ডেস্ক নিউজ:
‘চাকরি জীবনে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হওয়া একটি অভিশাপ। শত্রুকেও যেনও আল্লাহ ওএসডি না করে।’ —নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে কথাগুলো বলছিলেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব থাকা অবস্থায় ওএসডি হওয়া এক কর্মকর্তা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে তিনি ওএসডি হন। এখন পর্যন্ত (২০ ডিসেম্বর) তিনি ওই অবস্থায় রয়েছেন। নতুন করে পদায়ন হয়নি তার, কবে হবে তাও জানেন না।
সচিবালয়অপর এক যুগ্ম সচিব পদ মর্যাদার কর্মকর্তা সাত মাস আগে ওএসডি হয়েছেন। ছিলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে। কবে নাগাদ পদায়ন হবে তা তিনিও জানেন না। এখন তার অবসর সময়, কোনও কাজ নাই। প্রতিদিন সচিবালয়ে আসেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণলয়ে নির্দিষ্ট স্থানে হাজিরা দিয়ে বসেন লাইব্রেরিতে। সমমনা অপর ওএসডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে খোশগল্প করেন। এরপর একসময় বাসায় চলে যান। এই হচ্ছে তার দিনের রুটিন।
কিভাবে সময় কাটে, জানতে চাইলে বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদকের সঙ্গে সচিবালয়ে আলাপকালে ওএসডি হওয়া এক অতিরিক্ত সচিব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খুবই খারাপ সময় যাচ্ছে, পদ আছে। বেতন ভাতা সবই আছে, কিন্তু বসার স্থান নাই। দায়িত্ব নাই, কাজ নাই। নাই গুরুত্ব। এটি এক ধরনের শস্তি, চাকরি জীবনে এ এক বড় অভিশাপ।’
এক প্রশ্নের জবাবে ওই অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘পরিবারের কাছেও অনেক ছোট হয়ে আছি। তাদের ধারণা হয়তো কোনও অপরাধ করেছি, তার কারণে সরকার আমাকে ওএসডি করেছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন হয়তো যোগ্য নই, তাই পদায়ন হচ্ছে না। আবার অনেকে মনে করেন হয়তো স্রোতের বিপরীতধর্মী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাই পদায়ন হচ্ছে না।’
একই প্রশ্নে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে ওএসডি হওয়া যুগ্ম সচিব বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, গত সাত মাস গ্রামের বাড়ি যাই না। গ্রামে গেলেই আত্মীয়-স্বজন জানতে চায় কোন মন্ত্রণালয়ে আছি? কোনও উত্তর দিতে পারি না। আবার কেউ কেউ সচিবালয়ে আসবেন বলে ‘প্রবেশ পাস’ চায়। কোনও মন্ত্রণালয়ে নেই বলে পাসও দিতে পারি না। আমি ওএসডি কর্মকর্তা এটা বলাও লজ্জার বিষয়।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বেতন-ভাতা পাচ্ছি ঠিকই। এ দিয়ে তো সব হয় না। ইজ্জত বলে কথা। সবার ধারণা, হয়তো কোনও অপরাধ করেছি, তাই আমি ওএসডি। যতোই বলি পদের বিপরীতে কর্মকর্তা বেশি, তাই পদায়ন হচ্ছে না, তা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। বেশির ভাগ মানুষই মনে করে, হয়তো গায়ে কোনও রাজনৈতিক সিল রয়েছে।’
এমন পরিস্থিতি শুধু ওই দু’জন কর্মকর্তার নয়। সচিবালয়ে এমন কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক। ওএসডি কর্মকর্তা সবারই বক্তব্য একই রকমের। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ওএসডি কর্মকর্তারা বেতন, ভাতা, গাড়িসহ সব ধরনের সরকারি সুবিধাই পাবেন। পান না শুধু দায়িত্ব। তাই তাদের অফিসের নির্দিষ্ট সময়ে সচিবালয়ে এসে হাজিরা দিতে হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। এদের বসতে হয় লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরিই তাদের অফিস কক্ষ। কেউ যদি কোনও ওএসডি কর্মকর্তাকে খুঁজতে সচিবালয়ে আসেন তাহলে তাকে সচিবালয়ের লাইব্রেরিতে আসতে হবে, বা কোনও ক্যান্টিনে।
সূত্র জানায়, একটি পদের বিপরীতে তৈরি হচ্ছে অনেক পদ। এতে পদোন্নতি প্রাপ্তদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা বাড়লেও নতুন পদে কাজ দেওয়া যাচ্ছে না। আর কাজ না পেয়ে পদবঞ্চিতদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। এতে জনপ্রশাসনের ‘পিরামিড কাঠামো’ থাকছে না বলে অভিমত সাবেক আমলাদের।
