শাহেদ মিজান, সিবিএন:
‘কক্সবাজার পর্যটন নগরী হলেও এখানে শিশুদের বিনোদনের ক্ষেত্র অত্যন্ত সংকুচিত। একটি শিশুপার্ক নির্মাণের কক্সবাজারাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিলো। এই জন্য অনেক প্রক্রিয়া দেখা গেলেও তা শেষ পর্যন্ত আলোর মুখে দেখেনি। অন্যদিকে শহরের শতাধিক বিদ্যালয়ের গুটিকয়েক ছাড়া অন্য কোনো খেলার মাঠ নেই। ফলে কক্সবাজারের শিশুদের শৈশব কাটছে ‘বন্দীদশায়’। এমন পরিস্থিতিতে সব বিদ্যালয়ের ভরসাস্থল ছিলো পিটিস্কুল মাঠ। কিন্তু এবার সেই মাঠে রাহুগ্রাস পড়েছে।’ এমনটি বললেন, সেভ দ্য ন্যাচার বাংলাদেশ’ চেয়ারম্যান আ.ন.ম মোয়াজ্জেম হোসেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কার্যালয় ও পিটিস্কুল খেলার মাঠ সংলগ্ন জায়গায় প্রাথমিকের শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে ‘লিডারশীপ ট্রেনিং সেন্টার’। এই সেন্টারের জন্য ১০তলা বিশিষ্ট একটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। গত বছরের শেষের দিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান এই ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। গত পাঁচ দিন আগে এই ভবন নির্মাণের কাজ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, আনুষ্ঠানিক কাজ শুরুর সাথেই ভবনের সীমানা নির্ধারণ করে তার ঘিরে ফেলা হয়েছে। দীর্ঘদিন ওই জায়গা নির্ধারিত থাকলেও বর্তমানে পিটিস্কুল খেলার মাঠের অন্তত ২০ গজ জায়গা দখল করে ফেলা হয়েছে। ইতিমধ্যে খেলার মাঠের অংশেই দু’টি সেপটি ট্যাং তৈরি করে ফেলা হয়েছে। এছাড়াও দখল করা মাঠের অংশে স্থায়ী পাকা খুঁটিও তৈরি করা হয়েছে।

স্থানীয় লোকজন জানান, খেলার মাঠ দখল করে যে কোনো ধরণের স্থাপনা নির্মাণ সম্পূর্ণ অবৈধ। কিন্তু আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই অবৈধভাবে খেলার মাঠ দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এই নিয়ে স্থানীয়রাসহ পুরো শহরবাসী চরম ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। এরই মধ্যে প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে অনেকে। দখল করা খেলার মাঠ ছেড়ে দিতে গত রোববার একটি মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভাও করেছে। পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সেভ দ্য ন্যাচার বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন এই ‘খেলার মাঠ রক্ষ আন্দোলন’ অগ্রভাগে রয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ১০ হাজারের বেশি কোমলমতি শিশু-কিশোরের একমাত্র খেলার জাগয়া হচ্ছে পিটিস্কুল মাঠ। কিন্তু তা দখল করে নির্মাণ ভবন নির্মাণ শুরু হলেও ককসবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও ককসবাজার পৌরসভার কোন মাথা ব্যাথা নেই। এমনিতে পুরো এলাকাতে নেই কোন পাঠাগার, ব্যায়ামার ও শিশুপার্ক। ছিল শুধু খেলার মাঠটা। তাও আজ আজ মৃত্যুর মুখে।

‘সেভ দ্য ন্যাচার বাংলাদেশ’ চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসাইন রিয়াদ জানান, কক্সবাজার শহর একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। কিন্তু এই শহরটি দিনে তার স্বাতন্ত্র হারাচ্ছে। এই শহরে প্রতিনিয়ত চলছে পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মযজ্ঞ। এর সর্বশেষ ধাপ হলো পিটিস্কুল খেলা মাঠ দখল ভবন নির্মাণ। অথচ এই মাঠটিই ছিলো কক্সবাজারের অর্ধশত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিনোদনের একমাত্র স্থল। একই সাথে এই মাঠে শহরে অধিকাংশ ছেলেরা তাদের ক্রীড়ার খোরাক জোগায়।

তিনি আরো জানান, পূর্বেই মাঠের বিশাল অংশ দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে অফিস ও গুদাম ঘর। ওই সময়ে তৎকালীন শিক্ষা কর্মকর্তা ওয়াদা করেছিলেন দু’টি স্থাপনা ছাড়া পরবর্তীতে আর কোন স্থাপনা করা হবে না। অথচ এখন তার চেয়েও অনেক বড় পরিমাণ জমি দখল করে নিয়েছে তারা।

আ.ন.ম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘আমরা কিছুতেই খেলার মাঠ দখল হতে দেবো না। নির্মাণ সামগ্রী সরিয়ে নিতে আমরা ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছি। তা আজকে শেষ হচ্ছে। তবুও যদি সরিয়ে নেয়া না হয় তাহলে সমগ্র ককসবাজার পৌরবাসীকে সাথে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনে যাবো।’

জয়বাংলা বাহিনী ৭১’ এর কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা কামাল হোসেন চৌধুরী জানান, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ককসবাজারে মুজিব বাহিনী গঠন এবং পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং শুরু করা হয়েছিল এই মাঠে। আর সেই স্মৃতিবিজড়িত মাঠ আজ ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে। তাই এই শতবর্ষী খেলার মাঠ রক্ষায় ককসবাজারের সর্বস্তরের শ্রেনী পেশার মানুষ সম্মিলিত ভাবে রাজপথে নেমে এসেছে।

তিনি বলেন, ‘অপরিকল্পিত ভাবে খেলার মাঠ নষ্ট না করে মাঠের পশ্চিম পাশে পর্যাপ্ত জমি থাকা সত্বেও কেন মাঠে বহুতল ভবন নির্মান করছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর তা খতিয়ে দেখা উচিৎ।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহীদুল আজম বলেন, ‘এটা জাতীয় মানের একটি ট্রেনিং সেন্টার হচ্ছে। সরকার কক্সবাজারকে অগ্রাধিকার দিয়ে এখানে এই সেন্টার নির্মাণ করছে। এটি একটি জাতীয় মানের সম্পদও বলা যায়। এটি কক্সবাজার থেকে সরিয়ে নিতে অনেক জেলা থেকে তদবিরও হয়েছিল।’

তিনি আরো বলেন, ‘খেলার মাঠটি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সম্পত্তি। নিজস্ব জায়গাতেই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ভবনটি করছে। তারপরও খেলার মাঠের জন্য পরিমাণ মতো জায়গা রাখা হয়েছে। ওই জায়গায় খেলার মাঠের উপযোগিতা থাকবে।’ খেলার মাঠ দখল করার অবৈধ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিষয়টি সরকার বুঝবে বলে জানান তিনি।

জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, ‘খেলার মাঠ দখল করার বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি এখন ঢাকায় আছি। কক্সবাজার এসে বিষয়টি দেখবো।’

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে. কর্ণেল (অব.) ফোরকান আহামদ বলেন, ‘মাঠ দখল করে ভবন নির্মাণের বিষয়টি আমি জানি না। আমি খোঁজ নিয়েই ব্যবস্থা নিবো।’