ইমাম খাইর, সিবিএন:
২০১৮ সালের জানুয়ারী মাসের ১ তারিখ। সকাল ঘড়ির কাঁটা দশটা পেরিয়ে গেল। তখনো আকাশে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ঝরছিল। পথঘাট হালকা পিচ্ছিল। হোঁচট খাওয়ার অবস্থা। বিশেষ করে ছোট্টমনিদের পথে বের হওয়াটা দায়! তথাপিও বৃষ্টি¯œাত পথ দিয়ে নতুন বই নিতে ছুটছিল ঋষী কেশ। সে কক্সবাজার বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া একাডেমীর নার্সারীর ছাত্র।

শুধু ঋষী কেশ কেন? নতুন বইয়ের ঘ্রান পেতে আগ্রহভরে স্কুলের ‘লো বেঞ্চে’ বসে আছে দ্বিতীয় শ্রেনীর প্রমি, তৃতীয় শ্রেনীর ঈষিকা, পঞ্চম শ্রেনীর কবিতা। মাধ্যমিক শ্রেনীর ছাত্ররাও ওখানে ছিল। সবার চোখে মুখে বই পেতে উৎসাহ। ঝলমল করছে অযুত সম্ভাবনা।

সকাল থেকে বৃষ্টির কারণে অনুষ্ঠান শুরু হতে প্রায় একঘন্টা দেরী হয়েছে। তথাপিও সব শিশুর মধ্যেই অনাবিল আনন্দ। সবাই অধীর আগ্রহে বসে আছে কখন বই দেবে সেই সময়টির জন্য।

ঘগির কাঁটা সকাল ১১ পার হতেই প্রধান অতিথি কক্সবাজার বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্সের মহাপরিচালক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এমএম সিরাজুল ইসলামকে সাথে নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকে পড়েন প্রধান শিক্ষক ছৈয়দ করিম। যথারীতি বই উৎসবের কার্যক্রম অনুষ্ঠান শুরু হলো।

এমন সময় নার্সারীর ছাত্র ঋষী কেশ তার মাকে বলছে- ‘মা সবার আগে আমি বই নেব।’ ঠিকই তার হাতে বই তুলে দেন অতিথিরা। সঙ্গে তার মা সোমা দাশও উপস্থিত ছিলেন। খুব খুশি হলো ঋষি। নতুন বই নয়, যেন আকাশের চাঁদটি হাতে পেয়েছে। অপেক্ষারত অন্যান্য ছোট্ট শিক্ষার্থীরাও উদগ্রীব হয়ে আছে- কখন তাদের বই দেয়া হবে?

নতুন বইয়ের ঘ্রাণ একটি শিশুকে যে আনন্দ দেয়, তা যেন পৃথিবীর অন্য কিছুতে নেই। হরেক রকমের বেলুন আর ফিতা দিয়ে বেঁধে আকর্ষণীয় করা হয়েছে নতুন বইয়ের সেট। ক্রমান্বয়ে সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দেন অতিথিরা। নতুন বছরের বই পেয়ে খোশ আমেজে সবাই বাড়ী ফিরে যায়। এ সময় উৎফুল্লিত দেখা গেছে তাদের শিক্ষক ও অভিভাবকদের। বইয়ের উৎসব যেন প্রাণের উৎসব।

নতুন বই হাতে পেয়ে কক্সবাজার বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া একাডেমীর শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস।

প্রতিক্রিয়া চানতে চাইলে কক্সবাজার বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া একাডেমীর সহকারী শিক্ষিকা ও অভিভাবক সোমা দাশ বলেন, আমার ছেলে ঋষী কেশ ভর্তি পরীক্ষায় ১ নম্বরে উত্তীর্ণ হয়ে নার্সারীর বই নিয়েছে। শিক্ষাজীবনের প্রথমেই বিনামূল্যে বই আমাদেরকে উৎসাহিত করেছে।

