থিতিশীল সময়ে ফেরত পাঠানো হবে অন্যায় এবং অপরিপক্ক সিদ্ধান্ত বলে ইতোমধ্যে মন্তব্য করেছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক প্রধান জেমস গোমেজ।

এদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমার যখন সব প্রস্তুতি শেষ করছে, তখনও রাখাইনে সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। গত কয়েকদিনে শতাধিক রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের বাধা দেয়নি।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মুখপাত্র ফিয়োনা ম্যাকগ্রেগর শনিবার বলেছেন, মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

গত সপ্তাহে নেপিডোতে জেডাব্লিউজির প্রথম বৈঠক শেষে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ২২ জানুয়ারিই প্রথম দফায় ৭৫০ জন মুসলমান ও ৫০৮ জন হিন্দু রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে চায় মিয়ানমার। মিয়ানমার সরকার এরই মধ্যে তাদের তথ্য যাচাই-বাছাই করেছে। প্রত্যাবাসনের জন্য প্রথম দলে তাদের রাখতে মিয়ানমার বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছে।

কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ বিষয়ে বাংলাদেশ এখনও প্রস্তুত নয়।

২২ জানুয়ারি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম। তিনি জানান, ২২ জানুয়ারি সম্ভব নয়। তালিকা তৈরি করা, কারা যাবে, স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে আগ্রহী হওয়া, তালিকা তাদের মিয়ানমারকে দেয়া—এই প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করেই প্রত্যাবাসন কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

মিয়ানমারে ইরানের অনাবাসিক রাষ্ট্রদূত মোহসেন মোহাম্মাদি বলেছেন, অনেক রোহিঙ্গা মুসলমানই প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় রাখাইনে ফিরতে আগ্রহী নন। কারণ মিয়ানমারে ফেরার পর তারা আরও বিপদে পড়ার আশঙ্কা করছেন। তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। তাদের ভিটেমাটি দখল হয়ে গেছে। একদিকে তারা বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরগুলোতে কঠিন ক্ষুধা ও দারিদ্রের মধ্যে রয়েছেন। আর অন্যদিকে নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব ও ভিটেমাটি ফিরে পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে মিয়ানমারে ফিরে গেলে ভবিষ্যৎ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে গত ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ছয় লাখ ৫৫ হাজার ৫০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে নতুন করে এসেছে। এর আগে ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।

এছাড়া আগে থেকেই বাংলাদেশের ক্যাম্পে ছিল প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা।