এম.জিয়াবুল হক, চকরিয়া:
চকরিয়া উপজেলার হারবাংয়ে ব্যাপক আয়োজনে শুরু হয়েছে ঐতিহ্যের পুরানো সংস্কৃতি ঘোড়দৌড় মেলা। শনিবার থেকে মেলা শুরু হয়েছে, চলবে সপ্তাহব্যাপী। মেলায় যদিও জীবন্ত কোন ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা নেই, তবু শতবছরের পুরানো ঐতিহ্যের সংস্কৃতির মেলবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন গ্রামবাংলা নানা শ্রেনী-পেশার মানুষ। মেলায় বসেছে নাগরদোলা, মাটির তৈরী খেলা সামগ্রী, খাবার ও কসমেটিক বিক্রির একাধিক দোকান। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলছে এসব দোকানে বিপুল বেচাবিক্রি। ছোট্ট শিশুদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে নাগরদোলা।
চকরিয়া উপজেলার কাকারা ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহি ঘোড়াদৌড় মেলার ইতিহাস এতদাঞ্চলের মানুষের কমবেশি জানা। ইতিহাস মতে, প্রকৃতির লীলা নিকেতন সাগরতনয়া কক্সবাজার জেলার বন-বনানী পাহাড় বেষ্টিত প্রকৃতিক সম্পদের ভরপুর চকরিয়া উপজেলার কাকারা একটি এতিহ্যবাহী ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের প্রপার কাকারার মরহুম মাওলানা বদিউজ্জামান চৌধুরী ১৯০৬ সালে বিনোদনের জন্য ঘোড়দৌড় মেলার প্রবর্তন করেন।
মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামীবাদী ঘনিষ্ট সহযোগী চকরিয়া, উপজেলা কাকারা গ্রামে এক ধর্নাঢ্য পরিবারে ১৮৪৬ খিষ্টাব্দে আলহাজ্ব মাওলানা মুহাম্মদ বদিউজ্জামান চৌধুরী আলকাদেরী জন্ম গ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপান্তে বদিউজ্জামান আলকাদেরী খ]ভারতের উত্তর প্রদেশের রামপুর আলেয়া মাদ্রাসায় টাইটেল ডিগ্রী অর্জন করেন। এলাকার লোকজনকে চিতাত বিনোদনের জন্য মরহুম মাওলানা আল কাদেরী ১৯০৬ সালে ইসলামী বাজার নামে একটি মেলা প্রতিষ্টা করেন। পরবর্তী এই ইসলামী বাজার ঐতিহাসিক ঘোড়দৌড় মেলা নামে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্টা লাভ করে। প্রতিবছর উত্তএরাপত্তর এই মেলা চট্রগ্রাম ও কক্সবাজারের লোকদের নিকট জনপ্রিয় হয়ে উঠে। রাত্রে বহু দুর দুরান্ত থেকে ছেলে/মেয়েরা এই মেলায় এসে বছরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করে।
জানতে চাইলে মেলার পুরানো দিনের স্মৃতি তুলে ধরে বর্তমান কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শওকত ওসমান বলেন, তখনকার দিনে প্রচুর ঘোড়া ছিল এবং মেলায় ঘোড়ার উপস্থিতি ও দৌড় প্রতিযোগিতা ছিল একটি বিষ্ময়কর ব্যাপার। হাজার হাজার লোক বিশেষ করে আশপাশের পাহাড়ী রাখাইন , চাকমা , বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন মেলায় আসতে বেশি উৎসাহী ছিলেন। পাহাড়ের চূড়া, গাছের ডালে ও উচুঁ জায়গায় দাঁড়িয়ে এই দৌড় প্রতিযোগিতা দৌড় প্রত্যক্ষ করত। তিনি বলেন, তখনকার সময়ে এলাকার প্রতাপশালী ব্যক্তি মোস্তাক মিয়া নিজে শুধু একটি ছোট বেত নিয়ে পুরা মেলা এলাকার লক্ষাধিক লোকের সমাগমে পুরাপুরি নিয়ন্ত্রন করত। ঢাকা, চট্টগ্রাম থেকে বড় বড় দোকান পাট কাকারা ঘোড় দৌড় মেলায় এসে দু’তিন আগে থেকে জমা করা হত। বর্তমানে মেলাটি প্রায় আট-দশবছর ধরে বন্ধ রয়েছে। সেই কারনে মেলার জৌলুসও হারাতে বসেছে নতুন প্রজন্মের লোকজন।