বই উৎসবে উপস্থিত ছিলেন প্রধান শিক্ষক ছৈয়দ করিম, সহকারী প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ তৈয়ব, আবদুল মালেক, অভিভাবক সাংবাদিক জিএএম আশেক উল্লাহ, সহকারী শিক্ষক সোলতান আহমদ, আবুল কাসেম, প্রাতঃ শাখার প্রধান শাহজাহান, আবু তৈয়ব, সেলিনা আকতার প্রমুখ।

কক্সবাজার কেন্দ্রীয় বাসটার্মিনালস্থ উত্তরণ মডেল স্কুলে সরকার ঘোষিত বই উৎসব উদযাপন করা হয়েছে। ২০১৮ সালের প্রথম দিন (১ জানুয়ারী) দুপুরে স্কুল প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কক্সবাজার বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্সের মহাপরিচালক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এমএম সিরাজুল ইসলাম।

সারাদেশের মতো কক্সবাজার জেলার প্রতিটি প্রাথমিক, নিন্মমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে বই উৎসব হয়েছে। ১ জানুয়ারী সকালে কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদের কনফারেন্স হলে আনুষ্ঠানিক বই উৎসব উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নোমান হোসেন প্রিন্স এর সভাপতিত্বে সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জি.এম রহিমুল্লাহ, জেলা শিক্ষা অফিসার সালেহ উদ্দিন চৌধুরী, উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. সেলিম উদ্দিন প্রমুখ।

মহেশখালীতে সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেন। একইভাবে জেলার সকল উপজেলায় বর্ণাঢ্যভাবে বই উৎসব পালিত হয়েছে। নতুন বই পেয়ে মহা খুশিতে মেতে উঠে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের অভিভাবকদের ভীড় দেখা গেছে।

সুত্র জানায়, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের আগে থেকে বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হলেও ২০১০ সাল থেকে প্রথম থেকে নবম শ্রেণির সব শিক্ষার্থীদের এ সুবিধার আওতায় সরকার।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি বলছে, গত বছরের চেয়ে এবার ১০ লাখ ৭০ হাজার ৯৬৬ জন শিক্ষার্থী বেড়েছে। ফলে এবার ৭১ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬৯টি বই বেশি ছাপানো হয়েছে।

এবারের বইগুলো ভালোমানের কাগজে ছাপা হয়েছে। বইগুলো আকর্ষণীয় ও রঙিন। নবম-দশম শ্রেণির ১২টি সুখপাঠ্য বই দামি কাগজে রঙিন ছবিসহ ছাপা হয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, ২০১৮ শিক্ষাবর্ষে দুই কোটি ৪৯ লাখ ৮৩ হাজার ৯৯৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে বই বিতরণ করা হয়। প্রাথমিক স্তরে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ১০ কোটি ৩৬ লাখ ২৫ হাজার ৪৮০টি এবং প্রাক-প্রাথমিকে ৩৪ লাখ ১১ হাজার ৮২৪টি ‘আমার বই’ এবং ৩৪ লাখ ১১হাজার ৮২৪টি অনুশীলন খাতা মুদ্রণ করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, এ বছর সারা দেশে চার কোটি প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ইবতেদায়ি, দাখিল ভোকেশনাল, এসএসসি ভোকেশনাল, ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠী এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মধ্যে মোট ৩৫ কোটি ৪২ লাখ ৯০ হাজার ১৬২টি পাঠ্যবই ছাপা হয়। এই শিক্ষাবর্ষে ১০ লাখ ৭০ হাজার ৯৬৬ জন শিক্ষার্থী বেড়ে যাওয়ার ফলে অতিরিক্ত ৭১ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬৯টি পাঠ্যবই মুদ্রণ করা হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ’ সরকারের ঐতিহাসিক এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া কমেছে এবং বিদ্যালয়গুলোতে উল্লেখযোগ্য হারে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক বিতরণের উদ্যোগকে শিক্ষা খাতে একটি ‘মাইলফলক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ এতে শিক্ষার্থীরা তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে উৎসাহিত হচ্ছে।