এমন পরিস্থিতিতে গত ১১ ডিসেম্বর আবারও সরকার যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার ১২৮ কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছে। অতিরিক্ত সচিবের স্থায়ী পদের সংখ্যা ১১১টি হলেও এই ১২৮সহ প্রশাসনে বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যদায় কর্মকর্তার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৬০ জনে। পদোন্নতিপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিবদের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তাদের পূর্বপদে সমন্বয় করা হয়েছে। পদের বিপরীতে কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি হওয়ায় বেশিরভাগ কর্মকর্তাকেই আগের পদেই পদায়ন (ইন সি টু) করা হবে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর ৫৩৬ জন কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপ সচিবের তিন স্তরে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। এর আগে একই বছরের মে মাসে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম-সচিব ও উপসচিব পদে আরও ২১৭ কর্মকর্তা এবং ২০১৫ সালের জুন মাসে উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব এবং অতিরিক্ত সচিব পদে আরও ৮৭৩ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয় সরকার। সর্বশেষ গত ২৩ এপ্রিল ২৬৭ জন সিনিয়র সহকারী সচিবকে উপ সচিব পদে পদোন্নতি দেয় সরকার।
জানা গেছে, প্রশাসনে যুগ্ম সচিবের স্থায়ী পদ আছে ৪৩০টি। এরপর আবার নতুন করে বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) সরকার আরও ১৯৩ জন উপ সচিবকে যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছে। এ নিয়ে প্রশাসনে বর্তমানে যুগ্ম সচিব পদে কর্মরত কর্মকর্তার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৪২ জন। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল মেয়াদে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বিভিন্ন ধাপে জনপ্রশাসনের ২ হাজার ৫২৮ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছিল। এর মধ্যে উপ সচিব হিসাবে ১ হাজার ৬৬ জন, যুগ্ম সচিব পদে এক হাজার ৯১ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ২৯৩ জন এবং সচিব পদে ৭৮ জন কর্মকর্তা পদোন্নতি পান।
‘সরকারের উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি বিধিমালা, ২০০২’ অনুসরণ করা হয়। সে অনুযায়ী ৭০ শতাংশ প্রশাসন ক্যাডার এবং ৩০ শতাংশ অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য বিবেচনায় নেওয়া হয়। বিধিমালা অনুযায়ী, উপসচিব পদে কমপক্ষে ৫ বছর চাকরিসহ সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের সদস্য হিসেবে কমপক্ষে ১৫ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা বা উপ সচিব পদে কমপক্ষে ৩ বছর চাকরিসহ ২০ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পদ অনুসারে কাজ দিতে না পারলে এ ধরনের পদোন্নতি দেওয়া অনুচিৎ। পদোন্নতি পেলে আর্থিক সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা বাড়ে কিন্তু এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দায়িত্ব বণ্টন না হলে অসন্তুষ্টি বাড়ে। সেটি খেয়াল রাখতে হয়।’
একই প্রসঙ্গ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবু হোসেন মুহম্মদ আহসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাসীন দল প্রশাসনকে নিজের পক্ষে রাখতে নানাবিধ কৌশল অবলম্বন করেন, এর একটি হচ্ছে পদোন্নতি। এর মাধ্যমে কর্মকর্তার সামাজিক মর্যাদা বাড়ে। আর্থিকভাবে লাভবান হয়। আমাদের দেশেও এর ব্যাতিক্রম নয়। নানাসময় বিভিন্ন সরকারই এ কাজটি করে। এটি এখন সবার জানা। কিন্তু পদের সমপরিমান কাজ ও দায়িত্ব না পেলে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মনে ক্ষোভ জন্মায়, এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।’
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।