জানা গেছে, কাকারা ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহি ঘোড়দৌড় মেলায় একসময় বেশি বিক্রি হতো বড় বড় তামার ডেস্কী, কম্বল, বাসন-কোসন, কাপড়-চোপড়, বিভিন্ন ধরনের খেলনা ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। মেলায় বসতো সার্কাস, পুতুল নাচসহ বিভিন্ন রকমের বিনোদনমুলক প্যাভলিয়ন। পাশপাশি কাকারা ,চিরিঙ্গা, মহেশখালীর হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন সুস্বাদু মিষ্টান্ন তৈরী করে মেলায় বিক্রি করতো। অন্তত শতাধিক মিষ্টান্ন দোকানে ভরপুর থাকতো মেলা প্রাঙ্গন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলে প্রতিজনের হাতে দেখা যেত মিষ্টান্ন ভর্তি পাতিল নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে যেতে। প্রচার আছে, মিষ্টান্ন ভর্তি এই পাতিল ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অষ্ণলের আত্মীয়-স্বজনদের নিকট পাঠানো হতো। এমনকি মেলা উপলক্ষে ছয়মাস আগে ছেলে- মেয়েরা বাড়িতে বাঁশের পুলের মাঠির টোয়াশায় (ব্যাংক) তৈরী করে বা অন্যখানে টাকা-পয়সা জমা করে রাখত। যাতে ওই টাকা নিয়ে তাঁরা মেলায় আসতে পারে। মেলা উপলক্ষে স্থানীয় কাকারা শাহ ওমর (রা:) মাজারে মিলাদ, ওরশ ও তবারুক বিতরণ করা হতো। সারারাত চলতো জিকির, কাউয়ালী গান।
উদাহরণ আছে, মেলা চলাকালে চকরিয়া উপজেলা ও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা কাকারা ইউনিয়নে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আগে থেকে মেহমান হিসেবে উপস্থিত হতো। ওইসময় মেহেমানদের জন্য যাবতীয় খাবার যোগাড় করে রাখত স্থানীয় পরিবার গুলো। এলাকায় প্রবাদ আছে, কাকারা ইউনিয়নের কোন মেয়ে অনত্র বিয়ে দিলে মেলার সময় তাকে অবশ্যই নাইয়র (বাপের বাড়িতে বেড়াতে পাঠাতে) দিতে হবে এবং এই কথাটি বিয়ের সময় কাবিননামায় লিখা থাকতো। প্রতিবছর শীতকালের শুরুতে পৌষমাসের মাঝামাঝি সময়ে অন্তত সাত দিন ধরে চলতো এই মেলা।
অভিযোগ রয়েছে, ১৯৯১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর কাকারা ইউনিয়নের ঐহিত্যবাহি শতবছরের ঘোড়াদৌড় মেলাটি অপসংস্কৃতির বদনাম রটিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। সেই থেকে গ্রামীণ জনপদের অসম্ভব জনপ্রিয় এই আয়োজনটি বন্ধ রয়েছে। ফলে মেলার ঐতিহ্য ও গুরুত্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নতুন প্রজন্মের লোকজন। পাশাপাশি দিনদিন জৌলুসও হারাতে বসেছে শতবছরের ঘোড়াদৌড় মেলাটি। এ অবস্থায় বিগত কয়েকবছর ধরে চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের স্থানীয় সংস্কৃতিপ্রেমী কিছু মানুষের বদৌলতে প্রবর্তন করা হয়েছে হারবাংয়ের ঘোড়া দৌড় মেলাটি। প্রতিবছর শীতকালের শুরুতে পৌষ মাসের মাঝ সময়ে শুরু হয় মেলার আনুষ্ঠানিকতা। তবে হারবাংয়ের মেলাটি অপেক্ষাকৃত ছোট ও লোক সমাগম ঘটে অপ্রতুল।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।